অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের ২৫ হাজার নেতার সঙ্গে সোমবার ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তিনি ২ ঘণ্টার উপর সময় ধরে বক্তব্য রাখেন। তিনি নিজের বক্তব্যে যে বিষয়টির উপর বিশেষভাবে জোর দেন সেটি হল ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় (এসআইআর) ১০০ শতাংশ এনুমারেশন ফর্ম যাতে নিশ্চিতভাবে জমা করা হয়। তৃণমূল সূত্রের খবর, অভিষেক বলেছেন, ৯৮ বা ৯৯ শতাংশ নয়, ১০০ শতাংশ ফর্মই যাতে জমা পড়ে সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তৃণমূল নেতাদের। এমনকী আগামী দিনে নেতা পদে থাকার সূচকও হয়ে উঠেছে সমস্ত এনুমারেশন ফর্ম জমা করতে পারা বা না-পারা।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী কমিশন-নিযুক্ত বুথ লেভেল এজেন্টরা (বিএলও)এসআইআরের ফর্ম বিলি এবং সংগ্রহ করছেন। তাঁরাই আবার সেই ফর্ম জমা দিচ্ছেন ব্লক স্তরে। এই বিএলওদের সঙ্গে থাকছেন রাজনৈতিক দলগুলি দ্বারা নিযুক্ত বুথ লেভেল এজেন্টরা (বিএলএ)। পশ্চিমবঙ্গে এই কাজে অন্য রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায় তৃণমূলকেই এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি মাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে। ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করা বিষয়ে অভিষেকের ওই নির্দেশিকা নিয়ে দলের অনেকের মধ্যেই ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে প্রায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত যে, এসআইআরের মত একটি ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে নিজের দলকে মাঠে নামিয়ে অভিষেক প্রমাণ করতে চাইছেন যে এইরকম উদ্বেগপূর্ণ সময়ে তৃণমূল ছাড়া কাজ করার মত আর কেউ নেই।
Advertisement
তৃণমূলের প্রথম সারির একাধিক নেতারা মনে করছেন, অভিষেক ‘কর্পোরেট’ ধাঁচের রাজনীতি করেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলি যেমন লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে রাখে, তিনিও সেই পথেই হেঁটেছেন। তাঁরা মনে করছেন যে, অভিষেক নিজেও জানেন, সব জায়গায় ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করা অসম্ভব। তাঁর কারণ মৃত, স্থানান্তরিত, দু’জায়গায় নাম রয়েছে এমন ভোটাররা আছেন।
Advertisement
পরিবারের সদস্যরা তথ্য দিয়ে মৃতদের নাম জমা দিলেও দু’জায়গায় নাম রয়েছে যাঁদের, সেই সব ভোটারদের ক্ষেত্রে দু’বার ফর্ম জমা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাসত্ত্বেও অভিষেক ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করার উপর বারবার জোর দিয়েছেন কমিশনকে চাপে রাখার উদ্দেশে। তৃণমূলের অনেকে মনে করছেন দলকে এই চাপের মধ্যে রাখলে সেই চাপ পড়বে বিএলওদের উপরও। তা আবার চাপ তৈরি করবে নির্বাচন কমিশনের উপর।
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ হিসাব অনুযায়ী তাঁরা জানেন, এসআইআর ফর্ম পূরণ করেছেন এরকম অনেক ভোটার ২০০২-এর তালিকায় তাঁদের পরিচিত কারও নাম দেখাতে পারবেন না। কিন্তু সেই কারণে ফর্ম জমা পড়বে না এমনটা যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে চাইছেন অভিষেক। সেক্ষেত্রে শুনানি পর্বে ভোটারের সংখ্যা বেশি হলে শাসকদল কমিশনের উপর চাপ তৈরি করতে পারবে। ভুয়ো ভোটার বা রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকায় থাকার যে অভিযোগ বিরোধী রাজনৈতিক দল এনেছে, যত বেশি ফর্ম জমা পড়বে সেই অভিযোগের প্রভাব রাজনৈতিকভাবে তত কমতে থাকবে।
এসআইআর-এর প্রথম পর্যায়ের শেষ ন’দিনে অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাতে জরুরিকালীন তৎপরতায় কাজ হয়, তার জন্য ১৩ জন নেতাকে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছেন অভিষেক। তাঁরা ঘুরে ঘুরে বিএলএ-দের সঙ্গে কথা বলে ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা দেওয়ার ব্যাপারটির তত্ত্বাবধান করবেন। তৃণমূলের অনেকেই মনে করছেন,যাঁদের ফর্মে সঠিক নথি থাকবে না তাঁদের দ্বিতীয় পর্বে কমিশনের শুনানিতে যেতে হবে। সেই দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতি নিতেই ১০০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন অভিষেক। সংশ্লিষ্ট ভোটাররা শুনানিতে ডাক পাবেন একমাত্র ফর্ম জমা পড়লেই। ফর্ম জমা না দিলে শুনানিতে ডাক পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। যা তথ্য রয়েছে তা ব্যবহার করেই যাতে ফর্ম জমা হয়, তা নিশ্চিত করতে চাইছেন অভিষেক।
প্রথম পর্বের কাজ সঠিকভাবে করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় পর্বের জন্য এগোতে পারবে তৃণমূল। দ্বিতীয় পর্বে সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হবে। এই কথা মঙ্গলবার বনগাঁর সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন যাঁদের উপযুক্ত নথি থাকবে না তাঁদের জন্য সরকার থেকে শিবির করে নথি তৈরি করে দেওয়া হবে। তৃণমূলের অনেকের মতে যত বেশি ফর্ম জমা হবে, তত বেশি করে সরকার পরবর্তী পর্বের প্রস্তুতি করতে পারবে। এই পর্বে সেই কাজও সেরে রাখতে চাইছেন অভিষেক। তৃণমূলের একজন প্রথম সারির নেতা বলেছেন, ‘বিজেপির কোনো ভোটারেরও যদি নথি না থাকে এবং যদি তৃণমূল সেই নথি তৈরি করে দেয় এবং ভোটার তালিকায় সেই ভোটারের নাম ওঠে, সেক্ষেত্রে ১০ জনের মধ্যে অন্তত দু’জন ভোটার ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে মন বদলাবেন। সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে অভিষেক আসলে নিচুতলার সাংগঠনিক কার্যকলাপ আরও বাড়াতে চেয়েছেন। তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতা বলেছেন, ‘এসআইআর পর্বে জনসংযোগের কাজে আমরা কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলাম। অভিষেকের নির্দেশের ফলে তা আরও গতিবেগ পাবে।’ অনেক তৃণমূল নেতা ব্যাখ্যা করেছেন , অভিষেক যে ভাবে ফর্ম জমা করার ব্যাপারটিকে দলীয় পদে টিকে থাকার সূচক হিসাবে ঘোষণা করেছেন , তার ফলে শুধু বিএলএরা নয়, নিম্নপদস্থ নেতারাও সকলের ঘরে ঘরে ছুটবেন।
সোমবারের বৈঠকে অভিষেক ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বুথস্তরে কাজ হলেও সব তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে দলের কাছে ঠিক সময়ে এসে পৌছাচ্ছে না। ১০০ শতাংশ ফর্ম জমা করানোর মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য দলের কাছে থাকা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন অভিষেক। কারণ, দ্বিতীয় পর্বে সেই সব তথ্যের ভিত্তিতেই কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংঘাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে চাইছে তৃণমূল।
Advertisement



