মতিউর রহমান
ওরা ফুলের মত সুন্দর। ভোরের শিশিরের মত শুভ্র, শুদ্ধ। ওদের মনটা সাদা কাগজের মত ধবধবে, সফেদ। ওরা নিষ্পাপ, পবিত্র। ওরা মর্তের মাটিতে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার আশীর্বাদ। ওরা আগামীর আলো। বিপুল বিশ্বে ওরা অফুরন্ত প্রাণ প্রবাহের প্রতীক। ওরা শিশু। ওরা মাতৃক্রোড়ে আশীর্বাদ-পুষ্প। সোনালি রোদের ঝলমলে হাসি। ওরা আশার আকাশে স্বপ্নের পাখি। মেঘ ছুঁয়ে ওরা বৃষ্টি আনে জীবনের রুখাশুখা প্রান্তরে। ওরা সবুজের হিল্লোল আর ফুলের হাসিতে ভরিয়ে তোলে পৃথিবী। জীবনের বিপুল তরঙ্গে জোয়ারের জল হয়ে ওরা ঢালে প্রাণপ্রবাহ। ওরা বোঝে না জাত-ধর্মের বৈরিতা, ধর্মান্ধতা। ওরা বোঝে না স্বার্থের সংঘাত, কুটিলতার কুনাট্য। ওরা বোঝে না লিঙ্গবৈষম্য। খিদে পেলে ওরা কাঁদে, পেট ভরা থাকলে ওরা হাসে।
Advertisement
ওদের হাসিতে এক পৃথিবী আনন্দ, সুখের বর্ষণ ঘটায় পিতা- মাতা, পরিজনদের বুকের ভেতর। ওদের দুষ্টুমি-দুরন্তপনা আছড়ে পড়ে মাতৃক্রোড়ে। মাতৃস্নেহের সুধায় ওরা স্নাত হয়, স্নিগ্ধ হয়। ওদের মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত সমস্ত অন্যায় অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়, দীপ্ত লড়াইয়ের অঙ্গীকার ঘোষণা করে। আগামীর দূত, অনাগত নতুন পৃথিবীর নাগরিক শিশুরা কেমন আছে দুনিয়াজুড়ে? ওরা ভালো নেই কোথাও। আমাদের দেশ ভারতেও একদম ভালো নেই ওরা। বিপন্ন ওদের শৈশব। যৌন নির্যাতনে নিত্য নিপীড়িত ওরা। শিশু-ধর্ষণ বিশেষত শিশুকন্যার ওপর যৌন নির্যাতন-ধর্ষণ বর্তমানে ভয়ংকর এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে ব্যাক্তি-মানসিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সামাজিকতার শরীরজুড়ে বাসা বেঁধেছে এই মারণ ব্যাধি।
Advertisement
আমরা এক বিপন্ন সময়ের বাসিন্দা। ক্ষয়িষ্ণু, অসহিষ্ণু এ সময় আমাদের মন-মানসিকতায় ধরিয়েছে ঘুণ; বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধের ঘরে ঝুলিয়েছে তালা৷ আমরা ক্রমশ এক বোধহীন বিবেকহীন বিকৃত মানসিকতায় লালিত হচ্ছি। শিশু-ধর্ষণ নিঃসন্দেহে একটি অসুস্থ প্রবণতা। সামাজিক অবক্ষয় যখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে তখনই এই প্রবণতা চরম আকার ধারণ করে।
সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতা, অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে শিশুকন্যার উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে থাকে।
বর্তমান সময়ে মানুষের বোধের ক্রমশ বিনাশ হচ্ছে। নৈতিকতা, শুভাশুভ, ভালমন্দ বোধ হারিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে বিরাজ করছে ভয়ের সংস্কৃতি। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, মূল্যবোধের বিনাশ, অর্থনৈতিক আপোষ-বোঝাপড়া, ধর্মান্ধতা, মেরুকরণ, বিভাজন ইত্যাদি নানা কারণে ভয়ের সংস্কৃতি ক্রমশ মাথা তুলছে। ফলস্বরূপ শিশু-ধর্ষণের মতো ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। সমাজমাধ্যমের অপব্যবহার, মাদক সেবন, শিশু-কিশোরদের আচরণগত সমস্যার কারণে ঘটনাগুলির সংখ্যা ও ব্যাপকতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিছুকাল আগের একটি পরিসংখ্যান বলছে, বছরের প্রথম ছ’মাসে আমাদের দেশে চব্বিশ হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, এক্ষেত্রে সবার উপরে আছে যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশ। এমনিতেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- হাঙ্গামা, অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বেড়ে গিয়েছে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসনের রক্তচাপ যে বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। গত ছ’মাসে সেখানে তিন হাজার চারশো সাতান্নটি শিশু-ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
উত্তরপ্রদেশের পরেই আছে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর মহারাষ্ট্র। আমাদের রাজ্য শিশুর ওপর যৌন নিগ্রহের নিরিখে রয়েছে পঞ্চম স্থানে। এখানে গত ছ’মাসে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১,৫৫১টি ।
বর্তমান ভারতে শিশুকন্যার সামাজিক নিরাপত্তা একটি বড় মাপের প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নারীপ্রগতি, ছেলে-মেয়ে সবাই সমান— যতই বড় বড় গালভরা কথা প্রচার হোক না কেন, তা শুধু কথার কথা থেকে গিয়েছে, তা বাস্তব হয়ে ওঠেনি। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দিক দিয়ে সাম্যের তুলাদণ্ডে তা বড় হালকা থেকে গিয়েছে। সাম্যের আকাশে পৌঁছনো তো দূরস্থান, বর্তমানে মেয়েদের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বারবার। নারীর প্রতি বৈষম্য, বঞ্চনার যে সমস্যা— দৃষ্টিভঙ্গির দ্বিচারিতা দূর না হলে তার উন্নতি সম্ভব নয়। মেয়েদের ক্ষমতায়ন— পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক বিকাশ না হলে সমস্যার শেকড় আরও শক্ত হবে।
লিঙ্গবৈষম্য দূর না হলে স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন দূর আকাশের তারাই থেকে যাবে, কখনও বাস্তব হয়ে উঠবে না। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে।
আসল কথা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। দরকার সচেতনতার প্রসার৷ আর এ ব্যাপারে পুরুষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদে শামিল হতে হবে। নারীদের তরফ থেকেও চাই সচেতনতার প্রসার। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর শিক্ষা শিশুদের দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, এটা তাদের আবশ্যিক কর্তব্য। স্কুল কলেজে মূল্যবোধ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক জীবনে মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা আবশ্যক। শিশুদের দিতে হবে সংবেদনশীলতার শিক্ষা। সংবেদনশীল, দায়িত্ববান নাগরিক গড়ে তোলার জন্য শিশুদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।
শিশুর উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে পসকো (সংশোধনী) বিল পাস হয়েছে। এই বিল অনুসারে, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনে দোষী সাব্যস্ত হলে ন্যূনতম কুড়ি বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শিশু- পর্নোগ্রাফি রোধ করার সংস্থানও রয়েছে এই বিলে। যেভাবে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে তাতে কঠোর শাস্তি ব্যাতিরেকে এই প্রবণতা কমবে না।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, পসকো আইন পাস হওয়ার পর তো অনেক সময় পেরিয়ে গেল, কিন্তু এই আইন শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন বন্ধ করতে পারলো কোথায়? আসল কথা হচ্ছে, শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার প্রয়োগ যথার্থ হওয়া চাই। সঠিকভাবে তার বাস্তবায়ন না হলে সমস্যা কমবে না। নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত, আবেদনের দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তি, জামিনের কড়াকড়ি, নতুন ফাস্ট ট্র্যাক আদালত, দ্রুত শাস্তিপ্রদান প্রয়োজন। আর প্রয়োজন পুলিশ-প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রের আন্তরিক প্রয়াস।
মনে রাখতে হবে, শিশুর নিরাপত্তা প্রদান রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজ। তবে সব দায় রাষ্ট্রের উপর ছেড়ে দিলে হবে না। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। আমরা সবাই যদি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি তবে আমরা নিশ্চিত, নতুন ভোরের দূত শিশুদের জন্য আমরা বাসযোগ্য ভূমি নির্মাণ করতে পারবো, রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনতে পারবো প্রস্ফুটিত সকাল।
Advertisement



