নরেন্দ্রনাথ কুলে
সম্প্রতি দেশের বিমানযাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এক সপ্তাহ হতে চলল তার সুরাহা হয়নি এখনও। কোনও দুর্ঘটনা, কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘন কুয়াশার কারণে এই দুর্ভোগ তা কিন্তু নয়। দেশে অধিকাংশ যাত্রী পরিষেবায় নিযুক্ত যে বিমানসংস্থা তারই গাফিলতির কারণে যাত্রীদের এই দুর্ভোগ। কিন্তু এই গাফিলতি তাদের ইচ্ছাকৃত। পাইলটসহ বিমানকর্মীদের ধর্মঘটে যাত্রীদের জন্য পরিষেবা বন্ধ করতে হয়েছে এমন নয়। অথচ একের পর এক অসংখ্য বিমানের উড়ান বাতিল করতে হয়েছে। তাহলে সেই গাফিলতি ইচ্ছাকৃত ছাড়া আর কী? এ কথা স্পষ্ট হয়েছে সংস্থার সিদ্ধান্তে। হঠাৎই কর্মীসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ দর্শিত হয়েছে।
Advertisement
কর্মীসংখ্যা কম হলে সংস্থা দায়ী। কম কর্মীসংখ্যা নিয়ে সংস্থা কাজ করলে তার জন্যও সংস্থা দায়ী। কম কর্মীসংখ্যা দিয়ে কাজ করালে কর্মীদের বেশি সময় কাজ করতে বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তখন অতিরিক্ত কাজের চাপে কর্মীদের ক্লান্তি আসতে বাধ্য। এমনকি এই ক্লান্তি মানসিক অবসাদে নিয়ে যেতে সময় নেয় না। যা থেকে যাত্রীদের সুরক্ষা লঙ্ঘিত হতে পারে৷
Advertisement
যাত্রীদের সুরক্ষা দেখতে গেলে কর্মীদের কাজের সুরক্ষা প্রয়োজন। সেফটি ক্যাটেগরি কর্মীর সেই সুরক্ষা দিতে গেলে অতিরিক্ত কাজের চাপ কমাতে হয়। পাশাপাশি তাদের কাজের জন্য মানসিক সুস্থতার কথাও ভাবতে হয় । কিন্তু সংস্থা শুধু তার লাভ যখন দেখবে এগুলো তখন অবহেলিত হতে বাধ্য।
পাইলট সহ যে সমস্ত কর্মী বিমান ওড়ার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের উপযুক্ত বিশ্রামের প্রয়োজন যার জন্য কর্মীর সাপ্তাহিক ছুটির প্রয়োজন। এবং সেই ছুটি সপ্তাহে আটচল্লিশ ঘন্টার কাজের হিসেবে। সাপ্তাহিক ছুটি কখনও ব্যক্তিগত ছুটি নিলেই ধরা যায় না। নতুন ডিউটি রস্টার যা সরকারি প্রশাসনিকভাবে মঞ্জুর হয়েছে তাতে কর্মীদের রাত ডিউটি যেমন কম হবে তেমনই তাঁরা সাপ্তাহিক ছুটিও পাবেন। এই রস্টার চালু করতে গেলে অতিরিক্ত কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু সেই অতিরিক্ত কর্মী ইন্ডিগো বিমানসংস্থা নিয়োগ করেনি। কাজের জন্য এই রস্টারে কর্মী নিয়োগ না করে একের পর এক বিমান উড়ান বাতিল করে যাত্রীদের দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যাত্রীদের দুর্ভোগে কর্মীদের কাজের রস্টার সম্পর্কে সরকারি সিদ্ধান্ত আপাতত মুলতুবি হয়েছে। ইন্ডিগো সংস্থা কর্মীদের যেমনভাবে কাজ করায় সেভাবেই কাজ করাতে চায় এবং সেভাবেই চলবে। যাত্রীদের সুরক্ষা, কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথ্যা নেই। বিমান সংস্থার এমন কাজের কাছে সরকারকে একপ্রকার নতি স্বীকার করতে হল।
তাহলে প্রশ্ন করতেই হয় যে সরকার কাদের পক্ষে? যাত্রীদের পক্ষে, বিমানকর্মীদের পক্ষে নাকি বিমান সংস্থার পক্ষে। বিমান সংস্থার পক্ষে বলেই সরকারের সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে বাতিল করতে হল। কিন্তু দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা কাকে দুষবেন, বিমান সংস্থাকে নাকি সরকারি প্রশাসনকে ? কর্মীদের ধর্মঘটে এমন অচলাবস্থা তৈরি হলে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কর্মসংস্কৃতি সংকটে বলে কত কি বক্তব্য উঠে আসত। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। এ ঘটনা থেকে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সংস্থার মালিকের মনমত সিদ্ধান্ত না হলে সরকারকে পিছু হটতে এতটুকু সময় নিতে হয় না। কিন্তু জনসাধারণকে তাঁদের কোন দাবি আদায় করতে প্রাণপাত করতে হয় । তাতে দাবি আদায় হবেই তা কিন্তু নয়। দিল্লির বুকে কৃষকদের আন্দোলনে তা দেখা গেছে।
ইন্ডিগো বিমান সংস্থা যেভাবে কর্মীদের, যাত্রীদের এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে ভোঁতা করে দেওয়ার খেলা করলো তা কিন্তু বর্তমান সরকারের পরিকল্পনার এক রূপ। এই সরকার সবকিছুই যখন বেসরকারি মালিকের হাতে ছেড়ে দিতে চেয়েছে, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। এটা তার সময়োপযোগী নিদর্শন। শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য নতুন যে আইন সরকার করেছে তার পূর্বাভাস ইন্ডিগোর এই চেহারা বলে দিচ্ছে। নতুন আইনে বারো ঘন্টার কাজের নিধান দেওয়া আছে। সেখানে সাপ্তাহিক কাজ আটচল্লিশ ঘন্টার কথা বলা হলেও, এই বারো ঘন্টার কাজ নতুন অছিলায় মালিক করিয়ে নেবে। কর্মী ছাঁটাই করার অধিকার মালিকের হাতে যেখানে থাকবে, সেখানে শ্রমিকের অধিকার বলে কিছু থাকে না। নতুন শ্রম আইনের দশম অনুচ্ছেদের ৭৭ নং ধারায় বলা হয়েছে ৩০০-র কম শ্রমিক নিয়ে চলা সংস্থার মালিকরা লে-অফ, কর্মী ছাঁটাই করার জন্য সরকারের কাছে অনুমতি নিতে হবে না। তাহলে এমন সংস্থার মালিকরা কর্মীদের কাজ হারানোর ভয় দেখিয়ে খুব সহজেই বেশি খাটিয়ে নিতে কি পারবে না।
দেশে যেখানে পঁচাত্তর শতাংশ শিল্প সংস্থায় অনধিক তিনশ কর্মী কাজ করে সেখানে এই আইন শ্রমিকদের জন্য কতটা বিপজ্জনক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার কোনো সংস্থায় শ্রমিক আন্দোলন করে ধর্মঘট করা চলবে না। ধর্মঘট বেআইনি। যতদিন শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে, তার মাঝে ধর্মঘট করা যাবে না। ধর্মঘটে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শ্রমিকের অনুমতি না থাকলে ধর্মঘট করা যাবে না। পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক ছুটি নিলেও তা ধর্মঘট হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন মালিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তবে ধর্মঘট ডাকলে চৌদ্দ দিন আগে নোটিস দিতে হবে । পুরনো আইনে জরুরী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ধর্মঘটের জন্য নোটিস দিতে হত। কিন্তু এখন এই আইনে সবার ক্ষেত্রেই তা কার্যকর। তার মানে সংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের পায়ে বেড়ি লাগানোর জন্য এ প্রক্রিয়া। সংগঠিত শ্রমিকদের অবস্থা এমন হলে অসংগঠিত শ্রমিক ও পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা সুস্থ-যে থাকবে না তা পরিষ্কার। ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকদের ঢালাও ছাড়পত্র দিয়েছে নতুন এই আইন। দেশের শ্রম আইনকে ব্যবসাবান্ধব করতে গেলে তা শ্রমবান্ধব করা সম্ভব নয়। যার ফলে দেশের সত্তর শতাংশ শ্রমিক বিপর্যস্ত হবে। ব্যবসাবান্ধব শিল্প অথচ শ্রমিক সংকটে থাকবে। দেশে যদি এত বিশাল সংখ্যক মানুষ বিপর্যস্ত হয় তাহলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা থাকতে পারবে সে কথা বলা যায় না। তাহলে এই আইন কার্যকর হলে তা শ্রমিকমুখি না হয়ে মালিকমুুুখি হবে তা পরিষ্কার। আর এই মালিকমুখি কীভাবে হবে তা দেখিয়ে দিল ইন্ডিগো বিমান সংস্থা । এ একধরনের বিভ্রাট যাকে বলা যায় মালিক-বিভ্রাট। এমন মালিক-বিভ্রাটে দেশ ও দেশের মানুষ সংকটে জর্জরিত যে হতে চলেছে তা কি পরিষ্কার নয়?
Advertisement



