• facebook
  • twitter
Wednesday, 10 December, 2025

পরিবেশ দূষণ— আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

উদ্ভিদের উপর প্রভাব-সালফার ডাই-অক্সাইড ও অ্যাসিড বৃষ্টি, যেমন, ক্লোরোসিস, নেক্রোসিস প্রভৃতির জন্ম হয় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

এম এ নাসের

বিশ্বের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর প্রতি সাত জন মানুষের মধ্যে এক জন মানুষ ভারতে বসবাস করেন। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ ভারতের অধিবাসী। ফলস্বরূপ পৃথিবীর মোট ভূমির কেবল ২. ৪ শতাংশ ভারতের আয়ত্বে বিদ্যমান।

Advertisement

উন্নয়নের অভিপ্রায়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ উন্নতিশীল দেশের নিতান্তই আবশ্যক। লর্ড লেউইনের অভিমত, পরিবেশ তিন প্রকারের বা কোনও বাক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানুষের পক্ষে সাধারণত গঠন করতে সক্ষম হয়।

Advertisement

মানুষ তার পারিপার্শিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সমষ্টিকে পরিবেশ নামে আখ্যায়িত করে। বাস্তুবিদ ওডামের অভিপ্রায় হল, দূষণ বায়ু, জল, মৃত্তিকা প্রভৃতির ভৌত, রাসায়নিক, জৈবিক বৈশিষ্টের অনভিপ্রেত পরিবর্তন যা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানব জীবনকে প্রভাবিত করে।

বলা বাহুল্য, মানব শরীর যে নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত দূষণ সহনীয় হয়, তাকে স্ট্যাক এমিশন স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বায়ুতে মিশ্রিত ক্ষুদ্র কণাগুলির Stack Emission Standard (SES) হল ১৫০ মিলিগ্রাম।

দূষকের পরিবহন মাধ্যমগুলি পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হওয়ায় দূষণের শ্রেণীবিন্যাস হল, প্রাকৃতিক-ভূমি, জল। সামাজিক- মাটি, দারিদ্রতা, দাঙ্গা, যুদ্ধ, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, অপকর্ম। অঞ্চল ও উৎস-পৌর, গ্রামীন, শিল্পজাত, কৃষিজ। দূরত্বের মাধ্যম-বায়ু, জল, ভূমি। অবস্থান-গ্রামীনে কৃষিক্ষেত্রে,
পৌর এলাকায় গৃহস্থলির আবর্জনা নিরীক্ষণে।

বিশ্বের বায়ুমন্ডলের অভ্যন্তরে অনিষ্টকর পদার্থের সমষ্টি যখন মানুষ ও তদীয় পরিবেশকে ক্ষতি করে, তখন সেই প্রবাহকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ুদূষণ আখ্যায়িত করে। যে সব বর্জের উপাদান দ্বারা বায়ু সর্বদা দূষিত হয়, তা কেবল প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস থেকে উৎপন্ন সে সকল দুষক বায়ুতে মিশ্রিত হয়ে বায়ুদূষণ করলে তা বায়ুদূষক বলা হয়। যেমন, কারখানায় ধোঁয়া, বিভিন্ন গ্যাস, ধূলিকনা, পরাগরেণু প্রভৃতি।

বায়ুতে দূষকের দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ীর উপস্থিতির ফলে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম হয়।
১) ক্ষণস্থায়ী প্রভাব-কার্বন মনো-অক্সাইড-রক্তের হিমোগ্লোবিন ও মায়োগ্লোবিনের সঙ্গে মিশ্রিত কোষে অক্সিজেন প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করলে মাথাঘোরা, ঝিমুনী হয়। সালফার ডাই-অক্সাইড- নাক জ্বালা, শ্বাসনালীর জ্বালা, কাশি, হাঁপানি হয়। নাইট্রোজেন অক্সাইড- ফুসফুসে জ্বালা, শ্বাসনালীর বৃদ্ধি হয়।
এছাড়া হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথাইল মারক্যাপ্টন, ইথাইল মারক্যাপ্টন-ম্লাণশক্তি অস্থায়ীভাবে কমে যায়।
২ ) দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব- ব্রংকাইটিস এবং শ্বাসকষ্ট- নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই-অক্সাইড, ধূমপান প্রভৃতি। বাতাসে মিশ্রিত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের জন্য কার্বন, সালফার, ইউরেনিয়াম, আয়োডিন, রেডিয়াম বিদ্যমানতা লক্ষনীয় হয়।

উদ্ভিদের উপর প্রভাব-সালফার ডাই-অক্সাইড ও অ্যাসিড বৃষ্টি, যেমন, ক্লোরোসিস, নেক্রোসিস প্রভৃতির জন্ম হয় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
ওজোন ও ধোঁয়াশা- পাতা হলুদ আকার নেয় ও দ্রুত বার্ধক্যে উপনীত হয়।
হাইড্রোজেন ফুয়োরাইড-স্বসন ও সালোকসংশ্লেষে ব্যাঘাত, দূষকগুলির যৌথ প্রভাবে উদ্ভিদ কোষের জৈবিক ক্রিয়া আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যা শরীরে স্বাভাবিক ক্রম সৃষ্টি করে না।

পশুপাখির উপর প্রভাব-১) আর্সেনিক-লালা নিঃসরণ, নার্ভের প্যারালাইসিস।
২) সিসা-বৃদ্ধি, বিকাশ, বংশ বিস্তার ব্যাহত হয়।
৩) তেজস্ক্রিয় গ্যাস সংক্ষেপিত আয়ুস্কাল ও ক্যানসার।
৪) ফ্লুরাইড-পশুপাখিদের বমি, প্রজনন ও দুধ উৎপাদনে ক্ষমতা কমে যায়। মাটির অনুজীব ও অট্রলিকার উপর প্রভাব-বায়ুদূষণের ফলস্বরূপ সৃষ্ট অ্যাসিড বৃষ্টি মাটির অনুজীবদের অপমৃত্যু হতে থাকে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট, বা মার্বেল দ্বারা তৈরি বাড়ি ও অট্রলিকার গায়ে ছোটো ছোটো গর্তের সৃষ্টি করে, একে স্টোন ক্যানসার বলা হয়।

বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব-বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন, মিথেন, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি গ্যাসের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন, কলকারখানায় ধোঁয়া, বর্জ্য, অম্লবৃষ্টি প্রভৃতি ধারাবাহিক সময়ে সারা বাস্তুতন্দ্রকে নাশ করে।

জলদূষণ–বিশ্বের মোট আয়তনের ৭১. ৪% জল ও ২৮. ৬% স্থল। মোট জলভাগের ৯৭. ৩% লবণযুক্ত ও ২.৭% মিষ্টি জল। মিষ্টি জলের ৭২. ২%
হিমবাহ হিসেবে ও ২২. ৪% মাটির জল হিসেবে, ০. ৩৫% হ্রদ ও জলাশয়ে, ০. ৩৪% বায়ুমন্ডলে এবং ০.০১% নদীতে থাকে।

পরিবেশের কোনো কোনো অব্যবহৃিত পদার্থ জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক কার্যকলাপ অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানবকূলের ক্ষতি সাধিত হয়ে জল দূষণ হয়।

ভূপৃষ্ঠের জলদূষকগুলিকে আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১) নিকাশ বর্জ্য-কলকারখানা, শহরে নর্দমার ভীষণ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও জীবাণু মিশ্রিত জল।
২) রোগ জীবাণু-ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, প্রোটোজোয়া।
৩) তাপ-তাপবিদ্যুৎ, রাসায়নিক, ধাতুশিল্প, পারমাণবিক কেন্দ্রের গরম জল।
৪) জৈব রাসায়নিক দ্রব্যাদি-খনিজ তেল, কীটনাশক, আগাছানাশক প্রভৃতি।
অপরাপর জলদূষকগুলি হল-পুষ্টি মৌল-ফসফরাস, নাইট্রোজেন, ডিটারজেন্ট প্রভৃতি।
অজৈব রাসায়নিক পদার্থ-তামা, সীসা, দস্তা, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি।
অপরাপর ভাসমান আর্বজনা, প্ল্যাস্টিক, অ্যাসিড বৃষ্টি।
৫) তেজস্ক্রিয় পদার্থ-ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি।
৬) উদ্ভিদের পুষ্টি-মানুষ ও প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ, রাসায়নিক সার।
৭) রাসায়নিক ও খনিজ উপাদান-তেল, গ্যাস, লবণ, অ্যাসিড।
আর্সেনিক-জার্মান অ্যালকেমিস্ট অ্যালবার্টস ১২৫০ সালে প্রথম আর্সেনিক মৌলটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। মাটিতে আর্সেনিকের মাত্রা ৫-৬ PPM, WHO-এর অভিমতে, জলে বাস্তবিক ও অনুমোদিত আর্সেনিকের পরিমাণ ০.০৫ লিটার।

দূষণ প্রতিরোধে কর্তব্য –১) দূষকগুলো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জমা করে, নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে, যাতে পুকুরে মিশে না যায়। কারখানা ও শহরের আর্বজনাকে শোধন করে পুকুরে মিশিয়ে দেওয়া বাঞ্চনীয়।
কীটনাশক, জৈব সার ও জৈব পেষ্ট নিয়ন্ত্রকের ব্যবহার আবশ্যিক।
তাপের দূষণ নিয়ন্ত্রণের হেতু শিল্পের স্বীয় কুলিং সিস্টেম থাকা আবশ্যক।
২) জল পরিশোধনের বন্দোবস্তু-আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্জ্য জলের ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে দূষকগুলি দূর করা জরুরি।
৩) আইন তৈরি ও বাস্তবায়ন –জলদুষণের রোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৭৪ সালের নির্দিষ্ট আইন প্রয়োগ করে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
৪) সকল শ্রেণীর মানুষের দ্বারা জনসচেতনতার অঙ্গীকার জরুরি।

মাটি দূষণ– মাটিতে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার, প্ল্যাস্টিক, কারখানার বর্জ্য, কীটনাশক, আগাছানাশক, প্রভৃতির অংশ মিশে গিয়ে মাটির উপর বসবাসকারী সকল জীবের স্বাস্থ্যের অবনতি না হয়, সেই দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। মাটি ক্ষয়, তাপমাত্রার সর্বাধিক নির্ণায়ক।

মাটি দূষণ নিয়ন্ত্রণ– রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব পেষ্ট নিয়ন্ত্রণ বন্দোবস্ত করা জরুরি। প্ল্যাস্টিকের পরিবর্তে বিকল্প প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন জরুরি।

শব্দ দূষণ– বাস্তবিক শব্দ মানুষের শ্রবণ অনুভূতি সৃষ্টিকারী আবেগ, যা তেল, কঠিন ও গ্যাসীয় পদার্থের অভ্যন্তরে দীর্ঘ তরঙ্গের সৃষ্টি করে। কোলাহল ও তীব্র শব্দের থেকে নিরাপদেথাকা।
শব্দের তীব্রতা মাপার একক ডেসিবেল। ডেসিবেল স্কেলে প্রত্যেক ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধি শব্দের তীব্রতার দশগুণ বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে থাকে। দূষিত শব্দ উৎস স্থলের আলোকে তিন প্রকার- গ্রামীন উৎস, পৌর অঞ্চল, শিল্পাকল।

শব্দ দূষণের ফলে মানুষের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পীড়ার জন্ম হয়। যেমন, উচ্চ শব্দের ফলে বধিরতা, কানের পর্দা ছিড়ে যায়। রক্তে গ্লুকোজের শিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। স্বাসপ্রশ্বাসের পরিবর্তন হয়। এছাড়া পুরানো বাড়িতে ফাটল ধরে, বাড়ির কাঁচ ভেঙে যায়।

শব্দ নিয়ন্ত্রণ– বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৪০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ হলে, শ্রমিকদের ইয়ার প্লাগ ব্যবহার জরুরি। প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্প শব্দ উৎপাদনকারী সরঞ্জাম ব্যবহার করা। জনবহুল এলাকায় কারখানা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। রাস্তার দুই ধারে অগণিত গাছ রোপণ করে শব্দ দূষণ কমানো সম্ভব। গণমাধ্যমের
সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ–১) সমুদ্রে বর্জ্য নিক্ষেপে পারমাণবিক বর্জ্য ও প্ল্যাস্টিকের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করা আবশ্যক।
২) নর্দমার জল শোধন করে পুকুর, নদী, সমুদ্রে নিক্ষেপ করা জরুরি।
৩) জলের উপরিভাগ থেকে তেল অপসারণ করতে হবে। তৈলবাহী জাহাজগুলিতে কঠোর নজরদারি বাধ্যতামূলক।
৪) দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

গঙ্গা অ্যাকশান প্ল্যান-১৯৮৬ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গঙ্গা নদীর জলদূষণ হ্রাস করার অভিপ্রায়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। গ্ৰিণ বেঞ্চ ১৯৮৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশে একাধিক পরিবেশ বিষয়ে মামলা কলকাতা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির জন্য একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়, যা গ্ৰিণ বেঞ্চ নামে পরিচিত।

রামশার কনভেনশন- ইরাণের রামশারে ১৯৭১ সালে জলাভূমির স্থিতিশীল ব্যবহার এবং সংরক্ষণের অভিপ্রায়ের হেতু একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা রামশার কনভেনশন নামে বহুল বিদিত। ভারতে এটি ১১ বছর পর বাস্তবে রূপ পায়। সুতরাং ভারতের ২৭ টি জলাভূমিকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বের নিরিখে রামশার সাইটের স্বীকৃতি আদায় করে। সারা বিশ্বে ২৩০০ টি রামশার সাইট বিদ্যমান। ভারতের কেরলের ভেম্বনাদ সবচেয়ে গুরুত্ব রাখে।

Advertisement