নোটন কর
সম্প্রতি আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ (বর্তমানে শ্রীভূমি) জেলায় একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়ায় এক কংগ্রেস কর্মীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হয়েছে। ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ – ভারতের সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে, বাংলাদেশের যারা তাদের দেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে চান, কংগ্রেস তাঁদের মদত দিচ্ছে। সে দেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া ওই পরিকল্পনারই অংশ এবং কংগ্রেসীরা ‘বাংলাদেশের মোহে আচ্ছন্ন’।
Advertisement
গত ১৬ নভেম্বর, মধ্যপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিং পারমার ভূপালে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ব্রিটিশরা তাদের এজেন্ডা পূরণের জন্য এদেশে কিছু ‘ভুয়ো সমাজ সংস্কারক’ তৈরি করেছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি বলেন, “রাজা রামমোহন রায় ব্রিটিশ এজেন্ট ছিলেন। তিনি এদেশে ইংরেজদের দালাল হিসেবে কাজ করতেন। ধর্মান্তরণের জন্য চক্র শুরু করেছিলেন।”
Advertisement
২০১৯ সালে, মে মাসে, কলকাতায় এক নির্বাচনী রোড শো-তে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর নেতৃত্বে একটি মিছিল থেকে সংঘীরা বিদ্যাসাগর কলেজে ঢুকে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে, তারপর বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তিটি ভেঙে দেয়।
ইদানীং বাঙালি জাতিসত্ত্বার ওপর আরএসএস-বিজেপির আক্রমণ তীব্র হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশী তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হচ্ছে এবং কোথাও জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া (পুশইন) হয়েছে। কেন আরএসএস-বিজেপি বাঙালি জাতিসত্ত্বার উপর আক্রমণ করতে চাইছে? এর কারণ নিহিত আছে ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালির প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার মধ্যে। বাঙালির স্বাধীনতা আকাঙ্খা, লড়াই, আন্দোলন এবং মনীষীদের নবজাগরণ বার্তা বরাবরই আরএসএস-বিজেপির কাছে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
রামমোহন যখন বেঁচে ছিলেন তখনও তাকে ‘হিন্দু বিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা তাকে খুন করার কথাও ভেবেছিলো। তাঁর নিজের কথায়, “আমি কোনদিনই হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করিনি, আমার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মের গোড়ামি ও কুসংস্কার”। তিনি যে ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেছিলেন, সেখানে জাতিভেদ প্রথা, হিন্দু ধর্মের অস্পৃশ্যতা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা ইত্যাদি অমানবিক হিন্দু ধর্ম বিরোধী প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন। রামমোহন প্রমাণ করে দেখান হিন্দু ধর্মে কোথাও সতীদাহের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এটি হিন্দু ধর্মানুমোদিত নয়। তিনি যখন সতীদাহের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন তখনো সমাজের কট্টর রক্ষণশীল হিন্দুসভা তার বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে রামমোহনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সতীদাহ বিরোধী আইন চালু হয় এবং এক মধ্যযুগীয় অভিশাপের হাত থেকে মুক্তির স্বাদ পায় ভারতীয় নারীরা।
উনিশ শতকে ভারতে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেইসময় সমাজে যে সমস্ত কু-প্রথা প্রচলিত ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাল্যবিবাহ। আর বাল্যবিবাহের অবশ্যম্ভাবী ফল হতো বাল্যবিধবা। তৎকালীন সমাজে বিধবারা ছিলেন চরম অবহেলিত ও নিপীড়িত। তাদের পুনর্বিবাহ সমাজের চোখে নিষিদ্ধ ছিল। বিধবারা জীবন কাটাতেন এক ঘৃণার পরিবেশে। তাদের কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা ছিল না। এই অন্যায় রীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাংলাদেশের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ প্রবল বাধা সৃষ্টি করে। সেসব বাধা উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিরলস প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৬ সালে “হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন” পাশ করে। এরফলে বিধবা এবং বাল্যবিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ে, যা বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ ছিল।
ব্রিটিশরা এদেশ শাসন করতে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) নীতি চালু করেছিল। বিদায়লগ্নে তারা এই নীতি দেশীয় শাসকবর্গকে দিয়ে যায়। দেশকে খণ্ডিত করে ধৰ্ম ও সম্প্রদায়ের নামে দিয়ে যায় এক সুদূরপ্রসারী বিভেদের ক্ষতচিহ্ন। সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
বিপদটা বহু আগেই বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতের অন্তর্নিহিত সত্য যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য—সেকথা তিনি তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গান ও নাটকে বারেবারে উল্লেখ করেছেন।
ধর্ম এবং তার সূত্র ধরে যে অসহিষ্ণুতার আবহ ছিল গোটা দেশজুড়ে, তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ শীর্ষক রচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘…বহুর মধ্যে আপনাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া ফেলা ভারতবর্ষের স্বভাব নহে, সে এককে পাইতে চায় বলিয়া বাহুল্যকে একের মধ্যে সংযত করাই ভারতের সাধনা।’ ১৩১৭ বঙ্গাব্দে ‘ভারত তীর্থ’ কবিতায় সম্প্রীতির মূল ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছিলেন কবি। লিখেছিলেন, ‘…এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান/ এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,এসো এসো খৃস্টান/ এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন, ধর হাত সবাকার/ এসো হে পতিত, হোক অপনীতসব অপমানভার/…আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ রবীন্দ্রনাথ সঙ্গতভাবেই বুঝেছিলেন, ভারতের ইতিহাসের মূল সুর সংঘর্ষ, বিভেদ নয়। নানা জাতি, ভাষা, ধৰ্ম, মত মিলে ভারতবর্ষ যে বহুধা সংস্কৃতির দেশ তা উপলব্ধি করেছিলেন কবিগুরু। রবীন্দ্রনাথ সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে বরাবর সরব ছিলেন। যথাযথভাবেই ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, যখন দুই-তিনটি ভিন্ন ধর্ম দাবি করে যে কেবল তাদের নিজস্ব ধর্মই সত্য এবং অন্যান্য সমস্ত ধর্মই মিথ্যা, তাদের ধর্ম কেবল স্বর্গে যাওয়ার পথ, তখন দ্বন্দ্ব এড়ানো যায় না। এইভাবে, মৌলবাদ অন্য সমস্ত ধর্মকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করে। কবিগুরুকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের পক্ষে বলেছিলেন, আবার মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়েছিলেন। আসলে কবিগুরু ছিলেন সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ সবসময়ই ব্যথিত করেছে রবীন্দ্রনাথকে। তিনি এই লড়াইয়ের একটি স্থায়ী সমাধান চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়- মাটি পরিষ্কার না করলে কাঁটাগাছই জন্মায়, ফল আশা করা যায় না।
রবি ঠাকুর শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়েই আলোচনা করেননি, এর সমাধানের কথাও ভেবেছেন। বলেছেন, শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা এই সমস্যাকে দূর করতে হবে। তিনি লিখেছিলেন, যে দেশে ধর্মকে দিয়ে বিভেদের সৃষ্টি করা হয়, সেটিই হল সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। হিন্দু-মুসলিম এই বিভেদকে তিনি পাপ বলে বিবেচনা করতেন। তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সেই বাণী। নবজাগরণের উত্তরাধিকার রাজা রামমোহন রায় রক্ষণশীল প্রবল চাপের মুখে দাঁড়িয়ে সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন ১৮২৯ সালে। তিনি নারীর জীবনের মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলন করে নারীর জীবনে নতুন আলো এনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবতা, স্বাধীনতা ও বিশ্বজনীনতার বার্তা দিয়েছিলেন এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। আরএসএস-বিজেপি বাংলার নবজাগরণের বিরোধী। তাই নবজাগরণের বার্তা বাহকদের উপর আক্রমণ শুরু করেছে।
আরএসএস-বিজেপি এদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করতে ও মুছে ফেলতে চায়। ঐতিহ্যের নামে বস্তাপচা ধ্যানধারণা ও অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন চিন্তার প্রসার ঘটানো, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা ও অন্ধ বিশ্বাসকে সত্য হিসাবে তুলে ধরা, যুক্তিবাদীদের আক্রমণ এমনকী হত্যা করার মতো কাজ আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকে করে আসছে৷ আরএসএস–বিজেপি জানে, মানুষ বৈজ্ঞানিক চিন্তার অধিকারী হলে শোষণ জুলুম সাম্প্রদায়িকতার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলবেই৷ শ্রেণি-জাতপাত–ধর্ম–বর্ণে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে তাই বিভেদের রাজনীতি দরকার বিজেপির৷
এদেশে নবজাগরণের চিন্তার শিকড়ের সাথে আরএসএসের সংযোগ কোনদিন ছিল না৷ তাই ভারতীয়ত্ব বলতে তারা প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কারগুলিকে তুলে ধরে৷ নবজাগরণের পথ বেয়ে নতুন করে যে জ্ঞানের আলো রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অন্যান্য মনীষীরা এ দেশের বুকে জ্বেলেছিলেন, আরএসএস ছিল তার ঘোর বিরোধী৷ আরএসএস–বিজেপি পৌরাণিক গল্প, আখ্যান এগুলিকেই বিজ্ঞান বলে চালাতে চাইছে৷ আরএসএসের চিন্তাধারা অনুযায়ী বিজেপি সরকার বিজ্ঞান–ইতিহাসের সিলেবাসে বেদান্ত, যাগ–যজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করেছে৷ উত্তরপ্রদেশে রবীন্দ্রনাথের রচনা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিয়েছে। এর পরেও কি বুঝতে অসুবিধা হয়– কেন রামমোহন–বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ নজরুল, মাইকেল মধুসূদনসহ মনীষীদের শিক্ষা, তাঁদের ঐতিহ্য, আরএসএস-বিজেপির সামনে এক দুর্লঙঘ্য বাধা!! রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে লালন ফকির, বাংলার উদার প্রগতিশীল ধারার উজ্জ্বল সব ব্যক্তির সংশ্লেষ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথে। যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অবিচলিত সনাতন প্রথার বড়াই যদি কেহ করিতে পারে তবে সে পশুপক্ষী-কীটপতঙ্গ, মানুষ নহে’। তাই বাংলার মনীষীদের হজম করা সনাতনী হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী বলেছেন, উপনিবেশবাদ দুই ধরনের: রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ। দ্বিতীয় প্রকারটি অনেক বেশি সুক্ষ, গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এটি চেষ্টা করে উপনিবেশিত মানুষের মন থেকে তাঁদের নিজেদের মূল্যবোধগুলি মুছে ফেলে, উপনিবেশবাদীদের মূল্যবোধগুলিকে ঢুকিয়ে দিতে, যার ফলে তাঁদের মধ্যে পরিচয়ের সঙ্কট দেখা দেয়। আরএসএস-বিজেপি ভালই জানে যে, রাজনৈতিকভাবে বাংলাকে জয় করার পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হল এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, যা রামমোহন, বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো ব্যক্তিদের মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তার ফসল। তাই তারা বাংলার সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র্য ধ্বংস করার জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করে। এই কাজে সফল হলে, তবেই তারা সক্ষম হবে এই রাজ্যের মানুষের মনে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে, যা তাদের রাজনৈতিক উত্থানের পথ
প্রশস্ত করবে।
Advertisement



