• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৭.
চিত্রজিৎ

Advertisement

আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়৷

Advertisement

ভোরে জানালা খুললেই ঘরের ভিতর চলে আসে তাপপ্রবাহ৷ চিত্রজিৎ ঘড়ি দেখছিল ঘনঘন৷ এখন তার জীবন ঘিরে ঘোর চাঞ্চল্য৷ এক অদ্ভুত অস্থিরতা৷ বেশ কিছুদিন ধরে এমন উত্তেজনা পলি ফেলতে শুরু করেছে মনের ভিতর৷

কিছুক্ষণ আগেই তার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে চালিহা রোলিং মিলের কাছে থেকে অলমিতিকে আনতে৷ তাকে রাজি করাতে খুব সমস্যা হচ্ছিল৷ বারবার বলছিল, স্যার, সৌম্য জানতে পারলে––
চিত্রজিৎ বলেছে সৌম্য জানতেই পারবে না৷ গাড়ির কাচ তোলা থাকলে ভিতরে কে আছে, না আছে বোঝা যায় না৷ জিজ্ঞাসা করলে বলবে আর্ট কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে মুক্ত আকাশের নীচে ওয়ার্কশপ করতে গিয়েছিলে৷
নীচে গাড়ির হর্ন শুনে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে নেমে এল নীচে, গাড়িতে উঠে দেখল গম্ভীর মুখে বসে আছে অলমিতি৷ তার পাশে বসে চিত্রজিৎ ড্রাইভারকে বলল, চলো, রমেন—
একটু পরেই তারা কলকাতার বাঁধন ছিন্ন করে উঠে এল অপেক্ষাকৃত ফাঁকা হাইওয়েতে৷

অলমিতি
অলমিতি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
—খুব দূরে নয়, খুব কাছেও নয়৷ যাচ্ছি নদী দেখতে ৷
—নদী কোন নদী?
—ইছামতী৷ ভারী সুন্দর নদী৷ এপারে পশ্চিমবঙ্গ, ওপারে বাংলাদেশ৷
অলমিতি কখনও ওদিকে যায়নি৷ চিত্রজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, কতক্ষণ লাগবে যেতে?
—ঘণ্টা আড়াই-তিন৷
অলমিতি কী যেন ভেবে আবার জিজ্ঞাসা করল, কখন ফিরব আমরা?
চিত্রজিতের ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসির ঝিলিক, বলল, যাওয়ার আগেই ফেরার ভাবনা! এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না কতক্ষণ লাগবে ওখানে৷ কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব৷
অলমিতির চোখের কোণে একটু অস্থিরতা, বলল, কী কাজ?
—ওখানে গেলেই বুঝতে পারবে৷
অলমিতি ছটফট করছিল ভিতরে-ভিতরে, বলল, কারও কাছে যাচ্ছেন ওখানে?
—হ্যাঁ, একটা বাংলোয়৷
বাংলো শুনে খুব অস্থির হল অলমিতি৷ বার দুয়েক তাকাল চিত্রজিতের দিকে৷ বাংলোয় কী কাজ বুঝে উঠতে পারল না৷ জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে চোখ রাখে৷

চিত্রজিৎ
চিত্রজিতও তাকাচ্ছে বাইরের দিকে৷ গত দু’দিন আকাশে ছিল মেঘের ঘোরাফেরা৷ মাঝেমধ্যে বৃষ্টির আনাগোনা৷ আজ আবার আগের মতো রোদের প্রকাশ৷ তবে দু’দিন বৃষ্টিতে স্নান করে রোদটাও যেন ভিজে-ভিজে৷
ঘণ্টাদেড়েক পর মালঞ্চ মোড় আসতে চিত্রজিৎ বলল, ‘রমেন দঁড়াও৷ কিছু খেয়ে নিই’৷ কচুরি–আলুর দম খেয়ে আবার যাত্রা শুরু৷ গাড়ির গতিমুখ বাঁয়ে ঘুরে যেতে ড্রাইভার রমেনের হঠাৎ কী মতি হল, গাড়ির টেপরেকর্ডারে আঙুল ছুঁইয়ে চালিয়ে দিল গান৷ কী আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথের গান—
আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়,
সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়৷৷

চিত্রজিৎ চমকে উঠল, রমেন হঠাৎ এই গানটা বাজাতে শুরু করল কেন, রমেন কি বুঝতে পারে তাদের ফ্ল্যাটের ভিতরকার টানাপোড়েন? বুঝতে কি পারে, ম্যাডামের সঙ্গে তার মনের মধ্যে একটা ফাটল বাড়তে শুরু করেছে ক্রমশ! তার ড্রাইভার কখনও গাড়ি ছেড়ে উপরে ওঠে না৷ কোথাও যাওয়ার কথা বললে নির্দিষ্ট সময়ে নীচে এসে মোবাইলে জানিয়ে দেয় তার আসার সংবাদ৷

গানটা চিত্রজিতের মনের গহনে গিয়ে তাকে ভাঙছে চুরমুর করে৷ একদা যে সুখের বাসা নির্মাণ করতে শুরু করেছিল, সেই খেলা আজ ভাঙনের পথে৷

অলমিতি
চিত্রজিৎ গানটা বিড়বিড় করে গাইছে শুনে অলমিতি কিছুটা অবাক৷ সে আজ বহুদিন ধরে যাতায়াত করছে এই ফ্ল্যাটে, অনুমান করছে ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে কোথাও একটা ছন্দপতন৷ সেই ছন্দপতনের মূলে কার ভূমিকা কতটা তা চেষ্টা করছে বোঝার৷ আজ চিত্রজিৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেনই বা, তা এখনও অস্পষ্ট তার কাছে৷ গত কয়েকদিন চিত্রজিতের মডেল হয়ে দেখেছে একরকম চিত্রজিৎকে, আজ হঠাৎ অন্যরকম ভূমিকায়৷ হঠাৎ ইছামতীর উদ্দেশে কেনই বা যাওয়া, তাতে অলমিতির ভূমিকাই বা কী, কেন তাকে নিয়ে যাচ্ছেন স্যার?
চিত্রজিৎ হঠাৎ বলল, তুমি নিশ্চয় পল গোগ্যাঁর নাম শুনেছ?
হঠাৎ পল গোগ্যাঁর প্রসঙ্গ উঠল কেন বুঝে উঠতে পারল না অলমিতি। ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ৷
—গোগ্যাঁ জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্যারিসে৷ কিন্তু তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে বারবার বসতি বদল করতে হয়েছিল প্রথম জীবনে৷ বড়ো হয়ে প্রথমে দক্ষিণ ফ্রান্সের ব্রিটানিতে খুঁজে পেলেন ছবি আঁকার প্রচুর রসদ৷ সেখানেও মন টিঁকল না, গেলেন এক বন্ধুকে নিয়ে পানামায়৷ তারপর আবার প্যারিস, তারপর আবার ব্রিটানিতে৷ কিন্তু তাঁর ভিতরে সর্বদাই এক ঘোর অস্থিরতা৷ হঠাৎ তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠল শৈশবে দেখা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোটো ছোটো দ্বীপের কথা৷ তিনি সব ছেড়েছুড়ে পাড়ি দিলেন সুদূর পলিনেশিয়ার তাহিতি দ্বীপে৷ সেখানকার পরিবেশ ও অধিবাসীদের সরল জীবনযাপন তাঁর এতই পছন্দ হল যে, মিশে গেলেন তাদের সঙ্গে৷ বিয়ে করলেন একটি তেরো বছরের মেয়েকে৷
—তেরো বছরের মেয়ে! অলমিতির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল বিস্ময়সূচক বাক্য।
—হ্যাঁ, সেই আদিম জীবনে বসবাস করে, এক সরলসুন্দর বালিকাকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে এঁকে ফেললেন একের পর এক ছবি, যা পরে বিশ্বনন্দিত হয়ে ওঠে৷
অলমিতি বুঝে উঠতে পারছিল না, চিত্রজিৎ স্যার হঠাৎ তাকে কলকাতার বাইরে নিয়ে এসে এরকম একটা অদ্ভুত প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন কেন?
অলমিতির মুখটা শুকিয়ে আসছিল ক্রমশ৷

তার মধ্যে গাড়ি এসে থেমে গেল একটা বাংলোর সামনে৷ চিত্রজিৎ বললেন, এই বাংলোতে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করব৷ দুপুরে লাঞ্চ খেয়ে আবার ফিরে যাব কলকাতায়৷
অলমিতির ভুরুতে কোঁচ৷ শুধু লাঞ্চ আর বিশ্রাম নিতে এত দূরে অলমিতিকে নিয়ে আসা!

বাংলোর চৌকিদার বিষাদ নামে এক বছর তিরিশের যুবক, খুব চালাকচতুর, হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, স্যার, আমাদের একজিকিউটিভ স্যার ফোনে বলে দিয়েছেন একজন নামী শিল্পী যাচ্ছেন বাংলোয়৷ জলখাবার আর লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে৷
—আমরা রাস্তায় কিছু খেয়ে নিয়েছি৷ আপাতত চা হলেই চলবে৷
বিষাদ একটু পরেই চা-বিস্কুট-কাজু নিয়ে এল প্লেটে৷ বলল, স্যার, লাঞ্চে চিকেনের ব্যবস্থা করেছি৷
—ঠিক আছে, বিষাদ, আমরা চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে লাঞ্চ নেব৷ তারপর গাড়িতে তোমাদের দেশটা একটু ঘুরেঘেরে দেখে কলকাতা ফিরে যাব৷
চায়ে চুমুক দিয়ে চিত্রজিৎ আবার বলল, এই বাংলোয় দু’জন গানের শিল্পী এসেছিলেন, তাই না!
বিষাদ উৎসাহ নিয়ে বলেল, হ্যাঁ, স্যার৷ খুব নামী শিল্পী৷ সুরঞ্জনা বসু আর তমোনাশ গুপ্ত৷ ফাংশনে প্রচুর লোক হয়েছিল৷
—তুমি গিয়েছিলে ফাংশন শুনতে?
—না, স্যার৷ বাংলো ছেড়ে কোথাও যাওয়ার হুকুম নেই৷ গেলে একজিকিউটিভ স্যার আমার চাকরি খেয়ে নেবেন৷
—আচ্ছা বিষাদ, আমি যে কারণে এসেছি, সুরঞ্জনা বসু আমার খুব পরিচিত৷ আমি এখানে আসছি শুনে বললেন একটা উপকার করতে৷ উনি যে-ঘরে ছিলেন, সেখানে নাকি চুলে বাঁধার মাথার একটা দামি কাঁকুই ফেলে গেছেন৷
—কাঁকুই, না তো স্যার৷ ওঁরা চলে যাওয়ার পর আমি সমস্ত বিছানাপত্তর ঠিকঠাক করে রেখেছি৷ বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় সব কাচতে দিয়েছি৷ কিছু তো পাইনি৷
—উনি কোন ঘরে ছিলেন রাতে?
—ওই ‘এ’ রুমে৷
—আমি একবার দেখব ঘরটা?
বিষদ ইতস্তত করে বলল, দেখুন স্যার৷ তবে আমি সব দেখেছি৷
—দুটো রুমেই খুঁজে দেখেছ?
—‘বি’ রুমে ছিলেন সেই অন্ধ শিল্পী৷
—সে ঘরেও খুঁজে দেখেছ? সেই ঘরে নিশ্চয় ম্যাডাম যাননি?
বিষাদ থমকে গিয়ে বলল, ডিনারের পর ম্যাডাম বললেন ‘তমেনাশকে ওর রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আসি৷’ ওঁরা ‘বি’ রুমে ঢুকে যাওয়ার পর আমি চলে যাই আমার ঘরে ঘুমোতে৷
চিত্রজিৎ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল নীচের ঠোঁট৷ বলল, ঠিক অছে, বিষাদ৷

অলমিতি
বিষাদের শেষ কথায় এমন গম্ভীর হয়ে গেলেন স্যার যে, বাকি সময় কথাই বললেন না৷ অলমিতি ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছিল স্যারের আজকের এই আসার কথা ভেবে৷ তা হলে কি স্যার এখানে এসেছিলেন শুধুমাত্র ম্যাডামের কাঁকুইয়ের খোঁজে? বিষাদের শেষ বাক্যটিতে এমন কিছু ছিল যা স্যারকে বেশ ঝাঁকুনি দিয়েছে৷ তারপর আর কাঁকুইয়ের কথা উচ্চারণই করলেন না।

ঘোর দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসেও একটিও কথা নয়৷ বিষাদ বারবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, চিকেন কেমন রান্না হয়েছে?’ স্যার দুবার ‘ঠিক আছে, ভালো হয়েছে’ বললেন অন্যমনস্কভাবে৷

খাওয়া শেষ হলে গাড়িতে উঠে স্যার বললেন, রমেন, এই লোকালয়টা একবার গাড়িতে বসে ঘুরে দেখি৷ তারপর রওনা দেব কলকাতায়৷

চিত্রজিৎ
ইছামতী নদীর তীরে এই জনপদ বহুদিনের পুরোনো৷ বহু প্রাচীন অট্টালিকা এই জনপদের এখানে-ওখানে বহন করছে ঐতিহ্য৷ বেশ কয়েকটি দেবদেবীর মণ্ডপ এখন ধারণ করেছে প্রত্নতত্ত্বের আকার৷ কলকাতা শহর থেকে অনেকটা দূরে, না-শহর না-গ্রাম এমন এক লোকালয়ের ছোটো-বড়ো পথ ঘুরে চিত্রজিৎ বললেন, চলো রমেন—
রমেন সকালের আধ-শোনা গানটা চালিয়ে দিল আবার :
মিলনমেলার আজ বাঁধন তো টুটবে,
ফাগুন-দিনের আজ স্বপন তো ছুটবে—
উধাও মনের পাখা মেলবি আয়৷৷

গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চিত্রজিৎ ভাবছিল কোনও মানুষের পথই ঠিকঠাক মসৃণ হয় না৷ চলতে চলতে মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়ায় জীবন৷ মিলনমেলার বন্ধন ছিঁড়ে যায়৷ স্বপ্ন খানখান হয় ভেঙে যায়৷ এক-একটা বাঁকের মুখে এসে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে স্বপ্ন-দেখা মানুষ৷

হাইওয়ে বরাবর তখন ছুটছে গাড়িটা৷ বিকেল শেষ হয়ে সন্ধের আঁধার ঝরে পড়ছে ঝুপঝুপ করে৷ পাশে অলমিতি বসে আছে উচ্চারণহীন মুখে৷ গানের শেষ কয়েকটি কলি তখন হাতুড়ি পিটছে চিত্রজিতের বুকে:
অস্তগিরির ওই শিখর চূড়ে
ঝড়ের মেঘের আজ ধ্বজা উড়ে৷
কালবৈশাখীর হবে যে নাচন,
সাথে নাচুক তোর মরণ বাঁচন––
হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলবি আয়৷৷

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement