ড. পার্থ কর্মকার, শিক্ষাবিদ
পূর্ববর্তী সংখ্যার পর
Advertisement
এছাড়া, বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করতে হলে তাদের একসঙ্গে সময় কাটানোও জরুরি। একসঙ্গে রান্না করা, গল্প বলা, ঘুরতে যাওয়া বা এমনকি টেবিল গেম খেলা—এই সব মুহূর্তগুলো শিশুর মানসিক বিকাশে দারুণভাবে সাহায্য করে।
Advertisement
অতএব, শিশু ও তরুণ প্রজন্মের সুস্থ মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করতে স্মার্টফোনের ব্যবহার সীমিত, উদ্দেশ্যমূলক এবং সচেতনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত। একটি প্রযুক্তি-সচেতন, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধে গঠিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে এখনই আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। শিশুদের বেড়ে ওঠার কেন্দ্রে মোবাইল নয়, প্রয়োজন মানুষের সান্নিধ্য, ভালোবাসা এবং বাস্তব যোগাযোগ স্থান পায়—সেই পরিবেশ তৈরি করাটাই আজকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
সচেতন সময় ব্যবস্থাপনা ও ডিজিটাল ডিটক্সের প্রয়োজনীয়তা
সময় আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এটি একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। কিন্তু বর্তমান যুগে স্মার্টফোন যেনমুল্যবান সময়ের এক নীরব ভক্ষক। আমরা সচেতনভাবে বুঝতে না পারলেও প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে ফেলি অপ্রয়োজনীয় স্ক্রলিং, রিল দেখা, ভিডিও দেখা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে আপডেট চেক করার পেছনে। এই সময়টাই হতে পারত পরিবারকে দেওয়া, নিজের শখের চর্চা, বই পড়া কিংবা প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানো—যা আমাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে অনেক বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।
এই সময় জীবনের মূল্যবান সময় অপচয়ের হাত থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হলো সচেতন সময় ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রযুক্তির জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া। কোন সময়টুকু আমরা কাজ করব, কখন বিশ্রাম নেব, এবং কখন ফোন হাতে নেব—এসব সিদ্ধান্ত আগে থেকেই স্থির থাকলে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
একই সঙ্গে প্রয়োজন ‘ডিজিটাল ডিটক্স’—অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযুক্তি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা। এটি হতে পারে দিনে এক ঘণ্টা, সপ্তাহে একদিন বা মাসে একটি নির্ধারিত সময়—যখন কোনো স্ক্রিন ব্যবহার করা হবে না। এই সময়টুকু নিজের জন্য, পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য কিংবা সৃজনশীল কাজে ব্যয় করলে তা আমাদের মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় দারুণ সহায়ক হতে পারে।
ডিটক্সের অভ্যাস গড়ে তোলার আরেকটি কার্যকর উপায় হলো স্মার্টফোন-মুক্ত জোন তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, ডাইনিং রুমে কিংবা শোবার ঘরে ফোন ব্যবহার না করার নিয়ম চালু করা যেতে পারে। এর ফলে খাবারের সময় পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ পায়, যা সম্পর্ককে আরও গভীর করে। ঘুমের আগে ফোন দূরে রাখলে মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পায় এবং ঘুমের মানও উন্নত হয়।
তাছাড়া, আমরা যদি দিনে অন্তত কিছু সময় ফোন হাতে না নিয়ে প্রকৃতির মধ্যে হাঁটাহাঁটি করি, বই পড়ি, সৃজনশীল কিছু করি বা আত্মচর্চায় সময় দিই, তাহলে আমাদের জীবনে এক নতুন ধারা তৈরি হবে। আমরা শিখব সময়ের প্রকৃত মূল্য, এবং সেটিকে কিভাবে মানুষ, সমাজ ও নিজের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যায়।
সবশেষে বলা যায়, আমরা প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করলেই সব সম্ভব হবে।আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুখী জীবন। আর তার জন্য সচেতন সময় ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত ডিজিটাল ডিটক্স হতে পারে এক অতি প্রয়োজনীয় অভ্যাস।
ভার্চুয়াল জীবনের চেয়ে বাস্তবের মূল্য
বর্তমান সময়ে আমরা অনেকেই এমন একটি দিকচিহ্নহীন প্রতিযোগিতায় আটকে পড়েছি, যার নাম ভার্চুয়াল জীবন। সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে ছবি, ‘ভাইরাল’ ভিডিও, নিখুঁত সাজসজ্জা, অবিরাম ভ্রমণের গল্প বা সুখী মুহূর্তের দৃশ্য দেখে আমরা ভুলে যাই—সেইসব দৃশ্যপটের পেছনে থাকা বাস্তবতাটি হয়তো আমাদের মতোই সাধারণ, ক্লান্ত, অসম্পূর্ণ।
এই ‘দেখানো জীবন’-এর পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলি নিজের আসল পরিচয়, আত্মতৃপ্তি, আর সবচেয়ে বড় কথা—মানুষের সঙ্গে বাস্তব সংযোগ। আমরা ভাবি, আমাদের জীবনটা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছে, আমাদের অর্জনগুলো যথেষ্ট নয়, আর আমরা বুঝি না—এই চিন্তাগুলো আমাদের মনের শান্তি কেড়ে নিচ্ছে নিঃশব্দে।
কিন্তু আসল জীবন তো ঘটে আমাদের চারপাশে। মা-বাবার হাসিমুখে, বন্ধুর অকারণ খুনসুটিতে, সন্তানের প্রথম আঁকা ছবিতে, কিংবা সন্ধ্যার চায়ের কাপে ভেসে থাকা গল্পে। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমাদের বাস্তব জীবনের রঙ। ভার্চুয়াল জীবনের ফিল্টার আর রিলের তুলনায় এই বাস্তব মুহূর্তগুলো অনেক বেশি উষ্ণ, অনেক বেশি মূল্যবান।
এখানে এসে আমাদের প্রতিদিন একটি প্রশ্ন করা উচিত—আমি কাদের জন্য সময় দিচ্ছি?যদি সেই উত্তর হয় শুধুই স্ক্রিন, ফলোয়ার, বা অনলাইন পরিচিতজন, তাহলে সময় এসেছে নিজেকে নতুন করে খুঁজে দেখার। কারণ, বাস্তব সম্পর্ক—যেখানে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়, হাতে হাত ধরে পাশে দাঁড়ানো যায়, বা কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা যায়—তার কোন বিকল্প নেই।
আমরা যদি চর্চা করি বাস্তব জীবনে সম্পর্কের, সময় দিই পরিবার, বন্ধু আর কাছের মানুষদের—তাহলে শুধু মানসিক প্রশান্তি নয়, আমাদের চারপাশের পৃথিবীটাও হয়ে উঠবে অনেক বেশি মানবিক, অনেক বেশি জীবন্ত। স্মার্টফোন বন্ধ করে কাউকে জড়িয়ে ধরা, চ্যাটিং ছেড়ে কারও পাশে চুপচাপ বসে থাকা—এই ছোট ছোট কাজগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে বড় শান্তি।
অতএব, ভার্চুয়াল জগত আমাদের জীবনের একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু সেটি যেন কখনোই আমাদের জীবনের নিয়ামক না হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তব জীবন, সম্পর্ক, এবং উপস্থিত মুহূর্তকে মূল্য দিন। কারণ জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে পর্দার পেছনের অদৃশ্য হাসি, অশ্রু, এবং সংযোগে—যা শুধু বাস্তবেই সম্ভব।
উপসংহার
স্মার্টফোন নিঃসন্দেহে আধুনিক যুগের এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি। এটি আমাদের জীবনকে করেছে সহজতর, দ্রুততর ও অধিক কার্যকর। আজ আমরা এর মাধ্যমে মুহূর্তেই দূরবর্তী কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি, কাজ করতে পারি ঘরে বসেই, জানতে পারি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর। কিন্তু এই অভূতপূর্ব সুবিধার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কিছু সূক্ষ্ম বিপদ—যা অজান্তেই গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সামাজিক ভারসাম্যে।
স্মার্টফোনের অতিরিক্ত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে এক নিঃসঙ্গ, ভার্চুয়াল-নির্ভর জীবনযাপন। সম্পর্কগুলো হয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম, কথোপকথন বদলে যাচ্ছে ইমোজিতে, আর চোখে চোখ রেখে কথা বলার মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনের আলোয়। ফলে তৈরি হচ্ছে মানসিক ক্লান্তি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং এক ধরনের একাকিত্ব, যা ব্যক্তিকে করে তোলে নিঃসঙ্গ ও আবেগশূন্য।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের সামনে একটিই পথ—সচেতনতা, সংযম ও দায়িত্বশীলতা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত স্মার্টফোনের ব্যবহারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তা জীবনকে সমৃদ্ধ করে, শুষ্ক করে না তোলে। ভার্চুয়াল নয়—বাস্তব জীবনের মানুষদের সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন,হাসি-আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, অনুভূতির আদান-প্রদান এবং সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখার অভ্যাসই পারে আমাদের সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে দিতে।
স্মার্টফোন একটি যন্ত্র, জীবনের নিয়ন্ত্রক নয়। সেটিকে আমরা যেন ব্যবহার করি প্রয়োজন অনুযায়ী, কিন্তু সেটির হাতে নিজের সময়, সম্পর্ক বা মানসিক স্থিতি তুলে না দিই। সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির সুষম ব্যবহার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা গড়ে তুলতে পারি এমন একটি জীবন, যেখানে প্রযুক্তি হবে সহায়ক, কিন্তু হৃদয় থাকবে মানুষের সংস্পর্শে সজীব।
স্মার্টফোন আর বাস্তব জীবনের মধ্যে এই ভারসাম্য রক্ষা করলেই গড়ে উঠবে একটি সুস্থ, সংবেদনশীল, ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ সমাজ—যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিকতা একসঙ্গে হাঁটে হাতে হাত রেখে।
Advertisement



