• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

কোন পথে ‘ভাবা’র অভ্যেস….

এ কথাও এসে যাবে যে বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যে-নবচেতনায় গোটা দেশকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সে-চেতনায় কি জেগে উঠেছে সর্বত্র?

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

নরেন্দ্রনাথ কুলে

বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক-এর জন্ম শতবর্ষে তাঁরই একটি উক্তিকে আজকে সময়ের বেড়াজাল থেকে পৃথক করা যেতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। ‘ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস কর’— তাঁর ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত উক্তিটি আজও সেই তর্কে কিন্তু আমাদের ভাবায়। এ কথাটা জ্ঞান বা উপদেশ না বাণী, কি বলা যায়? যাঁকে এ যুগের ছেলেমেয়েরা (৫জি যুগের বলে পরিচয় দিতে যারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ) কতটা জানে বা চেনে তা এই আলোচনার বিষয় নয়। এমনকি শুধু তাঁর-কথা নিয়েও এই নিবন্ধ নয় । যদিও এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ পঞ্চাশ বছর আগে, তবে চলচ্চিত্রটির আলোচনার জন্য এই আলোচনা নয়। এই আলোচনা তাঁর এই নির্দিষ্ট উক্তিটি নিয়ে। এই উক্তিটি কি বলে দেয়, কেউ কি ভাবতে ভুলে গেছে বা ভাবনা ভাবতেই পারছে না? তাই কি তার প্র্যাকটিস। বিশেষ করে বাঙালি যাঁরা নিজেদের উন্নত সংস্কৃতিমনস্ক বলে মনে করেন, এ কি তাঁদের ক্ষেত্রেও? এই সময়ে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি নিয়ে, তার বিশেষ ধারা নিয়ে একপ্রকার মাদকতা তৈরি করার চেষ্টা চলেছে অবিরত। সেই চেষ্টা একেবারে ভাবনাহীন তা বলা যায় না। তাই চেষ্টা ক্ষেত্রবিশেষ, ব্যক্তিবিশেষ, দলমতবিশেষ প্রতিটির ক্ষেত্রেই ভাবনাহীন তা বলা যায় না। তাহলে ভাবনা চলছে। ভাবনা চলমান।

Advertisement

তবে চলমান এই ভাবনা কোন পথে চলছে তা যদি না ভাবনায় আসে তাহলে ‘ভাবা’ প্র্যাকটিস বা চর্চা বলতে যা বোঝায় তা হয় নি বলে ধরে নিতে হয়। আর ভাবনার পথ বলতে গেলে সে পথ রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক উপাদান থেকে মুক্ত হবে কি হবে না ? এ প্রশ্ন করতে হয়। যদিও মানুষের জীবনযাপনে এই তিনটি উপাদান বহির্ভূত তা কি বলা যায়? এখন অবশ্য আর একটি উপাদান ক্রমশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে তা হল ধর্মীয় উপাদান। যদিও এ উপাদান অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে বলা ঠিক হবে না, তাকে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটাও ত একটা ভাবনা থেকে। তাহলে ভাবনা চলছে, আর এই ভাবনার লক্ষ্য একটা পথ । সেই পথ ধরেই ভাবনা এগিয়ে চলছে ।

Advertisement

আসলে ভাবনা যে পথে এগিয়ে চলছে, মানুষের জীবনযাপন, মনন সেই পথে এগিয়ে চলছে কিনা তার বিচার করার ভাবনা যদি না আসে তাহলে সেই ভাবনা এগিয়ে চলছে বলে কি বলা যায়? এই ভাবনা থেকে আজ যদি নিজেদেরকে এক মানদন্ডে মাপার অবকাশ পাই তাহলে নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারা যাবে কি? এ প্রশ্নে অনেকে বলতে পারেন মানদন্ড কি হবে? কেউ রাজনৈতিক মানদন্ডের কথা বলবেন, কেউ ধর্মীয়, আবার কেউ বা অর্থনৈতিক মানদন্ডের কথা বলবেন । মানদন্ড প্রশ্নে সাংস্কৃতিক মানদন্ডের কথা হয়তো কেউ আবার বলতে পারেন। এটা ঠিক যে মানদন্ডের নানা আপেক্ষিকতায় ভাবনা এগিয়ে চলার সাংস্কৃতিক বিচার বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে না । কিন্তু বাঙালির ভাবনার উত্তরণে রাজা রামমোহন রায় যে রেণেসাঁ শুরু করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মধ্য দিয়ে রেণেসাঁর সেই চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, মতাদর্শ আরো উন্নত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র, নজরুল সেই জীবনবোধের চর্চা করেছেন । সেই চর্চায় তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জয়গান গেয়েছেন। যদিও বিবেকানন্দের মতাদর্শ সম্পূর্ণ অন্য পথ, তবু তিনিও তাঁদের মতই পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে ভাঙতে চেয়েছেন। ভাঙতে চেয়েছেন পুরনো নৈতিকতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধতা সবকিছু। মানুষ ও সমাজের নতুন প্রয়োজনে নতুন মূল্যবোধে নতুন সমাজ গড়তে ভাঙতে চেয়েছেন পুরনো সমাজকে। তাই তাঁরা তাঁদের ভাবনার প্র্যাকটিস শুধু করেননি, তাঁদের সেই জীবনবোধে করেছেন নিরলস জীবনচর্চা৷

আজ সেই জীবনবোধের ভাবনার ধারাবাহিকতায় আরো উন্নত চর্চা চলছে বা ঘটছে কিনা তা নিয়ে নানাভাবে কথা হতেই পারে । কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও এসে যাবে যে বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যে-নবচেতনায় গোটা দেশকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সে-চেতনায় কি জেগে উঠেছে সর্বত্র? তাঁরা যে-গণতন্ত্রের চেতনায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধতা মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সেই চেতনা আজকে আমাদের চেতনায় সত্যিই কি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে? এমনকি সাহিত্য ক্ষেত্রেও। এ সম্পর্কে এক মার্কসীয় চিন্তানায়কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘একদিন যে মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যচর্চা করতে গিয়েও রাজনৈতিক আন্দোলনের কম্পনে শরৎচন্দ্র কেঁপেছেন, নজরুল কেঁপেছেন— আজকের… তার এতটুকু আলোড়ন নেই… আজকের মানবতাবাদীরা হচ্ছেন ক্রিয়াহীন তাত্ত্বিক, উন্নাসিক, জীবনে নির্ঝঞ্ঝাট— মাঝে মাঝে আসর গরম করেন রবীন্দ্র ব্যাখ্যা করে, শরৎ ব্যাখ্যা করে, নজরুল ব্যাখ্যা করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের বাণী প্রচার করার তোমার তখনই অধিকার, যখন রবীন্দ্রনাথের বুকের বেদনাটা তুমি আজও বহন কর । যার মধ্যে সে যন্ত্রণা নেই, সে কী শেখাবে ?… চব্বিশ ঘন্টা যাঁরা রবীন্দ্র সংস্কৃতির উপর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের জীবনে এ ব্যথা-বেদনা কই? অস্থিরতা কই ? চোখের সামনে অন্যায় দেখে তাঁরা যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কোথায়?… সংস্কৃতি যদি সংস্কৃতির উপর শুধু বক্তৃতা করতে শেখায়, আর বড় বড় কথা বলতে শেখায়, তা দুর্ভাগ্যজনক।’

দুর্ভাগ্যজনক তখনই যখন ভাবনার প্র্যাকটিস ইতিহাস পাল্টে দিতে চায়, সাংস্কৃতিক পটভূমিকে পাল্টে দিতে চায়। যে পরিবর্তন মানুষকে এগিয়ে না দিয়ে ছিন্নমূল করে দেয়, আজকের সেই প্রয়াস যেন সর্বত্র। এই প্রয়াসে তৈরি হচ্ছে এক সাংস্কৃতিকহীনতা । আবার বৈজ্ঞানিক ভাবনার মধ্যে যদি শুধু ধ্বংস করার ক্ষমতা হয়, তাহলে সেই ভাবনার প্র্যাকটিসে নৈতিক মানদন্ড বলে কিছুই থাকে না । এমন ধ্বংসের পথেও আত্মমগ্ন যেন সব। আজকে এই মানদন্ড খুঁজে পেতে, তাকে রক্ষা করার পথে ভাবা প্র্যাকটিস করার নতুন করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে । যা শুধু ভাবার জন্যই ভাবা হবে না। সেই ভাবনার প্রতিফলনে জ্বলে ওঠে যেন মানুষের চেতনা।

Advertisement