• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বেলামে কপ-৩০-এর প্রথম সপ্তাহের আলোচনার শীর্ষে পরিবেশ রক্ষার প্রধান বাধা অসত্য তথ্য

এই ভুল তথ্যের চলাচল এখন আর কপ-৩০ এর উপকণ্ঠে উঠে আসা কোনও পার্শ্ব সংবাদ নয়, এই বিষয়টি এখন কপ-৩০-এর মূল আলোচনায় চলে এসেছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

স্নেহাশিস সুর

ব্রাজিলে আমাজন অরণ্যের কোলে অবস্থিত বেলাম শহরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের যে বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ-৩০) শুরু হয়েছে তার প্রথম সপ্তাহ হয়ে গেল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এখনও পর্যন্ত কী হল এবারের কপ সম্মেলনে। বলাই বাহুল্য যে এবারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে যেটি উঠে এসেছে তা হল জলবায়ু বা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে অসত্য তথ্যের চলাচল রোধ করা এবং স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ তথ্যের যোগান ও ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সারা পৃথিবী এখন ফেক নিউজ বা অসত্য সংবাদ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এবং এই সমস্যার মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অনেক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেইসময় এই বিষয়টা উঠে এলো যে, আবহাওয়া এবং পরিবেশের ক্ষেত্রেও এই অসত্য তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে এবং এর ফলে পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলন চলছে তা ভীষণভাবে ব্যাহত হবে। কিছু উন্নত দেশ যারা এতদিন ধরে নির্বিচারে সারা পৃথিবীর তথা অনুন্নত দেশগুলিরও পরিবেশ দূষণ করেছে, তারা এখন অনুন্নত দেশগুলিকে খেসারত বাবদ অর্থ দিতে চায় না। আর সেটা এড়িয়ে চলতেই উন্নত দেশগুলি এই অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিতে তৎপর; যাতে ক্ষতিপূরণের জন্য তাদের আর টাকা দিতে না হয়।

Advertisement

সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘ ‘ভবিষ্যত’ সংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন করে। সেই সম্মেলনে গ্লোবাল ডিজিটাল ইমপ্যাক্ট শীর্ষক একটি সনদ অনুমোদিত হয়। তাতে সুস্থায়ী উন্নয়ন বা সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্টের লক্ষমাত্রায় পৌঁছতে তথ্যের অশুদ্ধতা কিভাবে অন্তরায় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। এই কাজে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও অসরকারি সংস্থা একসঙ্গে কাজ করবে বলে অঙ্গীকার করে। বলা হয়, এইধরনের বেঠিক তথ্যে ভরা প্রচারের মোকাবিলা কিভাবে করা যায় সে বিষয়টাও দেখতে হবে। সেইসঙ্গে এই প্রকল্পের অধীনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ক্লাইমেট ভেরিফায়েড শীর্ষক একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যাতে জলবায়ু এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কোনও তথ্য বেঠিক কিনা তা যাচাই করে নেওয়া যায়।

Advertisement

গত বছর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে যখন কপ-২৯ বৈঠক হচ্ছিল, প্রায় সেই সময়েই বাজিলের রাজধানী রিওতে হয়েছিল জি-২০ দেশগুলির নেতৃবৃন্দের শীর্ষ সম্মেলন। সেই বৈঠকেই স্থির হয় যে জলবায়ুর বিষয়ে তথ্যের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা যেমন ইউনেস্কো, ব্রাজিল এবং আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলে এই বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা করবে এবং তার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর নাম গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটি ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ।

একবছর পর বেলামের কপ-৩০-এর প্রথম সপ্তাহে এই গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটি ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ শীর্ষক সমীক্ষা-প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যেই ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা এবারের এই কপ-৩০ কে ‘সত্যের কপ’ বলে অবিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে কী সমস্যা হবে এবং তার প্রতিকারের জন্য কী কাজ করা হবে এবং এর জন্য অর্থ বরাদ্দ কে কতটা করবে, এইসব বিষয়ে আলোচনার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক তথ্য এবং তার ওপর ভিত্তি করে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ফলে তথ্যের ক্ষেত্রে সত্যের কোনওরকম বিচ্যুতি চলবে না। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিনমাসে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত ১৪ হাজার ভুল তথ্য ধরা পড়েছে। এই সংখ্যাটা ২৬৭% হারে বেড়েছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সংক্রান্ত ভুল তথ্যের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার চারশো। এগুলি কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভুল নয়, এগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোভিড মহামারির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনের এবং মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে অতিমারীর সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেই বক্তব্য, যেখানে বলা হয়েছিল প্যান্ডেমিকের মোকাবিলা সম্ভব হলেও ইনফোডেমিকের মোকাবিলা কার্যত অসম্ভব। তাই এখন বলা হচ্ছে পরিবেশ সংক্রান্ত সংস্কারের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এই বিষয়ে মিথ্যা প্রচার। যা পরিবেশ আন্দোলনকে লঘু করে দিচ্ছে বা পরিবেশ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অযথা খাটো করে দেখাচ্ছে। এমন কি বলা হয়েছে যে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতারণা বা চাতুরির সঙ্গে তুলনা করে একে বড় আকারের এক মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কিন্তু এই ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচারে বিশেষত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা এইধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারে বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং তাই বাকু সম্মেলনের সময়ে স্থির করা এক বছর পরই বেলাম সম্মেলন এই সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ভারতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দেশে এখন বহু মানুষ তথ্য এবং সংবাদের জন্য সমাজমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। ওই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে ভারতের ৫৭ শতাংশ মানুষের মনে ভুল ধারণা আছে যে জীবাশ্ম থেকে আসা শক্তি বা প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবেশ দূষণ রোধ করে। কিন্তু আসলে বিষয়টা সম্পুর্ণ বিপরীত। এছাড়া, ৫৭ শতাংশ ভারতীয় মনে করেন ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যাটারি নাকি বদল করা যায় না। এই সমীক্ষায় আরও দেখানো হয়েছে যে এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় মনে করেন, পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয় যা যা অঙ্গীকার করেছে তা ভারত ২০৫০ সালের মধ্যে রূপায়িত করবে৷ কিন্তু ভারতের পক্ষে তা আর্থিকভাবে করা সম্ভব নয়।

পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে এই ভুল তথ্যের চলাচল এখন আর কপ-৩০ এর উপকণ্ঠে উঠে আসা কোনও পার্শ্ব সংবাদ নয়, এই বিষয়টি এখন কপ-৩০-এর মূল আলোচনায় চলে এসেছে। কারণ তথ্যগত ভ্রান্তি হলে তার ওপর ভিত্তি করে কোনও প্রশাসনিক বা আর্থিক সিদ্ধান্ত বা চুক্তি সঠিক হবে না। তাই এর ফল সুদূরপ্রসারী। বিশেষত জাস্ট ট্রানজিশন বা জীবাশ্ম থেকে আসা শক্তি বা মোদ্দা কথায় কয়লার ব্যবহার কমিয়ে অচিরাচরিত বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারে প্রয়াস বা উদ্যোগ বহুলাংশে ব্যাহত হবে। এই গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটি ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ শীর্ষক সমীক্ষা-প্রকল্পের প্রতিবেদন পেশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই এই সংক্রান্ত আরও অনেক উদ্যোগ বেলামের কপ-৩০-এ সামনে আসে। তার একটি হচ্ছে কমিটমেন্ট লেটার ফর ক্লাইমেট ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটি ইন ডিজিটাল এডভারটাইজিং। এর উদ্দেশ্য সরকার এবং নাগরিক সংগঠন উভয়ের উদ্যোগে পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য আদান প্রদানের আরও স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ বা সত্য এবং নির্ভরযোগ্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর সঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং ইউনেস্কোও রয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পেছনে রয়েছে প্রায় ৩০-টির মত নাগরিক সংগঠন যার শীর্ষে রয়েছে নেটওয়ার্ক অফ পার্টনার্স ফর ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটি (আরপিআইআইসি)।

এই সংস্থাগুলি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে অশুদ্ধ তথ্যের চলাচল বন্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কারণ এর ফলে পরিবেশ দূষণ রোধে যে বিশ্ব জোড়া কর্মসূচি চালু হয়েছে তার কাজ ব্যাহত হয়। কপ-৩০ সচিবালয়ের ডিজিটাল পলিসি সংক্রান্ত উপসচিব নীনা সান্টোস বলেছেন, এই প্রথম উন্নত মানের যাচাই করা সঠিক তথ্য এবং তথ্যের বিশুদ্ধতা-র বিষয়টি জলবায়ূ দূষণ রোধে গৃহীত মূল পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো। এই একই সঙ্গে কপ-৩০ সম্মেলনে পরিবেশ সংক্রান্ত বিশুদ্ধ তথ্যের ব্যবহার ও আদান প্রদান নিশ্চিত করতে আরও কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরিবেশ সংক্রান্ত বিশুদ্ধ তথ্যের বিষয়টা এই বিষয়ের মূল স্রোতে উঠে আসার ক্ষেত্রে বর্তমান কপ-৩০ যে একটা যুগান্তকারী এবং ঐতিহাসিক ভুমিকা নিল সেকথা অবশ্যই বলা যায়।

Advertisement