সোমবার দিল্লির লালকেল্লার সামনে এক নম্বর মেট্রো গেটের সামনে হয় বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণে শুধু দিল্লি নয়, গোটা দেশে কেঁপে ওঠে। একই বছরে দু’বার জঙ্গি হামলা এর আগে সম্ভবত হয়নি। আর দিল্লি বিস্ফোরণের ঠিক একদিন আগেই লখনউ থেকে গ্রেপ্তার হন এক মহিলা চিকিৎসক। শাহিন সিদ্দিকি নামে এক চিকিৎসকের গাড়ি থেকে মেলে আগ্নেয়াস্ত্র। শাহিন এবং তাঁর সঙ্গী চিকিৎসক মুজাম্মিল শাকিলের সঙ্গে দিল্লি বিস্ফোরণের সরাসরি যোগ আছে বলে মনে করছেন তদন্তকারী অধিকারিকরা। চিকিৎসক শাহিনের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে। একজন চিকিৎসক কীভাবে জইশ-ই-মহম্মদের মতো একটি জঙ্গি সংগঠনের মহিলা শাখার প্রধান হয়ে উঠলেন তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
বিস্ফোরণের দিনই জম্মু-কাশ্মীরের পুলিশ এবং উত্তরপ্রদেশের সন্ত্রাসদমন শাখার যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার হন শাহিন। তাঁর গ্রেপ্তারের আগে একটি বাড়িতেও হানা দিয়েছিল পুলিশ। উদ্ধার হয় প্রায় ৩৬০ কেজি বিস্ফোরক এবং কিছু আগ্নেয়াস্ত্র। ২০টি বোমার টাইমার, রিমোট এবং ওয়াকিটকিও মেলে। এর পরেই উঠে আসে শাহিনের নাম। তাঁর গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মেলে একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল। চিকিৎসক শাহিন সম্পর্কে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা।
Advertisement
কানপুরের জেএসভিএম মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন শাহিন। তবে ২০১৩ সালে আচমকা উধাও হয়ে যান তিনি। এর প্রায় আট বছর পর ২০২১ সালে চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, শাহিন এমবিএস পড়াশোনা করেছেন এলাহাবাদ থেকে। বছর ২৫ আগে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষে চাকরি পান। ২০০৯-১০ সালে এক বার কনৌজের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে বদলিও হয়েছিলেন।
Advertisement
শাহিনদের আদি বাড়ি লখনউয়ের খন্দারী বাজারে। বাবা সঈদ আনসারি বন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে। শাহিন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তাঁরা দুই ভাই এবং এক বোন। মহারাষ্ট্রে জাফর হায়াত নামে এক চিকিৎসকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। ২০১৫ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। কানপুরের চাকরি ছেড়ে ফরিদাবাদ চলে গিয়েছিলেন শাহিন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কিছু দিন লখনউয়ে ছিলেন। তবে সেখান থেকেই হঠাৎ উধাও হয়ে যান তিনি। ওই সময়েই সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বলে মনে করা হচ্ছে।
শাহিন বিদেশে থাকতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তাঁর প্রাক্তন স্বামী। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝামেলা হয়। স্বামী হায়াত জানিয়েছেন, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছিল দেখাশোনা করে। অনেক দিন হল ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ও কখনওই আধ্যাত্মিক ছিল না। খুবই ধর্মনিরপেক্ষ। তবে আমাদের মতপার্থক্যের কারণ ছিল ওর বিদেশে পাকাপাকি যাওয়া নিয়ে। আমাদের দুই সন্তান। আমরা কেউই অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপ যেতে চাইনি। এখন দুই সন্তান আমার কাছেই থাকে।’
তদন্তে উঠে এসেছে, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের মহিলা শাখা জামাত-উল-মোমিনীনের ভারতের প্রধান ছিলেন শাহিন। মাসুদ আজহারের বোন সাদিয়া আজহারের সঙ্গে কাজ করতেন। লখনউয়ে যে বাড়িতে শাহিন থাকতেন, সেখান থেকে তাঁর ভাই পরভেজ আনসারিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরভেজও পেশায় চিকিৎসক। ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর সন্দেহজনক নথি, হার্ড ডিস্ক এবং কয়েকটি মোবাইল।
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ এই মামলার তদন্ত করছে। শাহিনের অ্যাকাডেমিক রেকর্ড থেকে সমাজ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট এবং বিদেশি যোগ সব কিছু নিয়ে খোঁজ খবর চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, মূলত সমাজমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি হ্যান্ডলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন শাহিন।
দিল্লি বিস্ফোরণের নেপথ্যে উমর উন নবিকে অপর এক চিকিৎসককে মূল সন্দেহভাজন বলে মনে করা হচ্ছে। বিস্ফোরণের জেরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। তদন্তের স্বার্থে লালকেল্লা এবং তার আশপাশের অনেক জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি ফুটেজ ঘিরেই রহস্য দানা বেঁধেছে। ফুটেজে একটি গাড়ি দেখা গেছে, তাতেই বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের কিছু ক্ষণ আগেও তাঁকে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। উমরের সঙ্গে নাকি যোগাযোগ ছিল ধৃত আদিল মাজিদ রাথর, মুজাম্মিল আহমেদের। জেরায় শাহিন জানিয়েছেন বলে দাবি তদন্তকারী সূত্রের। শুধু তাঁদের সঙ্গে নয়, শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল উমরের।
শাহিন, উমর, আদিল এবং মুজাম্মিল চার জনই পেশায় চিকিৎসক। তাঁদের যোগসূত্র গড়ে ওঠে ফরিদাবাদের আল-ফালাহ মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে। সূত্রে দাবি, শাহিন জেরায় জানিয়েছেন, হাসপাতালের কাজ শেষে প্রায়ই উমরের সঙ্গে দেখা হত তাঁর। যখনই দেখা হত উমর নাকি ‘দেশে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটানোর’ কথা বলতেন।একটি সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, গত দু’বছর ধরে নাকি বিস্ফোরণ বা বিস্ফোরণের মালমশলা সংগ্রহের কাজ চলছিল।
শাহিনের দাবি, আদিল এবং মুজাম্মিলের সঙ্গে মিলে উমর অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জাতীয় বিস্ফোরক জোগাড় করছিলেন। সেই বিস্ফোরক দিল্লির বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী আধিকারিকরা। সূত্রের দাবি, গাড়িতে বিস্ফোরণের পরেই কমলা রঙের আগুন দেখা গিয়েছে। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, সাধারণত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণ ঘটলে এই ধরনের আগুন দেখা যায়। প্রশ্ন উঠছে, ফরিদাবাদে সোমবার মুজাম্মিলের বাড়ি থেকে যে ৩৬০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উদ্ধার হয়েছে, তার সঙ্গে কি যোগ রয়েছে দিল্লি বিস্ফোরণের?
গত ১৯ অক্টোবর শ্রীনগরে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার পড়েছিল। পোস্টার লাগানোর অভিযোগে আদিল নামে এক চিকিৎসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে জেরা করে উঠে আসে নানা তথ্য। তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। তদন্তকারী সূত্রের দাবি, কাশ্মীরে নাশকতার উদ্দেশে যে বিশেষ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে, তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে নাশকতার ছক কষত। এই চক্রের তদন্তে বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করেছে কাশ্মীর পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, আদিলকে জেরা করেই উঠে আসে মুজাম্মিলের নাম। তদন্তকারীদের এক সূত্রের দাবি, আদিল, মুজাম্মিল এবং শাহিনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন উমর। শাহিনকে জেরা করে উঠে এসেছে পারভেজ সইদের নাম। পারভেজ সম্পর্কে শাহিনের ভাই। পারভেজের সঙ্গে আদিলের যোগাযোগ ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। পুরো ঘটনার সঙ্গে জইশের যোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টি এখনও তদন্তের আওতায়।
Advertisement



