• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আইসক্রিম ও বুম্বার অভিযান

ছোটোদের ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

সুতপন চট্টোপাধ্যায়

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

Advertisement

সহেলীর বাবা সমীরবাবু অনেকবার ফোন করলেন। কেউ ফোন তুলল না। হতাশ হয়ে ফিরে এলেন সমীরবাবু। তিনি ফিরে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন এলো দেরাদুন থেকে। সমীরবাবু ফোনটি ধরেই তাঁর পরিচিতকে সবিস্তারে বলে দিলেন। ওদিক থেকে উত্তর শুনে সমীরবাবুর মুখটা কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অতনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ও বলল, স্টেশনমাস্টার তার চেনা, ওদের বাড়ির কাছেই রেলের কোয়াটার্সে থাকেন, তিনি সবরকম ব্যবস্থা নেবেন। ওঁর নজর এড়িয়ে বের হওয়া সম্ভব নয়। তার উপর রেল পুলিশকে সতর্ক করা হবে। ওদিকে গেলেও সে ঠিক ধরা পড়ে যাবে।

Advertisement

মেন্টির মা বলল, আর পাঞ্জাবের দিকে যদি চলে যায়? তাহলে? সেদিকে কি কেউ আছে?
সমীরবাবু বললেন, নন্দিনী ম্যাডামকে বলুন, নিউদিল্লির স্টেশনমাস্টারকে দিয়ে কিছু একটা করাতে পারেন কি না?

নন্দিনীকে দেখে স্টেশনমাস্টার বললেন, কী, কোনও খবর পেলেন?
—আমরা একটা খবর পেয়েছি। পূর্বা এক্সপ্রেসে নাকি তাকে দেখেছে একজন। আমাদের ফোন করে বলেছে।
তিনি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনাদের ফোন নাম্বার সেই লোকটা কোথায় পেয়েছে?
—আমার ছেলের কাছে।
—তাতে পূর্বা এক্সপ্রেস বুঝলেন কীকরে?
—লোকটা বলেছে।
স্টেশনমাস্টার বললেন, ওসব কথায় বিশ্বাস করবেন না। যারা কিডন্যাপার তাদের এইসব ট্রিক। নিয়ে যাচ্ছে হয়ত জম্মু, বলছে পূর্বা এক্সপ্রেস। ঠিক উলটো দিক। আপনারা দক্ষিণ দিকে ব্যস্ত থাকবেন, আর ওরা উত্তরে চলে যাবে। যাতে ওরা অনেকটা হাতে সময় পায়। আমার এই দেখে দেখে চুল পেকে গেল। একটা চুলও কাঁচা নেই।
—তাহলে আপনি কী বলেন?
—কিছুই না। জানে না মেরে দিলে একদিন না একদিন পাবেন। জ্যান্ত বা পাগল সে আমি বলতে পারছি না। তবে বাচ্চা তো, আপনাদের কাছ থেকে টাকা চাইতে পারে, খুন করে দেবার হুমকি দিতে পারে। লাখ দশেক নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
—লাখ দশ?
—দশ লাখ আবার টাকা হল নাকি? আমি কম করে বললাম। ওরা খুব খতরনাক। এর নিচে রাজি হয় না।
নন্দিনীর মুখে কথা সরছে না। কিছুই মাথায় আসছে না। তবু সে বলল, আপনি এলাহাবাদের স্টেশনমাস্টারকে বলে দিন না স্যার, যদি ওই ট্রেন থামিয়ে ছেলেকে নামিয়ে নিতে পারেন। বলে হাত জোড় করল।
—এভাবে হয় না। সিআরপিএফ আর রেল এক নয়। তবু আপনি যখন বলছেন চেষ্টা করে দেখছি। কিন্তু উনি নেবেন কোন অধিকারে?
—আপনার অনুরোধে!
—এভাবে হয় না ম্যাডাম। বলে সরাসরি তাকান তিনি।
—আর একটা কথা। স্যার, আপনি চণ্ডীগড়, জম্মু ও ভোপাল স্টেশনেও খবর দিন। তবে কেউ কিন্তু টাকা চেয়ে এখনও ফোন করেনি।
—করেনি বলেই যে করবে না, সেটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ওরা অনেক সময় কিছুটা সময় পরিস্থিতি অবজার্ভ করে। তারপর অ্যাকশন নেয়।
কথাটা শুনে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল নন্দিনীর।

 

১০
আবার ফোন এল চন্দ্রিমার। আমরা ভোরে হাওড়া চলে যাব। তোমরা চিন্তা করো না। কিন্তু আগে যেভাবে হোক খোঁজ নাও ওই ট্রেনে বুম্বা আছে কি না? এমনও তো হতে পারে কোনও বদমাইশ লোক চালাকি করে এমন খবর দিয়েছে?
অতনু বলল, প্রায় সবাই সেই সন্দেহ করছে। কিন্তু কী করার আছে?
—তাছাড়া আমরা তো সবাই এতক্ষণ ট্রেনের কথা ভাবছি। কিন্তু ওকে তো কেউ গাড়িতে লোভ দেখিয়ে তুলে নিতে পারে। ওকে যদি গাড়ি করে কোথাও নিয়ে যায়? তাহলে? চন্দ্রিমার গলায় প্রবল উৎকন্ঠা।

এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। সব কিছুরই সম্ভবনা। সত্যি তো? কেউ এই ব্যাপারটা ভাবিনি এতক্ষণ। সে ক্ষেত্রে কী করার আছে? মেন্টির বাবা অফিসের পর অনেকগুলো কোম্পানির সেলসট্যাক্সের কাজ করে। প্রতিদিনই রাত করে বাড়ি ফেরে। বাড়ির সামনে লোকজন দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল। প্রশ্ন করল, কী হয়েছে? একজন তাকে বিস্তারিত বললে, সে একটা সিগারেট ধরিয়ে গভীরভাবে ভাবল। তারপর বলল, এই সব কেসে, স্পট থেকে তুলে গাড়ি করে পালিয়ে যাওয়া খুব সহজ ও প্র্যাক্টিক্যাল। গাড়ির ভিতরে বাচ্চাকে বসিয়ে, কিছু খাবার খেতে দিয়ে ভুলিয়ে বর্ডার ক্রস করতে পারলে আর কে ধরে? যেদিকে যাবে, সেদিকেই অন্য রাজ্য। কাছেই হরিয়ানা, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমে রাজস্থান ঘেরা এই রাজ্য। একবার বর্ডার পেরিয়ে গেলে ধরাই অসাধ্য। তাছাড়া বর্ডারের তেমন কড়াকড়ি নেই। কেউ টাকা চেয়ে ফোন করেছে নাকি?
একজন বলল, না।
মেন্টির বাবা বলল, তাহলে আর কিছু করার নেই। ঠিক গাড়ি করেই নিয়ে গেছে তাকে। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইটস টু লেট।
মেন্টির বাবা আবার জানতে চাইল, পূর্বা কি ঠিক টাইমে রান করছে?
সেটাও কারোর খেয়াল ছিল না। কে যেন ফোন করে জানাল খুব বেশি নয়, দশ মিনিট লেট।
মেন্টির বাবা আবার অতনুকে প্রশ্ন করল, গড ফরবিড। যদি দেখেন, ওই ট্রেনে আপনার ছেলে নেই। খবরটা ফলস্। তখন কী করবেন? সেটাও প্ল্যান বি হিসেবে করে রাখুন এই ফাঁকে।

অতনু হতচকিত হয়ে তাকেই জিজ্ঞেসা করল, কী করা যায়, কিছুই মাথায় আসছে না। আপনার কী মনে হয়?
তিনি বিজ্ঞের গলায় বললেন, কিছুই করার নেই, ওই থানার উপর ভরসা করা ছাড়া।

কী মনে করে এটাওয়ার লোককে ফোনে ধরল গোয়েল। এতক্ষণে সে হয়ত বাড়ি পৌঁছে গেছে। গোয়েল ভেবেছিল তাকে আর একবার জিজ্ঞেস করবে। কোন অসঙ্গতি পেলে বুঝে নিতে পারবে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ।

রাত সাড়ে বারোটার সময় থেকে ভোর সাড়ে চারটে, আবাসনের মধ্যে দু’জন পাহারাদার টহল দেয়। তাদের কাজ প্রধানত পার্কের ভিতর ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা চোরদের ধরা। এখানে অনেক ফ্ল্যাটে প্রবীণ নাগরিক থাকেন। একলা বা বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে। রাতের অন্ধকারে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে চুরি করার সম্ভাবনা কেউই উড়িয়ে দিতে পারে না। যদিও তেমন ঘটনা রাতে হয়নি এখনও। দিনের বেলা হয়েছে। সে অন্য কথা। আবাসনের পাঁচিলটাও খুব উঁচু নয়। আবাসনের উত্তরে পাঁচিলের পিছনে একটা ছোট জঙ্গল আছে। সেখানে তলদা বাঁশ, আম, জামরুল, পেয়ারা ও অনেক গাছে ভর্তি। সন্ধ্যেবেলা পাখির কিচির মিচির ডাক। অনেক বছর আগে এই জঙ্গলের একদিক কেটেই তৈরি হয়েছিল এই আবাসন। জঙ্গলের পরই একটি ইস্কুল। নগর পরিকল্পনার ভারসাম্য ছিল। সে কথা সবার জানা। ফ্ল্যাটের সামনে এত রাতে লোকজন দেখে পাহারাদার মান সিং জিজ্ঞেস করল, কী হল? রাতে আপনারা এখানে কী করছেন? মেন্টির বাবার কাছে বিশদ শুনে মান সিং দু’মিনিট কী যেন চিন্তা করল। তার পর বলল, আপনারা ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছেন?
অতনু বলল, বলেছি। ইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে।
মান সিং বলল, ইস্কুলের নয়। পাড়া-
প্রতিবেশী, বন্ধুদের কথা বলছি।
মেন্টির বাবা প্রশ্ন করল, কেন বল তো মান সিং?
মান সিং বলল, পাঁচিলের পিছনের জঙ্গলে এই সময় পেয়ারা গাছে প্রচুর পেয়ারা পেকেছে। আমি একদিন গিয়েছিলাম। দেখেছি। পেয়ারার লোভে বন্ধুদের সঙ্গে পেয়ারা খেতে যায়নি তো?
গেলেও এতক্ষণ সেখানে কী করবে? এত রাতে?
এতক্ষণে মায়ের মুখে শব্দ, ও পেয়ারা খেতে খুব ভালোবাসে।

মান সিং বলল, ওই দেখুন স্যার। আপনারা নিজেদের হিসেব মত ভাবছেন আর কাজ করে যাচ্ছেন। তার দিকটা একবার ভাবেননি। ভাবলে এতক্ষণে তাকে পেয়ে যেতেন। ও নিশ্চয় পেয়ারা খেয়ে ওখনেই কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আপনারা বাড়ির কাছ ছেড়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বেড়াচ্ছেন। একজন আসুন আমার সঙ্গে। দেখি, জঙ্গলে খুঁজে দেখি।

কে যাবে মান সিংয়ের সঙ্গে এই রাতে? সবাই অধীর অপেক্ষায়। মান সিং এবার বলল, বুঝতে পারছি আপনারা যেতে চাইছেন না। আমি একা যাব না। কী হতে কী হয়। রাতের বেলা। আমি গেটের একটা দারোয়ানকে নিয়ে যাব, যদি হুকুম করেন।

মেন্টির বাবা বলল, ঠিক আছে ওদের কাউকে নিয়ে যাও। আমি কাল সেক্রেটারিকে বলে দেব।

(ক্রমশ)

Advertisement