ঘড়ির কাঁটা তখন ছুঁয়েছে বারোর ঘর। মধ্যরাতেই সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়ল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। আরব সাগরের পারে সৃষ্টি হল নতুন ইতিহাস। বিশ্বকাপ এলো ভারতের হাতে। ভারতের মেয়েরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে জিতে নিল মহিলা ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ। খেলার সাফল্যটাই বড় কথা। ছেলে বা মেয়ে হিসাবে বিভাজন নয়। হরমনপ্রীত, স্মৃতি, শেফালি, দীপ্তি, রিচারা দেখিয়ে গেলেন সাফল্য দলের, ব্যক্তির নয়। ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজরা একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন স্মৃতি-হরমনপ্রীতরা।
রবিবার মুম্বইয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল দু’ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টির কারণে। দর্শক পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেট হারিয়ে ভারত তোলে ২৯৮ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৪৬ রানে আটকে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ৫২ রানে জিতে ভারতকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এনে দিলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীত কাউর। কপিল দেব, রোহিত শর্মা, মহেন্দ্র সিং ধোনির মতোই আন্তর্জাতিক সম্মান প্রাপ্তিতে নেতৃত্ব দিলেন হরমনপ্রীত। এর আগে তিন-তিনবার লড়াই করে ‘ফিনিশিং লাইনের’ কাছে এসেও অধরা থেকে গেছে বিশ্বকাপ। এবার আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মহিলা ব্রিগেড অধরা মাধুরীর স্বাদ এনে দিলেন ব্যাটে-বলে স্মরণী ইনিংস উপহার দিয়ে।
Advertisement
টসে জিতে ভারতকে ব্যাট করতে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তাঁরা জানত, হরমনপ্রীতরা রান তাড়া করতে ওস্তাদ। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। অধিনায়ক লরা উলভার্ট ভারতকে ব্যাট করতে পাঠায়। ব্যাট করতে নেমে দুরন্ত শুরু করে ভারতের দুই ওপেনার। বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ে কিছুটা ধীর লয়ে ইনিংস শুরু করেছিলেন স্মৃতি। তবে অপর প্রান্তে প্রথম থেকেই বিধ্বংসী ছিলেন শেফালি। দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও বোলারকেই পাত্তা দিলেন না। আয়াবঙ্গা খাকাকে স্কোয়ারকাট মেরে চার দিয়ে ইনিংস শুরু করেছিলেন, যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন সেই খেলাই চালালেন ২১ বছরের ভারতীয় ওপেনার।
Advertisement
দল থেকে বাদ পড়ার পর প্রতীকা রাওয়ালের চোটে হঠাৎ সুযোগ আসে শেফালির সামনে সেমিফাইনাল খেলায়। সেই ম্যাচে শুরুটা ভালো করেও দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয়েছিল। ফাইনালে সুযোগ পাওয়াটা কাজে লাগালেন। নিয়মিত রান রোটেট করলেন দু’জনে। ১৮ ওভারেই দুই ওপেনারের দৌলতে দলের শতরান পার হয়ে যায় স্কোরবোর্ডে। দলের ১০৪ রানের মাথায় ফেরেন স্মৃতি। হাতছাড়া হল চলতি বিশ্বকাপের তৃতীয় অর্ধশতরান। ফাইনালের মঞ্চে ৪৯ রান এলো ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়কের ব্যাট থেকে। প্রতিযোগিতায় করলেন মোট ৪৩৪ রান, যা বিশ্বকাপে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক। ছাপিয়ে গেলেন প্রাক্তন অধিনায়ক মিতালি রাজকে (৪০৯)। এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বাধিক রানের অধিকারী হলেন স্মৃতি। তাঁর আগে থাকলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক লরা উলভার্ট (৫৭১)।
স্মৃতি আউট হয়ে গেলেও আক্রমণ থামাননি শেফালি। জেমাইমা রড্রিগেজের সঙ্গে জুটি বেঁ্ধে দলের স্কোরবোর্ড সচল রাখলেন। একদিনের ক্রিকেটে পঞ্চম অর্ধশতরান পূর্ণ করলেন শেফালি। মধ্যে ক্যাচ পড়ে জীবনদান পাওয়া ছাড়া ঝকঝকে ইনিংস। এই শেফালিই গত তিন বছরে একদিনের ক্রিকেটে একটাও পঞ্চাশ পাননি। অর্ধ শতরানের পর পেশিতে টান ধরায় কিছুটা সমস্যায় পড়েন তিনি। দৌলতে সমস্যা হচ্ছিল। ফলে চার-ছয়ের দিকে ঝুঁকলেন। তাই তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই ফিরতে হলো। সামান্য কয়েকটা রানের জন্য শতরান হাতছাড়া হওয়ার আক্ষেপ তাঁর থেকে যাবে। ৭৮ বলে ৮৭ রানের ইনিংসটা যে খেলে গেলেন, সেটা রীতিমতো বাঁধিয়ে রাখার মতো।
তবে, মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের সর্বাধিক রান এলো শেফালির ব্যাট থেকে। তাঁর ৮৭ রানের ইনিংস ভেঙে দিল পুনম রাউতের ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ৮৬ রানের রেকর্ড। ফাইনালে গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের আইকন শচীন তেণ্ডুলকর। নিজের আদর্শকে সামনে দেখেই কি জ্বলে উঠলেন শেফালি? শেফালির কথায়, ‘মাঠে শচীন স্যারকে দেখতে পেয়েই আমার আত্মবিশ্বাস ও মনোবল অনেকটাই বেড়ে যায়। আমি কোনও সমস্যা থাকলে শচীন স্যারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে আত্মবিশ্বাস জোগান। শুধু আমি নই, আমরা সবাই ওনাকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।’ শচীনের সামনেই অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও। প্রথমে ৭৮ বলে ৮৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলার পর বোলিংয়ে নিজের প্রথম দু’ওভারেই ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বদলে দিলেন শেফালি।
আরেকটি মেয়ে রিচা ঘোষ। উইকেটের পেছনে শুধু গ্লাভস হাতে নয়, ফাইনালে তাঁর ২৪ বলে ৩৪ রানের ইনিংসে মারা দু’টি ছয়ের জন্য দিয়েন্দ্রা ডর্টিন ও লিজেল লি-র রেকর্ডকে স্পর্শ করলেন। ডর্টিন ওলি দু’জনেই ১২টি ছয় মেরেছিলেন। রিচাও এই বিশ্বকাপে ১২টি ছয় মেরেছেন। রিচার পাওয়ার হিটিং গোটা প্রতিযোগিতা জুড়ে ভারতীয় দলের ভরসার জায়গা ছিল। খেলার শেষে এক সাক্ষাৎকারে রিচা বলেন, ‘সবাই আমরা আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েছি বিশ্বকাপ জেতার পর। তবে আমরা জীবন বাজি রেখে মাঠে নেমেছিলাম। প্রত্যাশার চাপ তো ছিলই। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ফাইনালে দর্শক পরিপূর্ণ ছিল স্টেডিয়াম। চাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে যতটা সম্ভব শান্ত থেকে নিজের খেলাটা খেলে গেছি।’
ফাইনালে ম্যাচের সেরা হলেন শেফালি বর্মা। আর প্রতিযোগিতার সেরা হলেন দীপ্তি শর্মা। শেফালি তো দল থেকে বাদই পড়েছিলেন। প্রতীকা চোট না পেলে তিনি সুযোগই পেতেন না। দু’বারের ফাইনালে হারের কষ্টটা ভুলিয়ে দিতে এবারের জয়টা খুবই দরকার ছিল। খেলোয়াড়দের চোখে এবারও ছিল জল, তবে তা বিজয়ের।
Advertisement



