সুতপন চট্টোপাধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
Advertisement
বিমল বলল, শর্মা স্যার আজ রাতে দূরে এক বিয়ে বাড়িতে গেছে। ফোনে কানেক্ট করা যাচ্ছে না।
ওদিকে ট্রেন কানপুরের অভিমুখে প্রবল বেগে ছু্টে যাচ্ছে। না নন্দিনী পাচ্ছে কোনও উত্তর, না বিমল ধরতে পারছে শর্মা স্যারের হদিস। হু-হু করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কী করা যাবে? একসময় নন্দিনী বলল, আমি স্টেশনে চলে যাই। দেখি কানপুরের স্টেশনমাস্টারকে, বুম্বাকে নামিয়ে নিতে রাজি করানো যায় কি না।
অতনু বলল, যেতে যেতে কানপুর পেরিয়ে যাবে।
দেখি না, যদি রাস্তায় লেট করে, বলে সে পবনকে ডাকল।
Advertisement
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আবাসনের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। অফিস থেকে ফিরে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষের ভিড় জমেছে ফ্ল্যাটের সামনে। চারিদিকে উৎকন্ঠিত মুখ। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা করছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কীভাবে বুম্বা গেল, ট্রেন ধরল, কলকাতার ট্রেন না ধরে অন্য ট্রেন ধরলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে যেত! তার মধ্যে আবাসনের মিস্টার মাথুর বলল, যে লোকটা খবর দিয়েছে, নাম বলেছে তাঁর পরিচয়টা রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে একবার যাচাই করা উচিত। ফ্রডও হতে পারে। অন্য কিছু করার নামে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য হয়ত করছে। কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে। একেবারেই মাথায় আসেনি। গোয়েল বলল, চিন্তা করি, দেখি আমি কী করতে পারি। আমার রাষ্ট্রপতি ভবনে একজন চেনা আছে। দেখি, তাকে ধরতে পারি কি না। বলে সে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে গেল ফোন করতে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, না, নম্বর নট রিচেবেল আসছে।
অতনু নন্দিনীকে বলল, তুমি পারলে একবার রাষ্ট্রপতি ভবনে জেনে আসবে নাকি? বীর শর্মা বলে কেউ আছে কি না?
নন্দিনী রেগে গেল, বলল, একজনের পিছনে ছুটছি, আবার অন্য জনের খোঁজ নিতে পারব না। অন্য কিছু ব্যবস্থা করো, বলে বেরিয়ে গেল।
গোয়েল চেষ্টা করেছিল, রাতের বেলায় রাষ্ট্রপতি ভবনের রান্নঘরে পৌঁছনো গেল না। জানা গেল না লোকটার পরিচয়। কিন্তু মাথুর সাহেবের কথাটা মাথার মধ্যে প্রবলভাবে ঘুরপাক খেতে লাগল। লোকটা কি জেনুইন? সে কি ঠিক পূর্বা এক্সপ্রেস থেকেই বলেছে? ইটাওয়া কি তার বাড়ি, সত্যি বলেছে? নাকি অন্য কোনও জায়গা থেকে কথা বলেছে? যে নম্বরটা রেল পুলিশের বলে দিয়েছিল, সেটা আদৌ রেল পুলিশের নয়! কোনও লোকের নম্বর? সন্দেহ অমূলক নয়। যখন ওই নম্বরে দ্বিতীয় বার ফোন করেছিল অতনু, তখন একজন আমতা আমতা করে বলল, ঠিক হ্যায়। হাম লোগ দেখ লেঙ্গে। আপ ফিকর মাত করো। ট্রেনমে দেখনে দিজিয়ে, বাচ্চা হ্যায় কি নেহি। বাদ মে বাতাউঙ্গা।
অতনু তাকে অনুনয়ের গলায় বলেছিল, আমরা তাকে কানপুর স্টেশনে নামিয়ে নেবার জন্য লোক পাঠাচ্ছি, আপনাদের হেল্প চাই ভাইসাব।
লোকটা গলাটা বদলে মিনমিনে স্বরে বলেছিল, হান্জি।
এর মধ্যে আবার মেন্টির মা এসে হাজির। শুনে বলল, খবর যখন এসেছে, দেখি আমাদের পার্টি অফিসে কথা বলে। তাঁর পরেই খেয়াল হল এখন তো রাত্রিবেলা। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। তাই হতাশ হয়ে বলল, ট্রেনকে যেতে দিন। কাল সকালে কিছু না কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। বলে বাড়ি চলে গেল।
চন্দ্রিমার ফোন এল। অতনু সংক্ষেপে বলে কেটে দিল। যে কোনও মুহূর্তে খবর আসতে পারে। ফোনটা ফ্রি রাখতে হবে। অতনু আর গোয়েল বসে আছে। বিমল ও নন্দিনীর ফোনের আশায়। কোনও দিক থেকে কোনও ফোন এল না। বসে বসে সময়ের ওপর চোখ রেখে বুঝতে পারছিল, ট্রেনটা ঠিক এগারোটায় কানপুর স্টেশনে ঢুকল। থামল। অতনু ফোন করল আরপিএফকে। বেজে গেল। কেউ ধরল না। ট্রেনটা খুব কম সময় দাঁড়াল। লোকে লোকারণ্য। কিছু লোক নামল। কিছু উঠল। তারপর ট্রেন ছেড়ে দিল এলাহাবাদের উদ্দেশে।
গোয়েল ছটফট করে উঠল। শেষ চেষ্টা করতে হবে এলাহাবাদে।
এমনও তো হতে পারে, ট্রেনটা থামল কানপুরে আর ঘুমন্ত বুম্বাকে কেউ কাঁধে ফেলে নেমে গেল? রেল পুলিশকে কামরায় কামরায় ডিউটি করতে দেখেছে। তারা কি সবসময় নিজেদের কামরায় থাকে? অনেক সময় কুকুর নিয়ে কামরা থেকে কামরায় ঘুরে বেড়ায়। সেই ফাঁকে? এই সব এলোমেলো কথা মনে আসতে লাগল অতনুর।
ঠিক এমন সময় নন্দিনীর ফোন এল। স্টেশনমাস্টারকে পায়নি। বসে আছে সেখানে।
কাউকেই পাঠানো গেল না কানপুরে। ইন্সপেক্টরকে ফোন করেও কোনও উত্তর নেই। কোথাও কি কোনও ষড়ষন্ত্র হচ্ছে? বুম্বাকে অন্য কোনও ট্রেনে নিয়ে গেছে কোনও দল। এটা কি সাজানো নাটক? পূর্বা এক্সপ্রেসের গল্পটা বানানো? আর সেই সময়ের মধ্যেই তাকে নিয়ে তারা এমন কোনও এক অজ্ঞাত জায়গায় চলে যাবে যে, কেউ টেরই পাবে না। জানতে পারবে না। আমরা পূর্বা এক্সপ্রেসের রুট ধরে খুঁজবো, ব্যাস্ত থাকব, আর তারা হয়ত পাঞ্জাব, কিম্বা হিমাচল প্রদেশের কিংবা বম্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরে গায়েব করে দেবে। অতনুর মাথার মধ্যে এই অমঙ্গলের সূত্রটা ঘুরে ঘুরে পাকিয়ে যাচ্ছে।
মাকে এবার যেন না পেরেই বলে বসল অতনু, কতদিন তোমায় বলেছি, হাতে কাঁচা টাকা দিও না। কিছুতেই শুনলে না। আইসস্ক্রিম দিতে হলে আমাকে, নন্দিনীকে বলতে পারতে। এনে দিতাম। দেখলে তো কী হল? কী করি বলো তো?
মা মুখ নিচু করে বসে আছে। বিড়বিড় করে বলল, আমি কি জানি এই হবে?
গোয়েল সতর্ক করল, এখন এই সব কথার কোনও মানেই হয় না। নার্ভ ঠিক রাখো। ভেঙে পড়লে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রাখো। পরিস্থিতির ওপর চোখ রাখতে হবে। যে কোনো সময় পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। এখনো কিছুই পরিষ্কার নয়।
বাড়ির সামনে মাঝেমাঝেই জনসমাগম হচ্ছে, আবার হালকা হয়ে যাচ্ছে। সকলের মুখে একই প্রশ্ন, খবর এসেছে কি না। এসেছে, এই শুনে উপরের তলার সহেলীর মা বলল, এবার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। আর চিন্তার কোনও কারণ নেই। মেন্টির মা পাশেই ছিল, বলল, কী বলছেন দিদি, এটা তো উড়ো খবর। আসলে তো কেউই দেখেনি। যে লোকটা খবর করেছে, সে সত্য কথা বলেছে তার কী গ্যারান্টি?
৯
সহেলীর মা বলল, হ্যাঁ, সেটাও সত্যি। আমরা সবাই একটা উড়ো খবরের উপর কথা বলছি। তারপর অতনুকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা রাস্কিন বন্ড খুব পড়তো, সহেলীকেও বলেছিল। আপনারাও দেখা করে এসেছিলেন একবার শুনেছি। তার কাছে মুসৌরি চলে যায়নি তো?
মাথার চিন্তা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেল। সত্যিই তো, তাও হতে পারে। হয়ত কিছু মনে প্রশ্ন জেগেছে। হয়ত ভেবেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র রাস্কিনই দিতে পারে। সেই কারণে মুসৌরির দিকে চলে গেছে সে। হয় নৈনিতালের ট্রেনের উঠেছে, না হয় বাস ধরে হলদুয়ানি হয়ে দেরাদুন। দেরাদুন থেকে মুসৌরি। কী করা যায়? গোয়েল বলল, আমার ওই দিকে কেউ জানা নেই। আর কারোর জানা থাকলেও সে সকালের আগে হবে না। সারারাত অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক এমন সময় সহেলীর বাবা বললেন, আমার এক বন্ধু দেরাদুনে একটা কলেজে পড়ায়। তাকে একবার রাতে তুলে বলি, সে যেন স্টেশনমাস্টারকে বলে রাখে।
অতনু বলল, পারলে প্লিজ দাদা। রাস্কিন বন্ডের বাড়িতে যদি কেউ গিয়ে দেখে আসতে পারে তো খুব ভালো হয়। সহেলীর বাবা বললেন, দেখছি। বলে চলে গেলেন।
আবার সেইখানে। আগের অবস্থায়। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, প্রেশার বেড়ে গেছে অনেক আগে। শরীর ঝিমঝিম করছে অতনুর। একদিকে ট্রেন প্রবল গতিতে এলাহাবাদের দিকে ছুটে চলেছে। আর স্থির, বাকরুদ্ধ অবস্থায় সবাই আরাত্রিকা আবাসনে।
(ক্রমশ)
Advertisement



