তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪.
চিত্রজিৎ
Advertisement
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
Advertisement
একটা আগুনের গোলা হয়ে ঘরের কোণে দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে অলমিতি৷ তার মুখ উপরে ছাদের দিকে৷ দুই হাত উপরে ছাদ লক্ষ্য করে তোলা৷ দুই চোখ বোজা৷ তার সমস্ত শরীর থেকে সোনা ঠিকরোচ্ছে৷ ঘরের ঠিক মধ্যিখানে ইজেল বসিয়ে ক্যানভাসের মধ্যে আঁকছে চিত্রজিৎ৷ আজ নিয়ে তৃতীয়দিন অলমিতির ছবি আঁকছে৷ এ পর্যন্ত পনেরোটা ছবি আঁকা হয়েছে, আরও পাঁচটা বাকি৷
ছবিগুলির পটভূমি এক আদিম পৃথিবীর৷ যখন জঙ্গলে–জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত ইভ৷ চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ৷ কত রকমের শেড সেই সবুজের৷ অরণ্যের প্রায় সব বৃক্ষের পাতার রং আলাদা–আলাদা৷ কোনওটা ঘন সবুজ, কোনওটা হালকা সবুজ, কোনওটা কৃষ্ণসবুজ, কোনওটা হরিদ্বর্ণ, কোনওটা শ্যামলিমা, কোনওটা জলপাই সবুজ, কোনওটা পান্না–সবুজ, কোনওটা কচিকলাপাতা রং৷
এমন বর্ণময় পটভূমিতে ইভের অভিব্যক্তি সরল, সুন্দর, একরৈখিক৷ তার কোনও নিভৃতি নেই, সংবৃতি নেই, গোপনীয়তা নেই৷ সব ছবিই স্বাভাবিক, অতিস্বাভাবিক৷
যে–ছবিগুলো এঁকেছে, সেগুলো যে আঁকা শেষ তা অবশ্য নয়৷ সব ছবিই ঘরের মধ্যে বসে আঁকা, কিন্তু প্রতিটি ছবি যেমন নানা ভঙ্গিমায় আঁকা, তেমনই প্রত্যেকটির পটভূমিও আলাদা৷ যেন ছবিগুলো আঁকা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে, সেখানে এক নারীকে নিয়ে গিয়ে ভিন্ন ভঙ্গিমায় শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে এক–একটি ছবি৷
ছবিগুলো পাশাপাশি রাখা হয়েছে সারা ঘর জুড়ে৷ মুখাবয়ব ছাড়া বাকি শরীরে তুলি বুলানো শেষ, কোনও ছবিরই মুখ আঁকেনি চিত্রজিৎ কারণ অলমিতির মুখ আঁকা যাবে না, আঁকতে হবে অন্য কারও৷ সেই মুখ কার হবে তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি চিত্রজিৎ৷
এখন যে–ছবিটা আঁকছে তার পটভূমি ঘন অরণ্যানী, সেখানে এক নারী সোনালি ঘাড় উঁচু করে, দুই পেলব বাহু আকাশের দিকে তুলে, দুই চোখ নিমীলিত করে কী যেন প্রার্থনা জানাচ্ছে অন্তরীক্ষের উদ্দেশে৷ চিত্রজিৎ এক–একবার তুলি প্যালেটে ডুবিয়ে, নির্ধারিত রং মাখিয়ে মনঃসংযোগ করছে ক্যানভাসের উপর৷
ঠিক আগের আঁকা ছবিটা রয়েছে তার পাশেই৷ তার পটভূমি একটি পর্ণকুটির, তার মধ্যে এক নারী শায়িত ভঙ্গিমায়৷ যেন সে অপেক্ষা করছে কারও জন্য৷ কিংবা হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছে না৷ পর্ণকুটিরটি এক নির্জন পটভূমিতে৷ সামনে একটি মেটেপথ৷ পথটা পর্ণকুটিরের সামনে দিয়ে এঁকেঁবেঁকে মিলিয়ে গেছে কোথায় না কোথায় পর্ণকুটিরের পিছনে সবুজ বনভূমি৷ অসংখ্য ঝাউগাছ মাথা উঁচু করে ছুঁতে চাইছে নীল আকাশ৷
চিত্রজিৎ এক–একবার নজর ফেলছে অলমিতির দিকে, আর তুলি বোলাচ্ছে ছবিটিকে নিখুঁত করে তুলতে৷ কখনও চোখ ফেলছে সারা মেঝে জুড়ে রাখা অন্য ছবিগুলোর দিকে৷
প্রথম ছবিটাই এক নীল সমুদ্রের, সেখান থেকে স্নান করে উঠে এসেছে এক নারী৷ অতিসুন্দর তার শরীর৷ ভারী পবিত্র তার অভিব্যক্তি৷ হেঁটে আসছে সোনালি বালির বিচের উপর দিয়ে৷ পিছনে সমুদ্রের জল ভাঙছে সাদা ফেনার ব্রেকার হয়ে৷ ব্রেকারগুলো আঁকাবাঁকা ছবি আঁকছে সোনালি বালির উপর৷ সৈকতে ছড়িয়ে আছে নানা আকারের নুড়িপাথর৷
দ্বিতীয় ছবিটা এক সুউচ্চ পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা ঝরনার ধারা৷ সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে জলধারা আছড়ে পড়ছে নীচের পাথরের চাতালের উপর৷ সেই জলধারার নীচে দাঁড়িয়ে এক স্নানবিলাসিনী নারী৷ তার সারা শরীরে জল চলকে পড়ে ছিটকোচ্ছে চারদিকে৷ ঝরনার দুপাশে পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনানী৷ পাহাড়ের উপরে উঁকি দিচ্ছে ঘন নীল আকাশের টুকরো৷
চিত্রজিতের ঘরের দরজা বন্ধ৷ অলমিতি এলেই দরজাটা বন্ধ করে দেয় চিত্রজিৎ৷ তবু পাশের ঘর থেকে হঠাৎ ভেসে এল সুরঞ্জনার গান৷ চিত্রজিৎ বিস্মিত হল৷ এই মুহূর্তে ঠিক এই গানটাই গাইছে সুরঞ্জনা ঠিক এরকম একটা গানের কথাই তো সে ভাবছিল:
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে৷৷
আগুনরঙের অলমিতির শরীরের তাপ টের পাচ্ছে চিত্রজিৎ৷ রবীন্দ্রনাথ কি এরকমই একটা মুহূর্তের কথা ভেবে লিখেছিলেন এই গানটা আগুনের পরশমণির স্পর্শে জীবন পুণ্য হোক— এই কলিদুটি এমনটাই বলছে কারও উদ্দেশে৷ মানুষের শরীর একটা মন্দির৷ সেই মন্দিরে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে হয় মানুষকে৷ স্তুতি করতে হয় সেই মন্দিরকে৷ বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করছে চিত্রজিৎ আর ইজেলের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছে রেখার পর রেখা৷ তুলি দিয়ে, ব্রাশ দিয়ে রঙে রঙে রঙিন করে তুলছে ছবি৷
পরের ছবিটি এক অন্ধকার তৃণভূমিতে চিত হয়ে শায়িত এক নারী অপলক তকিয়ে আছে আঁধারলালিত আকাশে ফুটে থাকা অগণন নক্ষত্রের দিকে৷ ঘন তমিস্রা গাঢ় হয়ে ঘিরে আছে তার শরীর৷ শুধু শরীরের অংশটুকুতে ক্ষীণ অলো এসে পড়ছে নক্ষত্ররাজির৷ সেই আলো যেন জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে সারা বনভূমিতে৷
পরের ছবিটিও অরণ্যভূমির৷ পটভূমিতে ধোঁয়া–ধোঁয়া সবুজের আস্তরণ৷ সুউচ্চ বৃক্ষচূড়া স্পর্শ করতে চাইছে ধূসর আকাশ৷ নীচে বিছোন আছে ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা৷ মাঝখানে লাল মোরামের সরু পথ৷ ঘন সবুজের মধ্যে একটি বিশাল দিঘি৷ দিঘিতে চরছে কটা সাদা ধবধবে রাজহাঁস৷ দিঘির পাড়ে উদাস নয়নে পিছন ফিরে বসে আছে এক আলুলায়িত নারী৷ ঘন কালো চুলে আবৃত সোনালি পিঠ৷ যেন সে ভাবছে দিঘির জলে স্নান করতে নামবে কি নামবে না৷
বন্ধ দরজা–জানালা ভেদ করে প্রবেশ করছে পরবর্তী কলি:
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো—
নিশিদিন আলোকশিখা জ্বলুক গানে৷৷
সেই নারী বলছে তার দেহখানি তুলে ধরে দেবালয়ের প্রদীপ করতে৷ আগুনের দহনে সবকিছু হয়ে উঠুক শুদ্ধ, পবিত্র, সুন্দর৷ এখানেও কি স্নানবিলাসিনী নিঃসংকোচে ব্যক্ত করে চেয়েছে সেই আবেদনই চৈতন্যালোকের মতো নিবেদিত হোক তার দেহশিখা!
পরের ছবি এক বহুবর্ণ ল্যান্ডস্কেপ, সামনে বিস্তীর্ণ চরাচর, দূরে কিছু আবছা হয়ে আসা পাহাড়ের সিল্যুট৷ সেখানে যাওয়ার পথে বহু ধরনের উঁচু–উঁচু গাছ, সবুজের নানা শেডের পাতা, বৃক্ষরাজির উপরে নীল আকাশ আর সাদা মেঘের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার৷ অরণ্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক বনরানি৷ পাতার মালায় শোভিত তার দেহ৷ ঘনকলো চুলের রাশি উড়ছে এলেমোলো হাওয়ায়৷ ছবির সব রং খুব ঘন৷ রঙের পোঁচের মধ্যে জলরঙের টেকনিক৷
বোধ হয় অনেকক্ষণ হয়ে গেছে চিত্রজিৎ থমকে গেছে ছবি আঁকতে আঁকতে৷ কী যেন ভাবছে, তার মধ্যে অলমিতি হঠাৎ বলল, স্যার—
চিত্রজিৎ ফিরে পায় তার সংবিৎ৷ আবার শুরু করে তুলি চালাতে৷
হঠাৎ ঘড়িতে চোখ রাখে৷ আটটা পঁচিশ৷ সাড়ে আটটা নাগাদ প্রতিদিন বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে অলমিতি৷ তাই চিত্রজিৎকে মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ যোধপুর থেকে টালিগঞ্জ চালিহা রোলিং মিল অনেকটা পথ৷ সরাসারি কোনও বাস নেই৷ অটোতে–টোটোতে ফেরে প্রতিদিন৷ দু’বার চড়তে হবে অটোয়৷ তার দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে একটু চিন্তিত অলমিতি৷
পরের ছবিটিতে নীল রঙের আধিক্য, চারপাশ জুড়ে স্বপ্ন–স্বপ্ন পরিবেশ, যেন নীল স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে এক নারী৷ খোলা পিঠে কালো চুলের ঢেউ নেমে এসেছে নিতম্ব ছাড়িয়ে৷ সবুজ চরাচরের মধ্যে পায়ে–চলা সরু মেঠোপথ৷ মেটে রঙের পথ বেয়ে সেই নারী চলেছে যেন আরও গভীরতর স্বপ্নের সন্ধানে৷
পরের ছবি, চারপাশে সবুজ বনানী, তার মধ্যে এক খোলা জায়গায় একটি কালো ডোরা–কাটা হলুুদ রঙের বিশাল বাঘ, তার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে এক উদাসীন নারী৷ তার মসৃণ সোনালি রঙের ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে নেমে আসা ঘন কালো চুলে আবৃত তার জানু পর্যন্ত সম্মুখশরীর৷ পুরুষ–বাঘটির চোখ জ্বলছে কী এক অস্থিরতায়৷
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব৷
ইভের জীবনে কি কোনও ঈশ্বর ছিল? কার উদ্দেশে প্রার্থনা জানাবে ইভ— বলবে, তোমার স্পর্শে আকাশে ফুটে উঠবে নতুন নতুন নক্ষত্র৷ সেই নক্ষত্রের আলোয় এক অন্য অর্থ বহন করবে জীবনের৷
দ্রুত তুলি চালাচ্ছে চিত্রজিৎ৷
তার পরের ছবি এক ঘন অরণ্যের পটভূমিতে এক বন্য চেহারার নারী, কটিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলেমেলো চুলের রাশি, দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে বাঁ–হাতে একটি গাছের ডাল নামিয়ে ডান হাতে তুলতে চাইছে একটি পুরুষ্ট ফল যা নাকি দেখতে আপেলের মতো৷ কিন্তু আপেলটি তার নাগালের বাইরে থাকায় পৌঁছচ্ছে না তার হাতের মধ্যে, তাতে তার মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য অসহায়তা৷ এই ছবির নাম ‘জ্ঞানবৃক্ষের ফল’৷
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে সুরঞ্জনার গান:
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো—
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব–পানে৷৷
চিত্রজিৎ আরও একবার থমকে গিয়ে নিমগ্ন হল গানের কলির মধ্যে৷ দু’চোখের চারদিকে ঘনিয়ে থাকা অন্ধকার দূরীভূত হবে, সেই দৃষ্টি যেখান গিয়ে পড়বে সেখানে পরিপূর্ণ হবে প্রখর আলোয়৷ মনের সমস্ত ব্যথা উধাও হয়ে জ্বলে উঠবে ঊর্ধ্বপানে৷
রবীন্দ্রনাথের ঠিক এরকম একটি গানের কলির মতোই আঁকছে এবারের ছবিটা৷ পটভূমিতে ঘন অরণ্যানী, চারপাশে সবুজ৷ দূরে দেখা যাচ্ছে একটি সোনালি রেখা, সেই রেখা এসে পড়ছে এক নারীর শরীরে৷ সেই নারী তার সোনালি ঘাড় উঁচু করে, দুই পেলব বাহু আকাশের দিকে তুলে, দুই চোখ নিমীলিত করে কী যেন প্রার্থনা জানাচ্ছে৷ নিশ্চয় অন্তরীক্ষে এমন কেউ আছেন যিনি শুনছেন তার প্রার্থনা৷ চিত্রজিৎ ভাবছে আর এক–একবার তুলি প্যালেটে ডুবিয়ে, নির্ধারিত রং মাখিয়ে মনঃসংযোগ করছে ক্যানভাসের উপর৷
ঠিক সেসময় তার বন্ধ দরজায় তিনবার টোকা দেওয়ার শব্দ৷ পাশের ঘরে গান থেমে গেছে, নিশ্চয় সুরঞ্জনা দরজার ওপাশে৷ চিত্রজিতের ভুরুতে মস্ত বড়ো কোঁচ৷ সুরঞ্জনা কখনও তার আঁকার সময় ব্যাঘাত ঘটায় না৷ একবার আড়চোখে দেখে নিল দেয়ালের ধার ঘেঁসে দাঁড়ানো বিবসনা অলমিতির দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির দিকে৷ অলমিতিও মুহূর্তে দিশেহারা৷ তাকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলে চিত্রজিৎ দরজাটা খুলে ফাঁক করল একটু৷ ওপাশে সুরঞ্জনা৷ জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবে?
সুরঞ্জনর চোখ আছড়ে পড়ল অল্প ফাঁক করা দরজার ভিতরে৷ কিছু চোখে না পড়তে বলল, কাল সকালে আমি ‘ইছামতী’র অনুষ্ঠানে যাচ্ছি৷
—ঠিক আছে, যাও৷
—রাতে ফিরব না৷
চিত্রজিৎ এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে বলল, একা যাচ্ছ?
—না, সঙ্গে তমোনাশ থাকছে৷
চিত্রজিতের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, ঠিক আছে৷
বলেই শব্দ করে বন্ধ করে দিল দরজাটা৷
কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে তাকাল অলমিতির দিকে, বলল, ঠিক আছে৷ আজ এই পর্যন্ত থাক৷ আজ একটু রাত হয়ে গেল৷
অলমিতি গম্ভীর মুখে পোশাক পরে বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়
Advertisement



