• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ধর্মের নামে বিভাজন: সংবিধানের চেতনায় আঘাত

এ দেশের রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে চলেছে এবং তৈরি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, তাতে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সুস্থ সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

সৈয়দ হাসমত জালাল

এ দেশের রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে চলেছে এবং তৈরি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, তাতে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সুস্থ সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা।

Advertisement

ভারতের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভাজন ও বিদ্বেষ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। সংবিধান নির্ধারিত ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনা আজ ক্ষমতার রাজনীতির শিকার। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক উস্কানিমূলক মন্তব্য শুধু সমাজে ঘৃণা ছড়াচ্ছে না, বরং ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি নাকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তুষ্ট করতে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বিরোধিতা করেছেন। অথচ সেই দাবি সম্পূর্ণ অসত্য। সরকারের পক্ষ থেকে যখন আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়, তখন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দলে ছিলেন এবং প্রকাশ্যে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন। অমিত শাহের মন্তব্য তাই সত্য নয়, রাজনৈতিক বিভাজন তৈরির কৌশল মাত্র। অন্যদিকে, অমিত শাহের এই কথার মধ্যে মিশে আছে আরও এক ভয়ংকর অসত্য। তাঁর কথার অন্য একটি অর্থ, এ দেশের মুসলিমরা ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বিরোধিতা করছেন অর্থাৎ তাঁরা দেশপ্রেমিক নন। একটি সম্পূর্ণ সম্প্রদায়কে দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া বিপজ্জনক প্রবণতা।

Advertisement

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং সম্প্রতি বিহারে এক জনসভায় মুসলিম নাগরিকদের উদ্দেশে ‘নিমকহারাম’ বলে আখ্যা দেন— যা কেবল অপমানজনক নয়, সংবিধানবিরোধীও। বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা হিন্দু সমাজকে উসকে দিয়ে বলেন, ‘বাড়ির মেয়েরা যদি অহিন্দুদের বাড়ি যায়, তবে তাদের ঠ্যাং ভেঙে দিন।’ এই মন্তব্য নারী- স্বাধীনতার প্রতি অবমাননাকর এবং সামাজিক হিংসাকে উৎসাহিত করবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও গত লোকসভা নির্বাচনের আগে একাধিকবার সংখ্যালঘুদের প্রতি বিষোদ্গার করেছেন। সুযোগ পেলেই তিনি ধর্মের কার্ড খেলতে অভ্যস্ত। প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে এ ধরনের মন্তব্য জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির ন্যূনতম শালীনতার সঙ্গেও বেমানান। সেই সঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের এইসব বক্তব্য দলীয় কর্মীদের এবং সাধারণ মানুষের একাংশের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

এই বিভাজনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ অন্যান্য বিজেপি নেতারা একপেশে ধর্মীয় স্লোগান তুলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ উসকে দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ এক নতুন ও বিপজ্জনক প্রবণতা।

এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেশের সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করছে। ভোটে লাভের আশায় ঘৃণার রাজনীতি যত বাড়ছে, ততই আড়াল হচ্ছে মানুষের প্রকৃত সমস্যা— বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষা ও জীবিকা সংকট। রাজনীতি যদি মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির বদলে ধর্মের নামে বিভাজনে নেমে আসে, তবে তার ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।

ভারতের প্রকৃত শক্তি তার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে নিহিত। সেই ঐক্যের আদর্শকে রক্ষা করা এখন কেবল রাজনীতিবিদদের নয়— প্রতিটি সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। রাজনীতির ভাষা হতে হবে মানবিক, উন্নয়নমুখী ও যুক্তিনির্ভর। ধর্মীয় বিভাজন নয়, মানবিকতা, নাগরিক অধিকার ও উন্নয়ন— এই পথেই ভারত তার সত্যিকার মর্যাদা ফিরে পেতে পারে।

Advertisement