এম সহদেব
খাটো চেহারা, সাদা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি, কালো গায়ের রং নিয়ে বেশ মানিয়েছিল। স্বরূপ রায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল প্রতাপ। স্বরূপবাবু মণিপুর বাঁশতলা হাইস্কুলে নতুন হেড মাস্টার হয়ে এসেছেন। আগের হেড মাস্টারমশাই অবসর নিয়েছেন বছর দুই আগে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কাজ করেছেন সহকারী শিক্ষক নিমাই হালদার মহাশয়। এখন নতুন হেডমাস্টার। তার নতুন নিয়ম নীতি। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে নতুন আগত হেড মাস্টার কেমন হয়, তিনি কেমন করে ক্লাস করেন, কোথায় থাকেন এসব সম্পর্কে একটু কৌতূহল। বাকি ছাত্র ছাত্রীদের মত প্রতাপও অপেক্ষায় ছিল নতুন স্যারের ক্লাস শোনার জন্য। প্রার্থনা হয়ে গেল। ক্লাস শুরুর ঘন্টাও পড়ে গেছে। আজ প্রথম ক্লাসটা হেড মাস্টার মশাইয়ের। প্রতাপ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল নানা রকম কল্পনায়। হঠাৎ ক্লাসের মধ্যে একটু কোলাহল আর সবার ব্যস্ত উঠে দাঁড়ানোর শব্দে প্রতাপ হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্লাসে হেড মাস্টারমশাই এসেছেন।
Advertisement
‘গুড মর্নিং স্যার।’ সমবেত একই স্বরে সবাই বলে উঠলো।
‘গুড মর্নিং এভরিবডি। অ্যান্ড সিট ডাউন।’ সবাই আবার একসঙ্গে যেন ঝপ করে বসে পড়ল।
হেড মাস্টারমশাই রোল কলের পর নিজের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি আজকে তোমাদের ইংরিজি পড়াবো। তোমরা তোমাদের ইংরিজি টেক্সট বইটা বার করো।’
Advertisement
সবাই সেই মত প্রস্তুত হয়ে বসলো। সেই প্রথম দিনের পড়ানো। মনের মধ্যে গেঁথে গেল। জীবনে এতজন শিক্ষক পড়িয়েছেন কিন্তু স্বরূপবাবুর মত এত সহজ সরল প্রাণবন্তভাবে মনের পটে ছবি এঁকে দেওয়ার মত করে পড়াতে কাউকে দেখেনি। দীর্ঘ ছ’বছর স্কুল জীবনের অনেক ক্লাস স্বরূপ স্যার করেছেন বাংলা, ইংরিজি, ইতিহাস, ভূগোল সব কিছুতেই তিনি যেন সমান সাবলীল, সমান দক্ষতার সঙ্গে পড়িয়েছেন। ক্লাস টেনের আগে পর্যন্ত প্রতাপ বুঝতেই পারেনি তিনি কোন বিষয়ের শিক্ষক। প্রতাপ মনের মধ্যে এক আদর্শের প্রতিরূপ হিসাবে স্বরূপ স্যারকে গেঁথে নিল। সেই থেকে ওর জীবনের লক্ষ্যও স্থির হয়ে গিয়েছিলো। তাকে শিক্ষক হতেই হবে। স্বরূপ স্যারের মত শিক্ষক। কৈশরের আবেগে জবজবে ওর মনের আইডল ওয়ার্শিপিংয়ের প্রবণতার সামনে ছিলেন স্বরূপ স্যার। স্যারকে মনে হতো গভীর জ্ঞানের অধিকারী এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব। সততা নিষ্ঠা আর আদর্শে ভরা এক পরিপূর্ণ মানুষ যার কাছে মানুষের খারাপ দিকগুলো একেবারে অধরা। সমস্ত খারাপ কিছুর উপরে তাঁর স্থান।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ছ’বছরের স্কুল জীবনের ইতি। স্বরূপবাবুরও অবসর ওই বছর। খুব খারাপ লাগছিল এই স্কুলজীবন আর ফিরে আসবে না, স্বরূপবাবুকে এমন করে শিক্ষক হিসাবে পাবে না ভেবে। সেদিন চোখের জলে স্যারকে প্রণাম করে বিদায় নিয়েছিল প্রতাপ। মাথায় হাত রেখে স্যার বলেছিলেন, ‘ভালো থাকো। বড়ো মানুষ হও বাবা।’
স্কুল ছাড়ার পর আর মণিপুর বাঁশতলা হাইস্কুলে খুব একটা যাওয়া হয়নি। স্বরূপ স্যারের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে দেখা করা হয়নি কখনও। কিন্তু মনের মধ্যে গাঁথা স্যারের নাম। প্রতাপ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল স্যারের মত সফল গুণী শিক্ষক হবে।
এগারোটা বছর কেটে গেলো। উচ্চতর মাধ্যমিক, কলেজ ইউনিভার্সিটি, ভালোমন্দ, সুখদুঃখ, মিলন-বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে শিক্ষার্থী জীবন। বহু গুণী শিক্ষক, তার থেকে বেশি সাধারণ শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয়, শিক্ষালাভ হয়েছে। এত শিক্ষকের ভিড়েও স্বরূপবাবুর মুখটা বার বার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। জীবনের এতটা পথ এসেও সেই মুখটা সেই অসাধারণ গুণের কথা মনের মধ্যে অমলিন অবস্থায় আলোর দিশা হয়ে রয়ে গেছে।
প্রতাপ এখন হাই স্কুলের শিক্ষক। তার মতো গুণী শিক্ষক এলাকায় খুব কমই আছে। নানা বিষয় সহজ সরল সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার যে অসীম ক্ষমতা তার মধ্যে আছে তা বর্তমানে এলাকায় বিরল। প্রতাপের ভিতরের এই গর্বটাই তার মনের চালিকা শক্তি। আর তার জন্য মনে মনে শতবার প্রণাম জানায় তার জীবনের আদর্শ স্বরূপবাবুকে।
শিক্ষক হিসাবে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। চারদিকে সবার মুখে মুখে তার নাম। প্রতাপের মধ্যে স্বরূপ স্যারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটাও বাড়তে থাকে। কিন্তু সে এখন স্ত্রী পুত্র মা বাবা নিয়ে এক পরিপূর্ণ ফ্যামিলি ম্যান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বের ভার বেড়েছে। স্বরূপ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাব যাব করে আর যাওয়া হয় না।
মাঝে মাঝে অনেকের মুখে স্বরূপ স্যারের কথা শোনে। শরীর স্বাস্থ্য মানসিক অবস্থা, কাজ কর্ম সম্পর্কে খবর পায়। প্রতাপ জানে স্বরূপ স্যার খুব ভালো বক্তা। ইদানীং নাকি রাজনীতিতে ঢুকেছেন। কথাটা শুনে প্রতাপের বুকটা যেন আরেকটু গর্বে ফুলে উঠলো। ওঁর মতো সুবক্তা বিচক্ষণ আদর্শবান মানুষদের তো রাজনীতিতে বেশি বেশি করে আসা উচিত। এই নোংরামির রাজনীতির যুগে তাঁর মত মানুষেরা এলে তবেই তো রাজনীতি জঞ্জালমুক্ত হবে। আরো গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দূর থেকে প্রণাম জানাল নিজের আদর্শ মানুষটাকে।
সেদিন ওর ক্লাসমেট সুদামের সঙ্গে দেখা। সুদামের বাড়ি দক্ষিণ বারাসত। কথায় কথায় স্বরুপবাবুর কথা উঠলো। প্রতাপ সুদামকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘সুদাম, তুই স্বরূপবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা জানিস?’
‘হ্যাঁ। কেন?‘ সুদাম পাল্টা প্রশ্ন করল।
‘না এমনি। ভাবছিলাম একবার স্যারের সঙ্গে দেখা করবো।’
‘কোনো বিশেষ দরকার নাকি?’
‘না, না, এমনি স্যারের সঙ্গে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। তাই ভাবছি—’
‘ও। তুই জানিস না! ওই তো দক্ষিণ বারাসত বোস মন্দিরের পাশ দিয়ে এক মিনিট গিয়ে ডান হাতের তিনতলা নীল রঙের বাড়িটা স্যারের। বুঝতে পেরেছিস ঠিক কোন জায়গাটায়?’
প্রতাপ মাথা নেড়ে বলল, ‘বেশির ভাগটাই বুঝেছি। বাকিটা ওখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে বা খুঁজে খুঁজে জেনে নেব।’
তারপর দু’জন দু’জনার লক্ষ্যের দিকে দ্রুত পা চালাল। ব্যস্ত সময়ের তাড়ায় কেউ যেন এক দণ্ড দাঁড়িয়ে একসঙ্গে কথা বলার ফুরসতও পায় না এখন।
চৈত্র মাস। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। এই প্রথমবারের জন্য প্রতাপের এক্সামিনার হিসাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে। হেড এক্সামিনারের বাড়ি ডায়মন্ড হারবারে। পরীক্ষার্থীদের খাতা নিয়ে ফিরতে বেলা গড়িয়েছে বিকেলের ঢালে। তিনটে বাজে। ডায়মন্ড থেকে মগরাহাট স্টেশন। ওখান থেকে দক্ষিণ বারাসত হয়ে বাড়ি ফিরবে প্রতাপ। হঠাৎ ওর মাথায় এক খেয়াল চেপে গেলো। একবার স্বরূপ স্যারের বাড়ি হয়ে গেলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। এমনিতে এ কাজ সে কাজ করে কিছুতেই সময় হয় না। আজকে যখন এই পথ ধরে ফিরছে আর সময়ও হাতে আছে কিছুটা— এমন সূযোগ হাত ছাড়া করতে আর চায়নি প্রতাপ।
‘ওই তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবেন দাদা।’ বোস মন্দিরের পাশের তিন রাস্তার মোড়ের দিকে হাত দেখিয়ে প্রতাপ অটোওয়ালাকে বলল।
অটোওয়ালা কিছু বলল না। ঘাড়টা একটু নাড়ল যার ভাষা— আচ্ছা ঠিক আছে। ব্রেকের আওয়াজ আর হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে অটোটা থামল। পার্স থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট দিয়ে অটোওয়ালাকে বিদেয় করল প্রতাপ। মাথার উপর ছাতাটা খাঁটিয়ে লম্বা লম্বা পায় সুদামের দেওয়া ঠিকানা ধরে এগোতে থাকল। হ্যাঁ, এই তো সেই সুদামের বর্ণনামতো নীল রঙের বাড়িটা। মূল রাস্তার থেকে একটা সরু কংক্রিটের রাস্তা ঢুকে গেছে। তার মাথায় বাড়িটা। খুব সুন্দর। বিলাস বহুলও। প্রতাপ পা চালিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। ডাইনিং প্লেসের দরজাটা হাল্কা করে ভেজানো। সামান্য একটু ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, স্যার সোফার উপর বসে আছেন। অন্য দিকের সোফায় আরো একজন অচেনা লোক। ওদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার আওয়াজ কানে আসছে। প্রতাপ নিজের কানকে আরো বেশি সজাগ করে তুললো শোনার জন্যে। স্যার রাগান্বিত ভাবে লোকটাকে বলছে, ‘কথা হয়েছিল টেন্ডারের সিক্স পারসেন্ট হারে টাকা আমাকে দেবে। আপনি দেখলেন, আপনার সামনে ওরা আমাকে তিন লাখ দিল। বাকি পঞ্চাশ বাহান্ন হাজার টাকা না দিয়ে চলে গেছে। বাকি টাকাটা না দিলে আগামী এগারো তারিখ ষাট লাখ টাকার যে টেন্ডার আছে সেটা কীভাবে ওরা পায় দেখব।’
সামনের লোকটা সমানে অনুনয় করেই যাচ্ছে, ‘স্যার আমি ব্যপারটা দেখছি। আপনি রাগ করবেন না। আমি ব্যপারটা দেখে মিটিয়ে নিচ্ছি।’
প্রতাপ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। যাঁকে জীবনের আদর্শ করে এতদিন এগিয়ে চলা তিনিও এমনভাবে নিজেকে দুর্নীতির কাছে ডুবিয়ে দিলেন। তার সামনের পর্দাটা কে যেন হঠাৎ করে তুলে দিয়ে দেখিয়ে দিল এক অন্ধকার গুহা সামনে হাঁ করে আছে। স্বরূপ স্যারের সাদা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবির মধ্যে এত কালি! শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছিল না সরু ফাঁকটা দিয়ে। তার মনের মধ্যে যিনি আলোর বাতি জ্বেলে তাকে এতটা পথ এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন, তাঁর জন্য দূর থেকে প্রণাম জানাল সে। শুধু বদলে যাওয়া মুখের বীভৎসতা কল্পনা করে ভেতরে ঢুকে আর দেখা করার সাহস হল না।
Advertisement



