নির্মল ধর
দেশটা ইরাক হলেও জায়গাটা আমাদের সুন্দরবনের মতো জলময়, মার্শল্যান্ড। গ্রাম থেকে খাল-বিল ডিঙিয়ে— লগি ঠেলা নৌকো ঠেঙিয়ে যেতে হয় অন্য পাড়ের গাঁয়ের স্কুলে। প্রতিদিনই যায় কিশোরী লামিয়া, সহপাঠী সঈদ। টিপটিপ বৃষ্টি পড়া সেই দিনটা ছিল নব্বুইয়ের দশকের সম্ভবত ২৬ এপ্রিল। দেশের সর্বাধিপতি প্রেসিডেন্ট মান্যবর সাদ্দাম হুসেনের জন্মদিন ২৮ এপ্রিল। তাঁর জন্মদিনে স্কুলের গরিব ছাত্র-ছাত্রীরা কেক বানিয়ে আনবে, আর মাস্টারমশাই সেই লোভনীয় কেকটি সর্বাধিপতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে নিজের পেটপুজো করবেন— এমনই তাঁর পরিকল্পনা।
Advertisement
মাস্টারমশাইয়ের আদেশ পালন করতে নামিয়া-সঈদ শুধু নয়, লামিয়ার বৃদ্ধা দিদিমাও গাঁ ছেড়ে শহরে আসতে হয়। কেক তৈরির প্রয়োজনীয় রস ময়দা, চিনি, ডিম সংগ্রহ করতে। এদিকে শহরজুড়ে তখন আতঙ্ক। বাজারে আকাল, আর মাথার ওপর বোমারু বিমানের অতর্কিত আক্রমণ। তাছাড়া শহুরে মানুষগুলোর লোভ-লালসার জিভগুলো তো লকলক করছেই। অর্থের জন্য লামিয়ার প্রিয় সঙ্গী মোরগটা বিক্রি করে, এমনকি বাড়িতে রাখা সাধের পুরনো ঘড়িটাও বিক্রি করে দেয়। অথচ হাতে পায় অচল/নকল নোট! শহরের আধো আলো-আঁধারি গলিগুলোতেও জমেছে অভাব এবং প্রতারণার এমন ফন্দিফিকির। তবুও তারই মধ্যে কেক তৈরির সামান্য মশলা দিয়ে বৃদ্ধা দিদা একটি কেক বানিয়ে দেন লামিয়াকে। চুরি করা কিছু ফল উপহার নিয়ে যায় সঈদ।
Advertisement
সাদ্দাম হুসেন তাঁর জন্মদিনে নিজে এলাহি এক অনুষ্ঠানে কেক কাটছেন সঙ্গোপাঙ্গো পরিবৃত হয়ে। সেই শট-এর সঙ্গে কাট করে দেখানো হচ্ছে লামিয়া-সঈদের স্কুলে বোমা পড়ছে। জন্মদিনে প্রেসিডেন্টের কেকটির কোনও অস্তিত্বই নেই। শহরের মতো শান্ত গ্রাম এবং স্কুল জুড়েও এক ভয়াবহ আতঙ্ক! যুদ্ধ বিমানের এলোপাথারি ওড়াউড়িতে সারা দেশটাই উত্তপ্ত। ভবিষ্যতের অনিবার্য এক অশনি সংকেত! ভাবলে বিস্ময় লাগে ইরাকি পরিচালক হাসান হাদির এটি প্রথম ফিচার ছবি। কোনও স্লোগান নেই, চিৎকৃত সংলাপ নেই! জলবেষ্টিত ইরাকি এক গ্রাম ও আধা শহরের চলতি জীবনের আলো আর ছায়া দিয়েই তুলে আনলেন কঠিন বাস্তব চিত্র। দেখানোর নিরাসক্ত ভঙ্গি, অথচ কী নির্মম, গভীর বেদনা উদ্রেকী!
এমনিতে কী আর কান উৎসবে ‘ক্যামেরা দ্য ওর’ পুরস্কার জিতেছিল ছবিটা সিনেমা জ্ঞানী-গুণী জুরির সিদ্ধান্তে! সাধারণ দর্শকের ভোটেও হাদির হাতে আসে ‘অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড’। সদ্য শেষ হওয়া হাঙ্গেরির একমাত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব মিসকোল্চ (উচ্চারণ মিসকোল্চ-ও হতে পারে) থেকে ইরাকি এই ছবি বলা যায়— পুরস্কার পাওয়ায় হ্যাটট্রিক করল। শুধু ফিপ্রেস্কি জুরি নয়, ইক্যুয়িম্যানিকাল জুরি এবং আর্ট হাউস সিনেমা অ্যাওয়ার্ড (CICAE)— তিনটি পুরস্কারই গেল হাসান হাদির হাতে। উৎসবে তিনি আসতে পারেননি। আসলে ভেনিস জয়ের পর তাঁর এই ছবি তখন বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। আমন্ত্রণ আসছে সব উৎসব থেকেই। মানুষ তো তিনি এক পিস। এ-আই দিয়ে তখন ‘ক্লোন’ করা যাচ্ছে না! তিনটি পুরস্কারই তুলে দেওয়া হলো ছবির আর্ট ডিরেক্টরের হাতে।
এবার একটু মুখ ঘোরানো যাক হাঙ্গেরির এই অজানা-অচেনা ফিল্ম উৎসবটার দিকে। ফিপ্রেস্কির কেন্দ্রীয় ইউনিট জুরি হিসেবে আমার নামে শিলমোহর দিলে— আমারই এক সতীর্থ কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন— এত উৎসব থাকতে ‘মিসকোল্চ’ কেন?! সত্যিই তো, বার্লিন-বুসান আর্মেনিয়া, তাইওয়ান, ভ্লাদিভোস্তকের পর অনামি মিসকোল্চ কেন! আমার জবাব ছিল— স্মল ইজ অলওয়েজ বিউটিফুল। উৎসব ঘুরে বেড়ানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় প্রতীতি হয়েছে উৎসবের পঞ্চপাণ্ডব কান-বার্লিন-ভেনিস-টোরোন্টো–সান সেবাস্তিয়ানকে সরিয়ে রাখলো কার্লোভি ভ্যারি, কায়রো, লোকার্নোর, কিংবা এলঝগওনা, রোটারডাম উৎসবগুলো অনেক বেশি ইন্টিমেট। বাণিজ্যিক ভিড় কম থাকায় উৎসব অতিথিদের জন্য যথেষ্ট স্পেস দেয়। পারস্পরিক আলোচনা-আড্ডায় জমে ওঠে উৎসবের পরিবেশ।
এই সত্যটা মনে রেখেই মিসকোল্চকে আমার পছন্দ! বেশ ভালো করেই জানতাম বুদাপেস্ট হাঙ্গেরির রাজধানী শুধু নয়, হাঙ্গেরিয় সিনেমার প্রাণবিন্দুও বটে। ওখানকার মা ফিল্ম, কোরদা স্টুডি়ও, বুদাপেস্ট ফিল্ম আকাদেমি, ইউনিভার্সিটি অফ থিয়েটার অ্যান্ড ফিল্ম আর্টসের সঙ্গে জড়িত কে না ছিলেন! প্রবীণ মিকালোস জাঁকসো, (যাঁকে হাঙ্গেরিয় সিনেমার কবি বলা যায়), ইস্তভান ঝাবো, (যাঁর ‘মেফিস্টো’ আর ‘কর্নেল রিডল’ কোনদিন পুরনো হবে না), বেলা টার (এঁকে বলা হয় হাঙ্গেরির তারকোভস্কি), মার্তা মেসজারোশ (যাঁর ডায়রি সিরিজের তিনটি ছবি ডায়রি ফর মাই চিলড্রেন, ডায়রি ফর মাই লাভার্স এবং ডায়রি ফর মাই ফাদার অ্যান্ড মাদার এখনও হাঙ্গেরিয় ক্লাসিক সিনেমার তালিকায়)— সব্বাই-ই জড়িয়ে আছেন বুদাপেস্ট শহরটার সঙ্গে।
আবার এই মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ নামে একটি ছবি করেছিলেন আমেরিকান পরিচালক ওয়েস এন্ডারসন। যতদূর মনে পড়ছে ছবিটা ২০১৪-য় বার্লিন উৎসবে দেখেওছিলাম। এ ছবির আংশিক শুটিং হয়েছিল বুদাপেস্ট শহরেই। র্যালফ ফিয়েন, অ্যাড্রিয়ান ব্রডি, উইলিয়াম ডাফো, হার্ভে কেটল, জুডল, বিল মারে, লিয়া সেদ্যু, টিল্ডা সুইন্টন— অভিনয় করেছিলেন! রীতিমতো তারকাখচিত ছবি। এছাড়াও বুদাপেস্ট শহরটার সঙ্গে ইউরোপের টুকরো টুকরো ইতিহাস তো জুড়ে আছেই।
তবুও সেই ইতিহাসকে সরিয়ে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে ‘মিসকোল্চ’ নামের স্বল্প পরিচিত শহরে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বসানোর গোড়ার কথাটা কী! জানতে মন চাইছিল। উৎসবের উদ্বোধন ৫ সেপ্টেম্বর। আমি বুদাপেস্ট পৌঁছে যাই আগের দিন ঠিক সকাল সাড়ে ন’টায়। গাড়ি নিয়ে উৎসবের এক তরুণী ভলান্টিয়ার হাজির সেখানে। সেখান থেকে উজিয়ে আমায় যেতে হবে আরও উত্তরে প্রায় দুশো কিলোমিটার! দীর্ঘ আকাশ পাড়ির পর আবার এতটা পথ! ক্লান্ত লাগবে না তো! না, লাগেনি। প্রথম কথা সুন্দর আবহাওয়া। গরম-ঠান্ডায় মেশানো বেশ নাতিশীতোষ্ণ বলতে পারি। ওই মুহূর্তে আমার গাইড তরুণীও ছিল ভরসা।
তাঁর কাছ থেকেই শুনলাম ‘মিসকোল্চ’ শহরের ইতিবৃত্ত। মেয়েটি ওই শহরেরই। মিসকোল্চ নামের ক্ষুদে শহরটাতো বটেই, তার আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে আছে ফিল্মি মানুষদের অনেক অজানা কাহিনী। যেমন— হলিউডি জায়েন্ট প্যারামাউন্ট ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড জুকর জন্মেছিলেন রিক্মে নামের প্রতিবেশী গ্রামে। হলিউডের আর এক দৈত্যাকার প্রোডাকশন হাউস টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের অন্যতম প্রধান ইউলিয়াম ফক্সের জন্মভিটে হল মিসকোল্চ-এর পাশেই টোসকস্ভা! আরও আছেন! পাওয়েল – প্রেসবার্গার নামের প্রযোজনা সংস্থাটি লন্ডনে ব্রিটিশ সিনেমার চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকটা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সংস্থার বেটার হাফ এরিক প্রেসবার্গার-এর জন্মও খোদ এই মিসকোল্চ শহরে। সামনে উত্তরে ‘বুক’ পাহাড়, আর পাশে তিরতিরে সাজো নামের নদী। এই সেপ্টেম্বরে আবহাওয়া ছিল সুইজারল্যান্ডের গরমের মতো। শারীরিক মনোরম তো বটেই মনেরও আরাম।
দীর্ঘ দু’ঘণ্টার মোটর সফরে ওঁর গল্পই শুনলাম! ঠিক বলা হলো না। মিসকোলচ্ শহরের ফিল্মের ইতিহাসটাও জানা গেল। পরের দিন ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ২১তম সিনে-ফেস্ট-এর উদ্বোধন হবে শহরের প্রাণকেন্দ্র (নামেও সিটি সন্ট্রুম!) আর্ট হাউস বিল্ডিংয়ের ‘প্রেসবার্গার’ হলে। সিনেমার উৎসব সিনেমাপ্রেমী একজন মানুষের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে হবে এটাই তো তাঁর প্রতি বড় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। পরে জেনেছি ওইদিন সকালেই এরিক প্রেসবার্গারের বাড়িতেও একটি স্মারক ফলক স্থাপন করেছেন শহরের মেয়র যোসেফ টথ্ জানতাই এবং উৎসব পরিচালক টিবর বিরো!
ঠিক বেলা পৌনে একটা নাগাদ গাড়ি আমায় নামিয়ে দিয়ে গেল ‘ওরেগ’ নামের চারতারা এক হোটেলে। পুরনো বাড়ি। মাঝারি মানের হোটেল, স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই! তবে আধুনিক হোটেলের জৌলুসও নেই। খানিকটা বিত্তমধ্য মানসিকতা যেন! রিসেপশন কাউন্টারে জানলাম উৎসবের সব জুরিরাই এবং কিছু অতিথিরও ঠাঁই এখানে। ঘরে ঢুকে ক্লান্ত শরীরটাকে স্নানের ঘরে ঢুকে শান্ত করার প্ল্যান করছি। তখনই বাজল ফোন। ও প্রান্তে জুরিদের কো-অর্ডিনেটর শ্রীমতী তিমি কোকাই নেগি। স্বাভাবিক ভদ্রতায় ‘ওয়েলকাম’ জানিয়ে বলেছিলেন— রাত আটটা নাগাদ জুরিদের পারস্পরিক পরিচিতির জন্য ইম্প্রেসো ক্লাব নামের একটি রেস্তরাঁয় ডিনার রাখা হয়েছে। অবশ্যই আসবেন! কোথায় ইম্প্রেসো ক্লাব, যাব কীভাবে কিছুই জানি না। তবুও শ্রান্ত শরীরকে শান্ত করার তাড়াহুড়োয় বলে দিলাম ‘ওকে! নো প্রবলেম! আই উইল বি দেয়ার!’
তারপর স্নান সেরে নিচের ছোট্ট রেস্তরাঁয় ভরপেট রাইস, চিকেন ফ্রাই আর দইভুট্টা মাখা খেয়ে বিশ্রামের মেঘে শরীর ভাসলো! শরীর ভাসানের ব্যাঘাত ঘটল রাত আটটা নাগাদ। আবার কোকাই নেগির ফোন! ‘আপনি কোথায়? আমরা তো ডিনারে বসে গেছি। আসবেন কখন?’ প্রশ্নের ঘুম চোখে উত্তর দেওয়ার অবস্থা নেই! আমি শুধু বললাম, ‘রেস্তরাঁটি কোথায়— জানি না, যাব কীভাবে সেটাও বুঝতে পারছি না! একটু গাড়ি পাঠাবেন প্লিজ!’ ওপার থেকে উত্তর এলো জায়গাটা আপনার হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের পথ! এবার বুঝতে পারছি আপনি জেটল্যাগে বিপর্যস্ত। আপনাকে আর রাতের বেলা আসতে হবে না। খাবার আপনার হোটেলেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ তিমির আশ্বাসবাণী শুনে নিশ্চিত হলাম। তবে এটাও জানিয়ে দিলেন কাল ব্রেকফাস্টের পরেই যেন ফেস্টিভ্যাল সেন্টারে জুরিদের কাগজপত্র, পরিচয়-ব্যাজ সহ সংগ্রহ করে নিই!
পরদিন সকালে দশটা নাগাদ মিসকোল্চ শহরের প্রাণকেন্দ্র সেন্ট্রুমে ফিল্ম উৎসবের অফিসের খোঁজ করতে হদিশ মিলল মাত্র দুশো মিটারের মধ্যেই। সেখানেই আর্ট হাউস আর প্রেসবার্গার হল। ওখানেই জানতে পারলাম আমার দলের অন্য দু’জন তখনও শহরে পৌঁছননি। দুপুরেই পৌঁছবেন স্লোভেনিয়ার জিভা এমেরসিচ, আসবেন লুবলানা থেকে। অন্যজন দোরকা ডোরফাস— হাঙ্গেরির মানুষ, আসবেন বুদাপেস্ট থেকে। তখনই মালুম হলো গত রাতের ডিনারে তা হলো ‘ফ্রিপ্রেস্কি’ জুরির কেউই উপস্থিত থাকতে পারেননি। আশ্বস্ত হলাম, মেন জুরির চারজন, ইকুইম্যা-নিক্যাল জুরির তিনজন ছাড়াও এসে পড়েছেন সিনেওয়েভ, ইস্ট অফ ইউরোপ এবং সিআইসি এই বিভাগের তিনজন করে সবাই-ই। তক্ষুণিই আলাপ হয়ে গেল ব্রাজিলের তরুণী পরিচালক ইনগ্রিড মাচাদো, জার্মান তরুণী ফিল্ম গবেষক লিজা হ্যাকার, নরওয়ে থেকে আসা ফিল্মের অধ্যাপক পিটার স্টুয়ার্ট রবিনসনের সঙ্গে। দেখা হল জার্মানি থেকে আসা সাংবাদিক কারমেন গ্রের সঙ্গেও। দু’বছর আগে ওঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম কুর্দিস্তানের দুহক ফিল্ম উৎসবে।
প্রথমটায় চিনতে পারিনি। একটু পর দুহকের কথা বলতেই কারমেন বলে উঠলেন— ‘সেজন্যই মুখটা চেনা চেনা ঠেকছিল। মনে করতে পারছিলাম না ঠিক!’ এরপর আর পুরনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেওয়ার দরকার হয়নি। বিভিন্ন বিভাগের জনা চোদ্দ-পনেরো জুরি প্রেসবার্গার— হলের তিনটি বক্সে বসে ছবি দেখেছি, একান্তে আলোচনা করেছি। একমত সবসময় হওয়া যায়নি, ভিন্নমতও হয়েছি। কিন্তু কাজ করেছি ফিল্ম বান্ধব পরিবেশে।
এদিনই দুপুরে— ইম্প্রেসো ক্লাবে লাঞ্চ করতে এসে দেখা পেলাম বর্ষিয়ান হাঙ্গেরিয়ান অভিনেতা রবার্ট কোলতাই-এর। মুখটা চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু নামটা মনে করতে পারছিলাম না। সঙ্গের মহিলা মনে হল ওঁর স্ত্রী। কোনও দ্বিধা না করেই সামনে গিয়ে সেই মহিলাকেই বললাম— ‘আপনার পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে খুবই চেনা লাগছে, সিনেমার পর্দায় দেখেছি…’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভাঙা ইংরেজিতে তিনি বলে উঠলেন— ‘হি ইজ রবার্ট কোলতাই—হাঙ্গেরিয়ান অ্যাক্টর অ্যান্ড ডিরেক্টর!’ স্মৃতির বক্সে ঝলসে উঠলো লাসলো লুগোসির ছবি ‘ম্যান উইদাউট এ নেম’। দেখেছিলাম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। ওঁর আরও দুটো ছবি দেখেছি ‘উই নেভার ডাই’— রবার্ট নিজেই তখন পরিচালক। জানোস রেজার ‘লভ মাদার’ও দেখা। এক মুহূর্ত দেরি না করে কলকাতা ফিল্ম উৎসবে আসার জন্য অনুরোধ রাখলাম। শুনে বললেন— ‘ভেরি গুড আইডিয়া। নেভার বিন ইন ইওর কান্ট্রি! হোয়েন ইজ ইওর ফেস্টিভ্যাল?’ জানালাম দিন-তারিখ। বললেন— ‘উৎসব অফিসকে যোগাযোগ করতে বলো। চেষ্টা করব।’ এই মিসকোল্চ উৎসব এবছর তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করছে। তিনি সেই কারণেই মাত্র দু’দিনের জন্য এসেছেন। গাড়িতে ওঠার আগে বললেন— ‘সন্ধেবেলায় থাকছো তো? দেখা হবে।’
দেখা অবশ্য সেই সন্ধ্যায় হয়নি। উদ্বোধনের ভিড়ে কোলতাই দম্পতি জনসমুদ্রে ভেসে গিয়েছিলেন। তবে দু’দিন পরে ম্যাডাম মেইল করে জানিয়েছিলেন, কলকাতা ফিল্ম উৎসব থেকে আমন্ত্রণ তাঁরা পেয়েছেন এবং সম্মতিও পাঠিয়েছেন। নিশ্চয়ই এটা বড় আনন্দ সংবাদ।
এই মিসকোল্চ উৎসবেও দেখলাম উদ্বোধন নিয়ে তেমন কোনও ‘দেখানেপনা’ নেই। উৎসব পরিচালক টিবর বিরো, প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পিটার মাদারাস এবং শহরের মেয়র মঞ্চে উঠে শ্রোতা দর্শকদের অভিনন্দন জানিয়ে উৎসবের সাফল্য কামনা করলেন শুধু। কোনও বাড়তি কথা নয়। সম্বর্ধিত হলেন একা রবার্ট কোলতাই নন, প্রবীণ হাঙ্গেরিয় পরিচালক টিমার পিটারকেও দেওয়া হল জীবনকৃতি সম্মান। প্রত্যুত্তরে রবার্ট তাঁর বাবার লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করলেন। ভাষা বুঝতে পারিনি, কিন্তু এটুকু মালুম হল যে কবিতাটিতে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার বাণী আছে। দর্শক-শ্রোতাদের উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দন সেটাই জানিয়ে দিল।
এখানেই জানিয়ে রাখি উৎসবের সমাপ্তি ও পুরস্কার বিতরণী সন্ধ্যায় আরও একজন সম্মানিত হয়েছিলেন। হাঙ্গেরির নয়, প্রতিবেশী দেশ নরওয়ের নামী পরিচালক এরিক পোপ্পেকে দেওয়া হয় ‘অ্যাম্বাসাডর অফ দ্য ইউরৈাপিয়ান সিনেমা’ সম্মান। তিনি তাঁর ছোট্ট ভাষণেই কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিলেন— ‘পৃথিবীজুড়ে ডান ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি তাদের পাখা মেলেছে। তাঁদের আক্রমণ এখনই আটকাতে না পারলে সারা বিশ্বের সামনে কিন্তু গভীরতর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে!’ তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সেই সন্ধ্যাতেই দেখলাম ‘ক্যুইসলিং: দ্য ফাইনাল ডেজ’ নামে এরিকেরই তৈরি সর্বশেষ ছবি। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ভিদকুম ক্যুইসলিং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ছিলেন নাৎসি বাহিনীর সমর্থক। নরওয়েকে তিনি নাকি নিশ্চিত নাৎসী ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর কূটনৈতিক চালে। যুদ্ধের পর তাঁকে অবশ্য ‘যুদ্ধ অপরাধী’ হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়। ছবির মূল বিষয় ছিল সেই বিচারপর্ব। মনে রাখার মতো ছবি।
উৎসবে ভালো লাগা কয়েকটি ছবি
শুরুতেই উল্লেখ করেছি ইরাক-কাতারের প্রযোজনায় তৈরি হাসান হাদির প্রথম ফিচার ছবি ‘দ্য প্রেসিডেন্টস কেক’—পরপর তিনটি বিভাগের জুরিদের কাছ থেকে উৎসবের সেরা ছবির সম্মান পেয়ে হ্যাটট্রিক করেছে। কিঞ্চিৎ আলোচনাও করেছি ছবিটি নিয়ে। হাসানের সিনেমার বড় কৃতিত্ব হল কোনওরকম চিৎকৃত স্লোগান না আউড়ে ইরাকের একটি মাঝারি মাপের শহরের অতি সাধারণ নাগরিকের একটা দিনের জীবনযাপন দেখিয়েই তিনি পুরো দেশের অবস্থার প্রতিফলটি দেখাতে পেরেছেন। সাদ্দামের শাসনের বাড়াবাড়ি, সাধারণ মানুষেরও প্রাত্যহিক জীবনের স্খলন এবং আমেরিকার হুমকি কোনওটাই বাদ দেননি। সবটাই জড়িয়ে রয়েছে জীবনের সঙ্গে। এখানেই ছবিটির আন্তর্জাতিকতা।
মেইন জুরি দুটি ছবিকে বেছে নিয়ে সেরাত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। ছবি দু’টি হল— জোয়াকিম ট্রিয়ারের ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’ (নরওয়ে) পেল ‘প্রেসবার্গার’ পুরস্কার। অন্যটি হচ্ছে অভিনেত্রী ক্রিস্টিন স্টুয়ার্টের ‘দ্য ক্রনোলজি অফ ওয়াটার’ (ইউএসএ) পেল ‘জুকর’ পুরস্কার। আগেই বলেছি, হাঙ্গেরির এই দু’টি মানুষ এরিক প্রেসবার্গার এবং অ্যালফ্রেড জুকর হলিউডের শিরদাঁড়ার কশেরুকা। তাই এঁদের নামেই দু’টি সেরা ছবিকে পুরস্কার দেয় মিশকোল্চ। এক প্রবীণ ফিল্ম নির্দেশক ও তাঁর দুই মেয়ের সঙ্গে মানসিকতার বিচ্ছেদ-বিভেদ নিয়ে এক পারিবারিক গল্প ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’র! কিন্তু জোয়াকিম তার মধ্যেই এনেছেন বড় মেয়ে অভিনেত্রী নোরার সঙ্গে পরিচালক বাবা গুস্তভের মানসিক লড়াইয়ের নীরব টানাপোড়েন। মঞ্চ সফল নোরাকে তাঁর মৃতা স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয়ের অফার দিয়ে গুস্তভ একদিকে চাইছেন নিজের পড়ন্ত কেরিয়ারকে বুস্টআপ করতে আর মেয়েকে বলছেন তোমার অভিনয় ক্ষমতাকে আমি কুর্নিশ জানাতে চাই! অর্থাৎ এখানেও স্বার্থের প্যাঁচালো খেলা। জোয়াকিম ট্রিয়ার গুস্তভের চরিত্রে স্টেলান সাকসেগার্ড এবং নোরার ভূমিকায় রেনাতে রিনস্ভকে সুন্দর ব্যবহার করেছেন। এঁদের প্রাণছোঁয়া অভিনয় এই ছবির বড় আকর্ষণ!
আর ক্রিস্টিন স্টুয়ার্টের ছবি জানিয়ে দিল তিনি পর্দায় অভিনয়ের জন্য প্রিন্সেস ডায়না হয়ে উঠতে পারেন কিংবা গোদারের যুগান্তকারী ছবি ‘ব্রেথলেস’-এর পূর্ণনির্মাণে তিনি জঁ সিবর্গের ভূমিকায় জীবন্ত হয়ে উঠতে পারেন। আবার তিনিই ক্যামেরার পিছনে প্রথম দাঁড়িয়ে মেয়েদের কিশোরী বয়স থেকেই যৌন নিপীড়নের গল্প শব্দ এবং সংলাপ দিয়ে কতটা অস্বস্তিকর ও জীবন্ত করে তোলা যায় তারও প্রমাণ রাখলেন প্রথম ছবিতেই। যদিও তিনি লিডিয়া ইযুকনাভিচ নামের এক লেখিকার স্মৃতিচারণামূলক কাহিনী বেছে নিয়েছিলেন এই ছবির জন্য। সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখতো লিডিয়া! কিন্তু কিশোরী বয়সে তো বটেই পরেও তাঁর জীবনে একাধিকবার জল-ই নিয়ে আসে দুঃস্বপ্নের যৌন যন্ত্রণা। যে জন্য লিডিয়া একসময় বলতে পারে, ‘ইন ওয়াটার, লাইক ইন বুকস, ইউ ক্যান লিভ (Leave) ইওর লাইফ!’ সেই যৌন হেনস্থার প্রতিশোধও নেয় সে পরবর্তী সময়ে। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে লিডিয়ার ‘সম্পর্ক’ এক সময় বিষাদময়তা থেকে যেন ‘বিষ’ হয়ে ওঠে। ক্রিস্টিনের পরিচালনার কাজ পুরোপুরি নন-লিনিয়ার ফরমে, অথচ কী সাবলীল এবং স্বচ্ছন্দ। লিডিয়ার মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকাশে ক্রিস্টিনের সম্পাদনার কৌশলটিও বাহাদুরি পাবার মতো! কিন্তু কান-এর জুরি ওঁকে সরিয়ে সেরা পরিচালকের পুরস্কার দিয়েছিলেন মেক্সিকোর ফ্লেবার মেনদোনচা ফিলহোকে ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ ছবির জন্য। ছবিটি এই উৎসবেও ছিল। দেখলাম, আহামরি তেমন মনে হল না! তবে সম্ভবত মেক্সিকোর সুপারস্টার ওয়াগনার মৌরার উপস্থিতিটাই হয়তো ‘যাদু’র কাজ করে থাকবে! তিনিই কান্-এ জিতেছিলেন সেরা অভিনেতার সম্মান!
কী কারণে হাঙ্গেরির ছবি লাজলো নেমেসের ‘অরফ্যান’ অবহেলা পেল বুঝতে পারলাম না। ভেনিস ফেরত এই ছবি নিয়ে উৎসব উদ্যোক্তাদের মধ্যেও অনুচ্চারিত উৎসাহের আঁচও পেয়েছিলাম। পরিচালক লাজলো মাত্র একদিনের জন্য হাঙ্গেরিয়ান প্রিমিয়ার অ্যাটেন্ড করতে এসেওছিলেন মিসকোল্চ! ভালো লাগার তালিকায় রাখতেই হবে উদ্বোধনী ফরাসি ছবি সেড্রিক ফ্ল্যাপিসের ‘কলার অফ টাইম’ ছাড়াও জুলিয়া দুর্কন্যুর ‘আলফা’ (ফ্রান্স-বেলজিয়াম), ইয়োগোস লান্থিমোসের ‘বুগোনিয়া’, জার্মানির ‘হোয়াট মেরিলা নোজ’ (পরি: ফ্রেডরিখ হামবালেক), স্কারলেট জনসনের কমেডি ছবি ‘এলিনর দ্য গ্রেট’!
জজিয়তির কারণে পাঁচ দিনে আঠারোটি ফিচারের পাশাপাশি পাঁচ ঘণ্টার শর্ট-অ্যানিমেশনও দেখতে হয়েছে। বাদ পড়েছে কিছু ছবি। তবে বিশ্রামের শেষ দু’দিনে আমি দেখে নিয়েছি বুলগেরিয়ার স্টেফান কোমানদারেভের ‘মেড ইন ই-ইউ’ চিনের জিং য়ি-র ‘দ্য বোটানিস্ট’, ক্লোজিং ছবি হিসেবে এরিক পোপ্পের এক মাইলস্টোন ‘কুইসিলিং : দ্য ফাইনাল ডেজ’! এরিককে তো অনুরোধ জানিয়ে এসেছি আগামী বছর কলকাতার ফিল্ম উৎসবে আসতে। তিনি ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। দেখা যাক কী হয়!
একনজরে মিসকোল্চ উৎসবে পুরস্কার
সেরা ছবি
(এমেরিক প্রেসবার্গার সম্মান)
সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু
পরিচালক— জোয়াকিম ট্রিয়ার
গ্র্যান্ড প্রাইজ
(অ্যাডলফ জুকর সম্মান)
ক্রনোলজি অফ ওয়াটার
পরিচালক— ক্রিস্টিন স্টুয়ার্ট
ইস্ট অফ ইউরোপ সম্মান
উইন্ট, টক টু মি
পরিচালক— স্টেফান দোর্দেভিচ
সিআইসিএই জুরি সম্মান
দ্য প্রেসিডেন্টস কেক
পরিচালক— হাসান হাদি।
ফিপ্রেস্কি সম্মান
দ্য প্রেসিডেন্টস কেক
পরিচালক— হাসান হাদি
ইক্যুইম্যানিকাল জুরি সম্মান
দ্য প্রেসিডেন্ট কেক
পরিচালক— হাসান হাদি
অ্যাম্বাসাডর অফ ইউরোপিয়ান সিনেমা
এরিক পোপ্পে (নরওয়ে)
জীবনকৃতি সম্মান
রবার্ট কোলতাই (হাঙ্গেরি)
এবং পিটার টিমার (হাঙ্গেরি)
Advertisement



