ময়ূরী মিত্র
কিছু মাটি আর কিছু জলের মধ্যে খুব ভাব হয়ে গেল৷ জলের ভালো লাগল মাটিকে৷ মাটিরও জলকে৷ দু’জনে ঠিক করল তারা একসঙ্গে অনন্ত বাঁচবে৷ কিন্তু কী করে বাঁচবে তারা একসঙ্গে!
মাটি বলল— আয় জল তোকে আমার পেটে পুরে নিই৷ তাপ্পর দু’জনে পুকুর হয়ে যাই৷ আমরাও বাঁচব৷ মানুষেরও উপকার হবে৷ জানিস তো! মানুষ জীবজগতের শ্রেষ্ঠ জীব৷ তাকে সাহায্য করলে আমাদের বাঁচা শুধু অনন্ত নয়, অনন্যও হবে৷ জল ভ্রু কুঁচকে রইল৷ মাটি বলল— পছন্দ হল না আমার কথা? এই জল, বল না!
জল অন্যমনস্ক৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল— আমি তো শুকিয়ে যাব রে! বাতাস এসে আমায় শুকিয়ে দেবে৷ একটা খাবলা গর্ত হয়ে পচে মরবি৷ না তাতে সবুজ ফুটবে৷ না লোকের গেরস্থালির কাজ হবে৷
এইসব শুনে ওপর থেকে খুব চেঁচাল আকাশ :
এই জল! বোকার ধাড়ি! সূর্য যেমন তোকে শুকিয়ে ইস্ত্রি করা গেঞ্জি বানিয়ে দেবে আমার মেঘ বৃষ্টি হয়ে তোকে বাড়িয়ে দেবে৷ তোর বন্ধুর পেট ফের ভরে উঠবে৷ নে নে— আর দেরী করিস নে৷ ডবকা পুকুর হয়ে যা এখন৷ দাঁড়া একটু বৃষ্টি ফেলি তোর ওপরে৷
সেই থেকে দু’বন্ধু পুকুর হল৷ গাঁয়ের বৌরা জল নেয়৷ কাপড় কাচে৷ সংসারের গল্প করে৷ জল মাটি হাঁ করে মানুষের সংসারের জটিল কথা শোনে৷ তারপর রাতভোর ফিসফিস করে গল্প করে দুটোয়৷
শুধু বিকেলবেলা যখন একটা ছোট্ট মেয়ে পায়ে মল পরে পুকুরপাড়ে ঝুমঝুম দৌড়ে বেড়ায় খুব খুশি লাগে জল মাটির৷ দুই বন্ধুর তখন তিন হতে মন চায়৷ জল তো আর স্থলের জীবের পিছে দৌড়োতে পারে না৷ সে যদি বন্যা হয় তবে৷ পুকুর তাই কেবল উৎসুক চোখে মেয়েটার খেলা দেখে, নাচ দেখে৷
ভরাট পুকুরে আজ সাদা জোছনা৷ তাও জল কালোই দেখায়৷ এত ময়লা জমেছে হাজার বৃষ্টি হলেও জলের বমি আসে৷ মাটিকে বমন করতে নেই৷ সে শুধু ধারণ করে৷ তাই পেটের মধ্যে জলকে চেপে ধরে রাখে মাটি৷ আবর্জনা পুকুরের মৃদু স্রোত আটকে দেয়৷ দু’বন্ধু মানুষের বর্জ্যে পাগল হয়ে যায়৷ কিন্তু কিছুতে মরে না তারা৷ ওই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখার লোভে মরতে চায়ও না তারা৷
—এই মাটি! ওই দ্যাখ! রাতের বেলা পুকরের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লেগেছে যে মেয়েটা! আরে ডাক! ওর মাকে ডাক, মাটি৷ এ মেয়ে তো এখুনি আমার মধ্যে ঢুকে মরে যাবে! —জল কাঁদতে লাগল৷
মাটিও বিস্ফারিত তাকিয়ে:
জল তুই তবু বয়ে যেতে পারিস৷ আমি কেবল ধারণ করতে পারি৷ ফেলতে পারি নে৷ কী করি! কী করি আমি! পেট আমার কত বড় হয়ে গেছে রে মানুষের বর্জ্যে! শিশু কি শেষে আমার দানব পেটে সবার অগোচরে পচে গলে থাকবে! ওরে জল!
মা-টা তো মরা মেয়ের মুখটাও দেখতে পাবে না! ও জল তুই বরং আমা হতে উপচে যা৷ তারপর স্রোত হয়ে যা ওর মায়ের কাছে৷ গিয়ে বল— একটা মাত্তর সন্তান তাও কেন সে মরার জন্য ছেড়ে দেয়!
শেষপর্যন্ত মাটি বা জল কেউ পৌঁছতে পারেনি মেয়েটার মায়ের কাছে৷
ঘুমন্ত মা খবর পেল না তার মেয়েটা চলে গেল৷
শুধু পরদিন থেকে সবাই দেখল পুকুর শুকোতে শুরু করেছে দ্রুত৷
পুকুর যখন শুকনো জমি হয়ে গেল পড়ে রইল মল পরা একটা ছোট্ট কঙ্কাল৷
ঠিক যেন কাঠি কাঠি হাত-পা-ওয়ালা পুতুলটি,
শুধু পাঁজরের হাড়গুলো বড় স্পষ্ট। চোখের জায়গায় দুটো বড় গর্ত৷ কঙ্কালও জমির মতো শুকনো হয়ে গেল৷ একদিন বৃষ্টি নামল৷
মাটি জানত জল তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না৷
বৃষ্টির জলে মাটি গলে গলে বাচ্চা কঙ্কালের চোখের কোটরে ঢুকল৷ রোদ ঝলক দিল ভিজে মাটিতে৷ কঙ্কালের দুই চোখে দুটো বীজ৷
ছোট গাছ হয়ে যাবে মৃত শিশুর চোখ৷
জল মাটি হাসল৷
তারা আর বর্জ্যপুকুর নয়৷
শস্যক্ষেত্র৷
ও আমার প্রিয় সন্তানেরা— জগতের সব কঙ্কালের সঙ্গে তোমরা ভাব রেখো৷ জানো তো, কোনো এক কালে তারাও সব খেলত৷ রূপকথা পড়ত! ফুল তুলত ভোরের বেলা৷ ছিপ ফেলে পুঁটিও ধরত কত!
Advertisement
Advertisement
Advertisement



