• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

‘আত্মনির্ভর’ ভারতের স্বপ্ন

ঋণের দায় কমানোর জন্য দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ঠেলে উপরে তোলার জন্য যে পরিকল্পনা দরকার— তা হচ্ছে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পণ্য ও সেবার কর (জিএসটি) পরিবর্তন কিংবা মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পেও দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। কেন্দ্রের উদ্যোগে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে প্রচেষ্টা, তাতে কোনও কাঙ্খিত ফল দেখা যাচ্ছে না। পুজোর ব্যস্ত মরশুমে সংগঠিত ও অসংগঠিত শিল্পে নতুন চাকরির সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। কেন্দ্রের শ্রমমন্ত্রক ও জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (এনএসও) প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, নতুন কর্মসংস্থানের হারে ধীরগতি এবং কমে যাওয়ার প্রবণতা। বিরোধীরা এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে বলেছেন, বেকার যুব সমাজের মধ্যে এখন ডেলিভারি বয় বা অনিশ্চিত স্বল্প মূল্যের চাকরিই প্রাধান্য পাচ্ছে।

সংগঠিত শিল্পে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। শ্রমমন্ত্রকের ইএসআই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫ বছরের নীচে যুবক শ্রমিকের নতুন নিয়োগ গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় ৯.৬ শতাংশ কমেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ২২.৫ লক্ষ যুবক নতুন নিয়োগ পেয়েছিল, চলতি জুলাইয়ে তা কমে ২০.০৩ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। নতুন নিয়োগের মোট হারও ৪৮.৩৭ শতাংশ নেমেছে। একই সময়ে ইএসআই-তে নতুন ৩১,১৪৬টি সংস্থা নথিভুক্ত হলেও কর্মী নিয়োগের হার বাড়েনি।

Advertisement

কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পেও নিয়োগের হার কমছে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মোট কর্মী সংখ্যা ছিল ১৭.৩ লক্ষ, ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ১৪.৬৬ লক্ষ। এক দশকে প্রায় ২.৫ লক্ষ শ্রমিক কমেছে। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী, স্থায়ী নিয়োগে হ্রাসের কারণে এক দশকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার ৪২.৮ শতাংশ থেকে কমে ৩৭.৩ শতাংশে নেমেছে।

Advertisement

অসংগঠিত শিল্পেও অবস্থা আশানুরূপ নয়। করোনাকালীন লকডাউন, নোট বাতিল ও জিএসটি প্রভাবের কারণে ছোট ও মাঝারি কলকারখানা বন্ধ ও ধুঁকছে। এনএসও-র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে অংসগঠিত শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান ১৩.১ কোটি, এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে তা কমে হয়েছে ১২.৯ কোটি। প্রায় এক কোটি শ্রমিকের চাকরি এক ত্রৈমাসিকেই কমেছে। এই শিল্পে স্থায়ী কর্মীর হার অত্যন্ত কম এবং এঁদের সামাজিক সুরক্ষাও নেই।

ইতিমধ্যে ছোট শিল্পের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু কর্মী নিয়োগের হার বাড়েনি। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে নতুন শ্রমিক নিয়োগকারী সংস্থা ছিল ১৪ শতাংশ, এপ্রিল থেকে জুন মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩.৩ শতাংশ। নতুন কর্মী নিয়োগের হার ২৬.৯ শতাংশ থেকে ২৫.৪ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে, বিনা মজুরির কাজে যুক্ত শ্রমিকের হার বেড়ে ১৪.৯ শতাংশ থেকে ১৫.৪ শতাংশে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির অভাবে শ্রমজীবীদের বড় অংশ বিনা মজুরির কাজে যুক্ত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের অবহেলা ও পরিকল্পনা বিহীন পদক্ষেপের কারণে মানুষ ক্রমশই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, যা শিল্পে চাহিদা কমিয়ে নতুন নিয়োগের সম্ভাবনাও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

এদিকে ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর বার্তা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর অর্থ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে দেশকে। এ জন্য স্বদেশি পণ্য কেনাবেচার উপর জোর দিয়েছেন মোদী। এতেই ভারত সমৃদ্ধশালী হবে। গতি পাবে অর্থনীতি। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকবাহিনীর নিরন্তর প্রচার হলো, ভারত ইতিমধ্যেই চতুর্থ বৃহত্তর অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। আর কয়েক বছরের মধ্যে আরও একধাপ এগিয়ে তৃতীয় স্থান দখল করবে মোদীর ভারত। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, নিজের পায়ে দাড়ানোর বদলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দৌলতে নাগরিকদের ওপর ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রের সরকার চলছে ধারের টাকায়। এই ‘প্রকৃত সত্য’ তুলে ধরেছে দেশের সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বিরোধীরা একে ‘আচ্ছে দিনের ঋণ’ বলে কটাক্ষ করে বলেছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কর্পোরেট ও ধনী ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সাধারণ নাগরিকদের ঋণের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

সম্প্রতি সিএজি-র অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, দেশে ২৮টি রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ ২০১৩-১৪ সালের ১৭.৫৭ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৯.৬ লক্ষ কোটি টাকায়। তালিকার শীর্ষে রয়েছে পাঞ্জাব।

ঋণের দায় কমানোর জন্য দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ঠেলে উপরে তোলার জন্য যে পরিকল্পনা দরকার— তা হচ্ছে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। তাছাড়া পরিকাঠামো উন্নয়নের বদলে দান-খয়রাতি বা বহুবিধ প্রচারে লাগামছাড়া খরচ চলতে থাকলে ঋণ শোধের অর্থ কোথা থেকে আসবে, সেই প্রশ্নও উঠছে। একদিকে কেন্দ্রের করুণ আর্থিক দশা, অন্যদিকে রাজ্যগুলিকে ক্রমাগত আর্থিকভাবে বঞ্চিত করে ঋণ করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে মোদী সরকার। যেমন, সেস ও সারচার্জ বাবদ কেন্দ্রের প্রতিবছর আয় হয় ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ এর কোনও ভাগ পায় না রাজ্যগুলি। সদ্য জিএসটি-র হার কমায় রাজ্যগুলির যে ক্ষতি হবে, তা পূরণেও কোনও উচ্চবাচ্য করছে না কেন্দ্র। ফলে রাজ্যগুলি রাজস্ব হারাচ্ছে। রাজ্যগুলি থেকে কর বাবদ কেন্দ্র যা আদায় করে, তার ৪৫-৫০ শতাংশ অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিও মানেনি মোদী সরকার। উপরন্তু বাংলার মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যকে ভাতে মারতে কেন্দ্রের একাধিক প্রকল্পের ন্যায্য পাওনা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। টাকার অঙ্কে যা ২ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। এক কথায়, ন্যায্য পাওনা ও বঞ্চনার মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া করে দেওয়ার নীতি নিয়েছে মোদী সরকার। সব মিলিয়ে তাই আগামী দিনে সাধারণ মানুষের ওপর ঋণের বোঝা আরও বাড়বে, রাজ্যগুলি আরও বিপদে পড়বে। এটাই হলো মোদীর ‘আত্মনির্ভর’ ভারত।

Advertisement