বিদ্যুৎ ভৌমিক
প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে কত যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে, তা সত্যানুসন্ধানে ক’জন এগিয়ে আসে ? সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণে সরকারি কোন সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায় দেখা যায় নি। তবুও সব কিছু তোয়াক্কা না করে গ্রামাঞ্চলের কিছু উৎসাহী ফুটবলপ্রেমী মানুষ সেই সব প্রতিভা তুলে আনার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমনই এক পঞ্চাশোর্ধ মহিলা লড়াকু মানসিকতায় ভরপুর বাঁকুড়ার ভারতী মুদি এলাকার কয়েকজন সম্ভাবনাময়ী কিশোরী মেয়েদের নিয়ে নারীশক্তি জাগিয়ে তুলতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কোমরে কাপড় জড়িয়ে ইনষ্টেপ আউটষ্টেপে শট মারার কৌশল শেখাচ্ছেন ছাত্রীদের বাঁকুড়ার দুমদুমির মাঠে। বেশ কিছু উৎসাহী কিশোরী তরুণী ফুটবল ট্রেনিংকে পাথেয় করে অধীর আগ্রহে ফুটবলে মনোনিবেশ করে চলেছেন যা দেখে ফুটবলকে ভালোবাসতে মন চায়। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফুটবলে প্রাণের জোয়ার এসেছে।
Advertisement
বাঁকুড়ার এই পাড়াগাঁয়ে গত ১০ বছর যাবৎ একনিষ্ঠতায় নিজেকে গড়ে তুলে আদিবাসী কিংবা তপশিলী জাতি সম্প্রদায়ের কিশোরীদের সামাজিকবোধ গড়ে তোলার লড়াই চালাতে বদ্ধপরিকর প্রশিক্ষক ভারতী মুদি। অথচ একসময় এই গ্রামের কিশোরীরা ১৫ বৎসরে পা দিলেই স্কুলের মায়া কাটিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে তাদের বসতে বাধ্য করা হতো অথবা সংসারের আর্থিক অনটনের কারণে ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে চলে যেতেন। আজ সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। ভারতী সেই কিশোরী তরুণীদের নিজে হাতে গড়ে তুলে পড়াশুনার পাশাপাশি ফুটবল খেলার জগতেও সুনাম অর্জন করেছে।ভারতীর আদিবাসী সম্প্রদায়ের ১৫ জন ফুটবলার চাকরিও পেয়েছেন।
Advertisement
এই প্রশিক্ষণ শিবির থেকে খেলায় উন্নতি করে কলকাতায় কন্যাশ্রী কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন তানিয়া মুদি, দুলালী বাউরিরা । তাছাড়া কলকাতা মহিলা ফুটবল লিগে নজর কেড়েছেন ঝর্ণা মাজি, সন্ধ্যা হাঁসদা, সীমা মাল, রূপালী টুডু, রজনী বাউড়ি ও সোনালী টুডু প্রমুখেরা।
১৫ বছর আগে ভারতী যখন মেয়েদের নিয়ে দুমদুমির মাঠে ফুটবল খেলা শেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন গ্রামের অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের খেলার জন্য মাঠে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করতেন। তবে ভারতীর চাকরিজীবী স্বামী শক্তিপদ মুদি নিজের স্ত্রীকে সাহসী করে তুলতে নিজের তিন মেয়ে পূজা, তানিয়া ও কেয়াকে ফুটবল মাঠে নিয়ে এসেছেন। ভাইঝি মিতাকে অনুপ্রাণিত করেছেন ফুটবল খেলাতে। ভারতীর কথা, কাগজে আর টিভিতে দেখে জেনেছিলাম কলকাতায় মেয়েরা খেলছে ফুটবল লিগে। চাকরিও পাচ্ছে। মনে হয়েছিল আমাদের মেয়েরাও তো ফুটবল খেলে স্বাবলম্বী হতে পারে। আমাদের মেয়েরাও পরিশ্রমী। তাই ওরা পারবে। সেই ভেবে মনকে শক্ত করে ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির চালু করি। ভারতী আরও বলেন, মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে খেলছে, এটা গ্রামের অনেক মানুষই মেনে নেননি ।অনেকের কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবে আমার মেয়েদের দেখে ধীরে ধীরে অনেকেই তাদের মেয়েদের পাঠাতে থাকেন দ্বিধাবোধ কাটিয়ে। এখন নিয়মিত ২৫ টা মেয়ে খেলে। শুধু বাঁকুড়া নয় পুরুলিয়ার মেয়েরাও ফুটবল খেলতে আসে।
ভারতী মুদি এক সময় অ্যাথলেটিক্সে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সেইভাবে নজর কাড়তে পারেন নি। কোনওদিনই ফুটবলার ছিলেন না বটে, ফুটবলকে ভালোবাসতেন। সংসারের চাপে বেশিদূর যেতে পারেন নি। ভারতীর স্বামী শক্তিপদ ফুটবলে রেফারিং করতেন।.তাই.দুজনেরই ইচ্ছে ছিল, মেয়েদের ফুটবলার তৈরি করবেন। সেই স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে।
ভারতী কোচিং করিয়ে কোন অর্থ নেন না। দূরের মেয়েদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ভারতী জানেন মেয়েরা টুর্ণামেন্ট খেলে আর্থিক পুরস্কারের যে টাকা পায়, সেই টাকা আর আমার স্বামীর দেওয়া টাকাতেই খুবই কষ্টের মধ্যে দিয়ে আমাদের ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির চলে। বাঁকুড়ার মতো আদিবাসী প্রধান এলাকায় কিশোরী তরুণীদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে ভারতী মুদির এই অসম লড়াইকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। তাঁর
এই জুড়ি।
Advertisement



