• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

অপরাধী ইজরায়েল

রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের প্রধান ছিলেন নবী পিল্লাই। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক আইনজ্ঞ।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতির আলোচনা বারংবার ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তুমুল প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই গাজায় গণহত্যার নৃশংস অভিযান আরও তীব্র গতিতে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থী সরকার। এই প্রেক্ষাপটে, অধিকৃত প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল বিষয়ক রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরপেক্ষ অনুসন্ধান কমিশনের এক নতুন রিপোর্ট সামনে আসায় রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। গাজায় যে আক্ষরিক অর্থেই গণহত্যা চলছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ তা আগেই একাধিক রিপোর্টে মেনে নিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীনস্ত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত গত বছরে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। তবে এই প্রথম নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য-প্রমাণ সমেত গাজা শহরে ইজরায়েলের দু’বছর ব্যাপী ‘সামরিক অভিযান’কে স্পষ্টত ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করেছে।

তাঁরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সনদে ‘গণহত্যা’-র যা চরিত্র বর্ণিত রয়েছে, তার সব কিছুই গাজায় বিদ্যমান। পরিকল্পিতভাবে একটি নির্দিষ্ট জাতিকে মুছে দিতে সামরিক বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। কোনও বাছ-বিচার না করে, একাধারে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গাজায় গণহারে হত্যা করা হয়েছে। এই গণহত্যা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মহলের একজোট হয়ে ইজরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। এছাড়াও এই গণহত্যার যাঁরা মুখ্য সংঘটক তাঁদের আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অবিলম্বে আনা উচিত বলে অনুসন্ধান কমিশনের রিপোর্ট লেখকরা জানিয়েছেন।

Advertisement

রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের প্রধান ছিলেন নবী পিল্লাই। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক আইনজ্ঞ। কমিশনে মোট ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁদের কাউকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিযুক্ত করেনি, বরং তাঁরা সদস্য দেশগুলির জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দ্বারা মনোনীত হয়েছেন। রিপোর্টটি প্রকাশ করে নবী পিল্লাই বলেছেন, ‘কমিশনের বিশদ অনুসন্ধানে চলতি গণহত্যায় ইজরায়েলের সদিচ্ছা, পরিকল্পনা এবং ভূমিকার বিশেষ প্রমাণ মিলেছে। গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের মুছে ফেলার এক সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় স্পষ্ট। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীনস্ত গণহত্যা কমিশনে গৃহীত সনদে যাবতীয় মানদণ্ডের সঙ্গে তা মিলে যায়।’

Advertisement

সম্প্রতি জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্যরা জানান, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইজরায়েল সরকার ও সেনাবাহিনী ‘সন্ত্রাসবাদ দমনে’র নামে যা শুরু করেছে, তা কোনও মতেই অন্য যে কোনও সংঘাত বা যুদ্ধের সঙ্গে এক করা যায় না। ১৯৪৮-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘের গণহত্যা প্রতিরোধ ও দমন সম্পর্কিত কনভেনশনে গৃহীত গণহত্যার পাঁচটি চরিত্রের মধ্যে চারটিই গাজায় বিদ্যমান। এই চারটি চরিত্রের মধ্যে রয়েছে— নির্দিষ্ট জাতিগত পরিচিতির মানুষকে গণহারে হত্যা করা, গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে এমন সমস্ত শর্ত চাপিয়ে দেওয়া যা এক নির্দিষ্ট জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য রাখে এবং জন্ম প্রতিরোধের মাধ্যমে সেই জাতির জনসংখ্যা বিস্তার আটকানো।
পিল্লাই আরো জানিয়েছেন, ইজরায়েল সরকারের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সেনাকর্তারা একাধিকবার প্যালেস্তিনীয়দের ‘সাফ’ করে দেওয়ার নিদান দিয়েছেন। এতে প্রমাণ হয়, এই হত্যা মোটেই অনিচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি। ইজরায়েল সরকারের সদিচ্ছায় এই নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই গণহত্যায় ইজরায়েল সরকারের প্রত্যক্ষ দায় রয়েছে।

শুধু হত্যাই নয়, কমিশনের রিপোর্ট আরও বলেছে, গাজায় গত কয়েক মাস ধরে ত্রাণ সরবরাহ আটকে রেখেছে ইজরায়েল। খাবার, জরুরি ওষুধপত্র, পানীয় জল ইত্যাদি আটকে রেখে প্যালেস্তিনীয়দের ‘ভাতে মারার’ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে চার শতাধিক মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছেন গাজায়। এঁদের অধিকাংশই শিশু। আরও হাজার হাজার মানুষ অপুষ্টিতে আক্রান্ত। ইজরায়েল ঘনিষ্ঠ যে একটি সংস্থাকে ত্রাণ বিলির একচেটিয়া বরাত দেওয়া হয়েছে, তারা ত্রাণ কেন্দ্রের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে বুভুক্ষু মানুষের উপর বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে।

এই সমস্ত কিছুই পরিকল্পিত গণহত্যার সাক্ষ্য বহন করছে বলে জানিয়েছেন নিরপেক্ষ অনুসন্ধান কমিশনের সদস্যরা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় এখনও অন্তত দশ লক্ষ মানুষ বসবাস করছেন। সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি চলছে। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত বেপরোয়া বোমা বর্ষণের শিকার হচ্ছেন। বেঁচে থাকার সামান্যতম উপাদানগুলির থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতের একাধিক নির্দেশ অমান্য করে চলেছে ইরজায়েল। গত ২০২৪ সালের মার্চ মাসে গাজায় সাধারণ বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ইজরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত। এই নির্দেশ তোয়াক্কা না করে উল্টে গাজার সাধারণ বাসিন্দারা যাতে সমস্ত রকম মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন, সেটাই নিশ্চিত করেছে ইজরায়েল।

 

Advertisement