জিএসটি-তে ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। নাম দিয়েছে ‘দীপাবলির তোফা’। স্বাস্থ্য পরিষেবা, ভোগ্য পণ্য, কৃষিজ পণ্য, পোশাক, বৈদ্যুতিন পণ্য, যন্ত্রাংশ সহ নানা ক্ষেত্রে এই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আবার ‘মাস্টার স্ট্রোক’-এর বুলি সমেত প্রচারে নেমেছে বিজেপির আইটি সেল থেকে গোদী মিডিয়া। ভোট চুরির অভিযোগ, এসআইআর নিয়ে তীব্র ক্ষোভ এবং বিহার নির্বাচনের অঙ্ক মাথায় রেখেই যে মোদী সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে বিশ্লেষকদের মতে এর আড়ালেই অন্য অভিসন্ধি রয়েছে।
জিএসটি সংক্রান্ত ঘোষণার দিন দুয়েক আগে সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশাল মিডিয়ায় একাধিকবার বিস্ফোরক দাবি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, মোদী সরকার নাকি ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যের উপর আমাদানি শুল্ক আগাগোড়া মকুব করে দেওয়ার ‘অফার’ দিয়েছে। বলা বাহুল্য, ট্রাম্পের দাবি সত্যিই যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে ভারতের কৃষক, খেতমজুর ও খুচরো ব্যবসায়ীরা কার্যত উচ্ছেদের মুখোমুখি হবেন। শ্রমিকরা গণ ছাঁটাইয়ের শিকার হবেন।
Advertisement
ভারত আমেরিকাকে ‘জিরো ট্যারিফ অফার’ দিচ্ছে বলে ট্রাম্পের বিস্ফোরক দারির পরেই মোদী সরকারের জিএসটি ছাড়ের ঘোষণার মধ্যেই রহস্য উন্মোচন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, আগামী দিনে ভারত আমেরিকার থেকে আমদানিকৃত সমস্ত পণ্যে শুল্ক মকুব করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। একথা সত্যি হলে দেশীয় উৎপাদকদের জন্য ভয়াবহ দুর্দিন আসতে চলেছে। ঘরোয়া বাজারে মার্কিন পণ্যের দাম হুহু করে কমবে। ঘরোয়া বাজারে দেশিয় উৎপাদকরা যে সুবিধা পেয়ে থাকে, তা তারা হারাবে। বৃহৎ পুঁজির মার্কিন রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা স্বাভাবিকভাবেই পেরে উঠবে না। তাদের পুষিয়ে দিতেই কি জিএসটি-তে ছাড় দেয়ো হল? তার মানে বকলমে জিএসটি-তে ছাড় কি স্পষ্ট ইঙ্গিত— ট্রাম্পের হুমকি মেনে মোদী সরকার মার্কিন পণ্যে আমদানি শুল্ক মকুব করতে চলেছে? উঠছে এমন সব নানা প্রশ্ন।
Advertisement
এই নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আশঙ্কা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় সরকার আচমকা জিএসটি ছাড়ের কথা ঘোষণা করে। আপাতদৃষ্টিতে এতে ঘরোয়া বাজারে দেশে উৎপাদিত ভোগ্য পণ্যের দাম কমবে, শিল্পের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনের খরচও বেশ কিছুটা কমবে। অর্থাৎ দেশীয় উৎপাদকরা কিছুটা লাভবান হবেন। প্রসঙ্গত, আয়কর মকুব বা কর্পোরেট করে ছাড় দেওয়ায় প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের হার দেশে বছর বছর কমছে। রাজস্ব বাবদ আয়ে ভারত সরকার বর্তমানে প্রায় সঙ্কটের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতিতে জিএসটির মতো পরোক্ষ করই রাজস্ব আদায়ের মুখ্য মাধ্যম। এতেও মোদী সরকার ছাড় দেওয়ায় রাজস্ব বাবদ আয় আরও কমে যাওয়ায় সামাজিক বা অন্যান্য খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ আরও কমে যাবে।
আর্থিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশীয় উৎপাদকদের আগেভাগে পুষিয়ে দিয়ে কেন্দ্র আসলে আগামী দিনে মার্কিন পণ্যে আমদানি শুল্ক মকুব করার রাস্তা পাকা করছে। জিএসটি ছাড়ে সরকারের আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও উৎপাদনী ক্ষেত্রে সরকারের ব্যায় করার ক্ষমতাও কমবে। অর্থাৎ সরকারি মদতপ্রাপ্ত নানা ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উৎসাহ ভাতা কমবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, পরোক্ষ করে ছাড় দিয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করলে দীর্ঘমেয়াদে ঘরোয়া উৎপাদন কমতে বাধ্য। তার ফলে দেশের অর্থনীতি আরও বেশি ভোগ নির্ভর হয়ে উঠবে। উৎপাদন কমলে রপ্তানি কমবে এবং একই সঙ্গে আমদানি প্রতিস্থাপনের সুযোগ কমবে। পরোক্ষ করে ছাড় না দিয়ে নানাভাবে ঘরোয়া বাজারে চাহিদা বাড়ানো সম্ভব। ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে, প্রান্তিক অংশে নগদ হস্তান্তর বাড়িয়ে এবং কৃষকদের পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়িয়েও বাজারে চাহিদা বাড়ানো যায়। কর্পোরেট কর বৃদ্ধি করে, সম্পদ কর ও উত্তরাধিকার কর চালু করে রাজস্ব আদায়ের সঙ্কট মোকাবিলা করা সম্ভব।
Advertisement



