শোভনলাল চক্রবর্তী
দিল্লি পুলিশের লোদী কলোনি থানা কয়েক জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে পাকড়াও করেন। তাঁদের কাছে ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় যে সব সরকারি নথি মেলে, তা অনুবাদ করতে সাহায্য চেয়ে থানার অফিসার দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথিশালা বঙ্গভবনে চিঠি দেন।দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমন হাতিয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতছাড়া করেননি। তিনি স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে অপমান করার অভিযোগ তুলেছেন।
Advertisement
ধরা যাক, দিল্লি পুলিশের এত দুরভিসন্ধি ছিল না। পুরোটাই অজ্ঞতা। পুলিশ সত্যিই মনে করেছে, বাংলা ও বাংলাদেশি আলাদা ভাষা। বাংলাদেশের সরকারি নথিতে নাম-ধামও হয়তো সিলেটি বা বরিশাইল্লাতে লেখা রয়েছে! যদি তা-ই হবে, তা হলে সেই ‘বাংলাদেশি ভাষা’ অনুবাদের জন্য দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনের বদলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গভবনের সাহায্য চাওয়া হল কেন? মুশকিল হল, এর পরে অমিত শাহের দিল্লি পুলিশকে বাঁচাতে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য মাঠে নামলেন। দাবি করলেন, বাংলাদেশি ও বাংলা বাস্তবেই আলাদা ভাষা। ভারতের বাঙালিরা সিলেটি বোঝেন না। আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করলেন, ‘বেঙ্গলি’ বা বাংলা বলে কোনও ভাষাই নেই।
Advertisement
প্রসঙ্গত বলা থাক, অমিত ম্যালব্য শুধু বিজেপি আইটি সেলের প্রধান নন। তিনি বহু বছর ধরে বিজেপির সংগঠনে পশ্চিমবঙ্গের সহ-ভারপ্রাপ্ত নেতা। অথচ তাঁর জানা নেই, বাগবাজার ও বাঁকুড়ার মানুষের কথার উচ্চারণ ও টান আলাদা। তা বলে ভাষাটা আলাদা হয়ে যায় না।
বিজেপির আইটি সেলের প্রধান ভুলে যেতেই পারেন, এই বাংলা ভাষার উপরে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। সেই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালিত হয়। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন কী ভাবে যে গত বছর অক্টোবরেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার বাংলাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার তকমা দিয়েছে?এই স্মৃতিবিলোপ, অজ্ঞতা বা মূর্খামি, যা-ই বলুন না কেন, তার ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের পরে পশ্চিমবঙ্গেও ভাষা নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার বোকামি করেছে বিজেপি।
আসলে সমস্যাটা অন্যত্র। বিজেপির এই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অজ্ঞতার কারণ, হিন্দি নিয়ে বিজেপি, বিশেষত আরএসএসের মোহগ্রস্ত হয়ে থাকা। বাংলা-তামিল-মরাঠিকে নস্যাৎ করা ও হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়া, একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। অমিত শাহ এখন হিন্দির পক্ষে নিয়মিত সওয়াল করেন। এও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে ইংরেজি বলিয়ে-কইয়েরা লজ্জা বোধ করবেন। যদিও বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পড়াশোনা করে। হিন্দি বলয়ে রাজনৈতিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত বিজেপি নেতৃত্ব মনে করেন, উত্তর ভারতের সীমানা ছেড়ে পূর্ব ও দক্ষিণে হিন্দি যত ছড়াবে, ততই বিজেপির সাম্রাজ্য বাড়বে। আরএসএসের ‘গুরুজি’, দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার মনে করতেন, ইংরেজি ভারতীয় ভাষা নয়। হিন্দিকে দেশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রাধান্য দিতে হবে। যত দিন না সংস্কৃত যোগাযোগের ভাষা হয়ে ওঠে। ষাট বছর আগে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, এক দিন সংস্কৃত ভারতের যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠবে।
বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত গত সপ্তাহেও সেই একই স্বপ্নের কথা বলেছেন। আরএসএসের এই ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ হল, ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’। গোটা হিন্দুস্থানের একটাই ধর্ম, হিন্দু, একটাই ভাষা, হিন্দি। মোদী সরকারের তৈরি ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’-র মাধ্যমে এই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেবিরোধীদের অভিযোগ।গোলওয়ালকর বরাবরই তামিল ও দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের সমালোচক ছিলেন। তামিল ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্বতার দাবি তাঁর পছন্দ ছিল না। তাৎপর্যপূর্ণ, এই নরেন্দ্র মোদী-মোহন ভাগবতের জমানাতেও তামিলনাড়ুতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা সবচেয়ে প্রবল। বাংলাকে বাংলাদেশি ভাষা বলার বিরোধিতাতেও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন সরব হয়ে বলেছেন, এ হল বিজেপির অ-হিন্দি ভাষার উপরে আক্রমণ। বিজেপির ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মানসিকতার প্রতিফলন। যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত লেখা হয়েছে, সেই ভাষার অপমান। দক্ষিণের রাজ্য কেরলেও কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দি জানাকে অগ্রাধিকার দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছে।
কর্নাটকেও প্রশ্ন উঠেছে, কেন হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে তুলে ধরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? উত্তর-পূর্বে আগেই হিন্দি ভাষা চাপানো নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। মহারাষ্ট্রে স্কুলে হিন্দি ভাষাকে তৃতীয় ভাষা হিসেবে শেখানো বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার। এই হিন্দির বিরোধিতার মঞ্চকে কাজে লাগিয়ে মরাঠি অস্মিতার মন্ত্রে দুই বিবদমান খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাই উদ্ধব ও রাজ ঠাকরে আবার হাত মিলিয়েছেন।বিজেপি কি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একই ভাবে তৃণমূলের হাতে ‘বাঙালি অস্মিতা’-র ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিল? হয়তো। হয়তো নয়। তার উত্তর সময় দেবে। তবে হিন্দিতে মোহগ্রস্ত হয়ে থেকে বাংলা, মরাঠি, তামিলকে নস্যাৎ করতে বসা বিজেপিকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ২০১১-র জনগণনায় দেখা গিয়েছিল, সেই সময়ের ১২১ কোটি জনসংখ্যার ৫২.৮ কোটি হিন্দিভাষী। তবে তার মধ্যে ভোজপুরি, ছত্তীসগঢ়ি ও কুমাউনি ভাষাভাষী ২০.৬ কোটি মানুষও রয়েছেন। এই সব ভাষাকেও হিন্দির প্রকারভেদ হিসেবে ধরা হয়েছিল। তা বাদ দিলে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা ৩২ কোটিতে নেমে যায়।
জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। অমিত মালব্যর জন্ম উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে, অধুনা প্রয়াগরাজে। এই উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমের গাজিয়াবাদ থেকে পূর্বের গোরক্ষপুর পর্যন্ত রাস্তা ধরে গেলে দেখা যাবে, প্রতি ৫০ কিলোমিটার অন্তর হিন্দির ধরন, উচ্চারণ, টান বদলে যাচ্ছে। মথুরা, লখনউ, বারাণসীর স্থানীয় মানুষের হিন্দির অনেক ফারাক। খড়ি বোলি, ব্রজভাষা, বুন্দেলি, কনৌজি, হরিয়ানভি, বাঘেলি, অবধি এবং হিন্দি-উর্দুর মিশ্রণে তৈরি হিন্দুস্তানি— হিন্দির নানা রূপ। বলিউডের সিনেমা দেখে হিন্দি শেখা অনেকেরই এ সব বুঝতে অসুবিধা হবে। তা হলে কি হিন্দি বলেও কোনও ভাষা নেই? না কি এ বার হিন্দি ও হিন্দুস্তানি আলাদা ভাষা বলে দাবি করবে বিজেপি! বাংলা ভাষাকে কেন বাংলাদেশি বলা হবে, এই নিয়ে এখন উত্তাল রাজ্য। আটাত্তর বছরের পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে বাঙালির সম্মান ও অধিকার রক্ষা করতে পারে, দেখা যাক।
‘বাঙালি অস্মিতা’ কথাটার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সৌজন্য’-এ এখন দলীয় রাজনীতির কড়া গন্ধ, কিন্তু তবুও, এত বড় শব্দ চয়ন না করেও স্পষ্ট বলা চাই: বাংলা-বাঙালির মানমর্যাদার প্রশ্নটা এখন অত্যন্ত জরুরি করে তোলা দরকার— শুধু ভোটের রাজনীতিতে নয়, আরও বড় করে প্রতি দিনের রাজনীতিতে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের বার্তা: কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা-সাম্রাজ্যবাদী অভিযান ঠেকাতে হবে এখনই।কিন্তু এই লড়াইয়ে (বা, এই রাজনীতিতে) অন্য একটা কথাও এসে পড়ে যে! ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের জের তো দেখছিই, পরীক্ষায়, সরকারি কাজে আঞ্চলিক ভাষার বদলে হিন্দি চাপানো হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা, হরিয়ানা দিল্লি রাজস্থান মহারাষ্ট্রে বাঙালিদের উপর যে নির্যাতন চলছে, তামিল তেলুগু ওড়িয়াদের উপরে কিন্তু তেমন নেই। কেন, সেটা ভাবতে গিয়ে স্ট্যালিনের কথাটা ‘ঠিক’ হলেও ‘যথেষ্ট’ নয়। না, এ শুধু ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের বিষয় নয়। ভিন রাজ্যে বহু ‘বাঙালি’ কাজ করছে অনেক কাল ধরে। আজ যা ঘটছে, তার মূলে যে তীব্র ক্রোধ, বিদ্বেষ, ঘৃণার বিষাক্ত উদ্গিরণ, কার দিকে তার অভিমুখ, সেও কি আর বলে দিতে হয়? আজ্ঞে হ্যাঁ। মুসলমান। সত্যিটা এখানেই। বাংলা/বাঙালির উপর আজ যে দেশজোড়া আক্রমণ, তার প্রধান কারণ, বাঙালির সঙ্গে মুসলমান পরিচয় আজ এক হয়ে যাচ্ছে। বাংলাভাষী মানেই মুসলমান, তাই, হয় সে বাংলাদেশি, নয়তো এখনই তার বাংলাদেশি হওয়া উচিত। এর মধ্যে যতটা ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’, ততটাই, বা তার থেকে বেশি ‘হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ’।
এই ভাবনা থেকেই দিল্লিতে অমিত মালবীয় বলেন, বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই, আছে কেবল বাংলাদেশি ভাষা। আর পশ্চিমবঙ্গে বসে, মুসলমান মানেই যথেষ্ট বাঙালি নয়— এটা বোঝাতে শমীক ভট্টাচার্য বলেন, হিন্দুর বাংলা আর মুসলমানের বাংলা আলাদা। যেন তিনি বা তাঁরা আদৌ বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবিত! যেন তাঁদের আদৌ সেই ভাবনার অধিকার আছে! যেন মুসলমান কাঁটা ওপড়ানো আর সেই সূত্রে সমগ্র বাঙালি সমাজের উপর চাপ দেওয়া ছাড়া তাঁর ও তাঁদের আর একটিও কাজ আছে। যারা মুসলমান, তাদের আলাদা বা ‘অপর’ করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র চাই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, সেই অস্ত্র বানিয়ে নিতে হবে বাংলা ভাষাকে। আর পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে, সেই বাংলা ভাষাকেই অস্ত্র করে মুসলমানকে কেটে ফেলে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অমুসলমান বাঙালিও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আরও পড়বে, কেননা পুরো পশ্চিমবঙ্গের উপরেই এখন বিজেপি ভারত ক্রোধান্ধ।
তবে আক্রমণের মূল লক্ষ্য কে বা কারা, তা নিয়ে সন্দেহ চলে না। এই পরিস্থিতিতে বাঙালি মুসলমান কী করবে, এটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু বাঙালি হিন্দু কী করবে, সেটা আরও বড় প্রশ্ন। চার দিকে এখন সাজো-সাজো রব, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্তিমিত, প্রায় অস্তমিত, প্রবাহ যেন আবার গতি পেয়ে প্রবল বেগে বহমান। সেই স্রোতে এই কথাটাকেও কিন্তু সমান গুরুত্বে, সমান সম্মানে ভাসতে দিতে হবে, এড়িয়ে গেলে চলবে না যে— বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান বাঙালি সমাজ ও বাংলা ভাষার সমান অংশীদার, ‘স্টেক-হোল্ডার’। এ কোনও জনসংখ্যার শতাংশের হিসাব নয়, এটা অনেক শতকের ইতিহাসের হিসাব, এই ভাবেই বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে, এ কোনও কাব্যসাহিত্য সঙ্গীতসংস্কৃতির সত্য নয়, এটা একেবারে মাটির সত্য, শ্রমের-ঘামের সত্য, গ্রামজীবন শহরজীবনের প্রাত্যহিকতার সত্য।এর পরেই যে প্রশ্নটা ধেয়ে আসছে, তার উত্তরটা এখনই দিয়ে রাখা দরকার। হ্যাঁ, দেশভাগ আর বাংলাভাগের পরও এই হিন্দু-মুসলমান যৌথ বা মিশ্র চরিত্রটা রয়েই গিয়েছে বাংলা ও বাঙালির মধ্যে। ১৯৪৭-পূর্ব অবিভক্ত বাংলার মতোই ১৯৪৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গেও অগণিত মুসলমান বাঙালির বাস— স্বাভাবিক ভাবেই, কেননা পাকিস্তান দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে দিন যে দেশভাগ হয়, তাতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রতিশ্রুতিটিই জ্বলজ্বল করছিল। তার চেয়েও বড় কথা, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর অনুপাত বদলালেই ভাষা সংস্কৃতি সমাজের চরিত্র বদলে যায় না। অনেক দিনের পাশাপাশি চলার ফলে তা তৈরি হয়। বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে আজ সংখ্যালঘুর সংখ্যা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেলেও দুই দিকেই বাঙালি জীবনের হিন্দু-মুসলমান মিলিত ঐতিহ্য খোদাই করা থাকবে।
ঠিক এই কারণেই, পরাধীন ভারতে ধর্ম-ধর্ম উন্মাদনার পরও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ-ভাগাভাগিটা সম্পূর্ণ করা যায়নি, কেননা ওই ভাবে মাটির ভিতরে শিকড়ে-শিকড়ে জড়ানো সমাজ-সংস্কৃতি উপড়ে ফেলা অসম্ভব। উনিশশো বিশ-ত্রিশ-চল্লিশের দশকে বাংলার ইতিহাস এও বলে, সে দিন যখন ধর্মের অন্ধতা তীব্র হয়ে উঠছিল, তখন বাঙালির এক বিরাট অংশ— হিন্দু ও মুসলমান দুই সমাজেই— এই ভাষাসংস্কৃতির যোগের জোরে বাংলা সত্তার কথা বলছিলেন। দেশভাগের পরিকল্পনায় বড় বাধা ও বিরোধিতা তৈরি হয়ে উঠেছিল বাংলাতেই, ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা উঠে এসেছিল প্রবল ভাবে, যে কথাগুলি ব্রিটেন ও দিল্লির যুগপৎ ঔপনিবেশিক চাপে দ্রুত হারিয়ে যায়। বাংলাই সেই ভাষা-সংস্কৃতি, যা নিয়ে পোস্ট-কলোনিয়াল যুগেও ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ দেখেছে এই উপমহাদেশ। এই সব ইতিহাস আজ ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে, অনেক চ্যালেঞ্জ ও সংঘাত মধ্যেও ১৯৪৭-এর পর ভারতীয় রাষ্ট্র দিতে চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষানিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার পরিসর। আর এখন আমরা দেখছি উগ্র অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদে ফেরার ডাক। সেই ডাক এখন পশ্চিমবঙ্গেও। ঠিক যেমন ইসলামি মৌলবাদ বার বার বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দু’ বলে দাগিয়ে উর্দু চাপানোর চেষ্টা করেছে, আজ হিন্দু মৌলবাদ বাংলা ভাষাকে ‘মুসলমান’ বলে দাগিয়ে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা করছে। শমীক ভট্টাচার্যরা মুখে যতই বলুন, এই বাংলাকে ‘বাংলাদেশ হতে দেব না’, আসলে ঠিক উল্টোটাই তাঁরা করছেন, বাংলাদেশের মধ্যে আজ যে উগ্র ইসলামি রাজনীতি, তারই আয়না-প্রতিফলন তাঁদের ভাবনায়। সুতরাং, এ কেবল বাঙালি অস্মিতার সাংস্কৃতিক প্রশ্ন নয়। ভাষা-সংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার চলছে, চলুক। তবে, এটা এখন পশ্চিমবঙ্গেরই অস্মিতার রাজনৈতিক প্রশ্ন। তাই বিচারটাকে হতে হবে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কোন রাজনীতি চাই, কোনটা চাই না, সেইটাই আজ আসল কথা।
Advertisement



