• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

নাগরিক নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে অমৃতকালের ভারত

কেন তারা এমন ভাবছে? দু-একটি ঘটনায় মাত্র? না। এই শতকের নির্মমতম, ভয়াবহতম রিসেশনের ধাক্কাও ততদিনে লেগেছে। ওয়াল স্ট্রিটে দেখা যাচ্ছে আলতো চিড়।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রবীর মজুমদার

ভারতের স্বাধীনতার উপলক্ষ্য সামনে এলেই মনে পড়ে যায় ১৮৫৭ সালের এক বছরের দেশব্যাপী সেই মহাসংগ্রামের রক্তরাঙা ইতিহাস। তাতিয়া তোপি, লক্ষ্মীবাইয়ের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের কাহিনি। প্রফুল্ল চাকি ক্ষুদিরামের কথা। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বুড়িবালামের তীরে এক অসম যুদ্ধে বাঘা যতীনের আত্মদানের গা শিউরে ওঠা বর্ণনা। ইংরেজ শাসকের জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘেরা প্রাঙ্গনে নৃশংস গণহত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতা। তারপর স্মরণ করতে থাকি কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং ঠাকুর আর আসফাক্‌উল্লার ফাঁসির দড়িকে আবাহন কাহিনি! স্মৃতির ক্যানভাসে দেখতে পাই চন্দ্রশেখর আজাদ ভগৎ সিং-দের স্বপ্নিল সংগ্রাম, সূর্য সেনের নেতৃত্বে ইংরেজ শাসনকে জানানো চুনোতি, বাঘের ডেরায় প্রীতিলতার হানা, বিনয় বাদল দীনেশের প্রত্যক্ষ বিবাদী সঙ্ঘর্ষ।

Advertisement

সত্যি সত্যিই যাঁরা ব্রিটিশ তাড়ানোর জন্য লড়াই করেছিলেন, তাঁরা ১৯৩০ সালের পর থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস বলে মেনে এসেছেন। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকারও তো ওই দিনটাকেই স্বাধীনতা দিবস বলে পালন করেছিল। তাহলে ১৫ আগস্ট কেন স্বাধীনতা দিবস হল, পরে ২৬ জানুয়ারিকে কেন প্রজাতন্ত্র দিবসের সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হল? কী ১৫ আগস্ট তারিখটার বিশেষ তাৎপর্য? উত্তরটা জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ দিনটা ঠিক করে দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ‘কারণ ওইটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জাপানিদের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দিন।‘ রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘গাঁধী-উত্তর ভারতবর্ষ’ বইতে এ কথা লিখে আরও জনিয়েছেন, ‘অনেকে চেয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখেই ক্ষমতা হস্তান্তর হোক, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন নিজে এবং যাঁরা ক্ষমতায় আসনে বসবার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা দেরি করতে চাননি।’ স্বাধীন-পরাধীনে কী মধুর সমঝোতা!

Advertisement

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাউন্টব্যাটেন ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুপ্রিম অ্যালায়েড কমান্ডার। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার সামরিক কৃতিত্বের দুর্লভ ভাগীদার। তিনি যদিও আসল কাজটা করেছিল আমেরিকানরা। তাঁর শখ, ভারতের স্বাধীনতার দিনটি তাঁর এই ব্যক্তিগত কৃতিত্বের স্মারক হয়ে থাকুক! অবাক কাণ্ড! যাঁরা স্বাধীনতা পেলেন, তাঁর মাউন্টব্যাটেনের এই শখ মেটানোয় সামিল হলেন! একটু দুষ্টুমি করে রামচন্দ্র গুহ জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট নাকি জ্যোতিষ মতে শুভ ছিল না, তাই ঠিক হয়, ১৪ আগস্ট থেকেই উৎসব অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। একদিন বাড়তি উৎসব পাওনা হলে মন্দ কী!
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ভারত আসলে স্বাধীনতা পায়নি; পেয়েছিল কমনওয়েল্‌থের অধীনে ডোমিনিয়ন মর্যাদা। তখনও রাজা ষষ্ঠ জর্জ ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রধান। স্বাধীনতা ভারত পেয়েছিল ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি, যখন সংবিধান গৃহীত হল। তখন ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া হয়ে উঠল রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়ার ক্ষমতার আসনে বসবার জন্য যাঁরা প্রস্তুত হয়ে ছিলেন তাঁরা কারা? গান্ধি তাঁদের ধারেকাছে ছিলেন না। ১৫ আগস্টকে যখন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে নির্বাচন করা হল, গান্ধি বলেছিলেন, ওই দিনটা আমি নোয়াখালিতে কাটাব। তার আগে, আগস্টের গোড়ায় তিনি শ্রীনগর গেলেন। জম্মু-কাশ্মির তখন রাজা হরি সিংহের খাস তালুক। কাশ্মির কি ভারতে আসবে? নাকি পাকিস্তানে যাবে? নাকি স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকবে? গান্ধিজির স্পষ্ট উত্তর: ‘সেটা কাশ্মিরিরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী স্থির করবে।’ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। ৬ তারিখে গেলেন লাহোর। তারপর ১১ আগস্ট এলেন দাঙ্গা-দীর্ণ কলকাতায়। সেখানকার অবস্থা দেখে বললেন, নোয়াখালি নয়, আমি থাকব কলকাতায়, যতদিন না ‘ভারতের এই সর্বগ্রগণ্য শহর তার পাগলামি ছেড়ে প্রকৃতিস্থ হচ্ছে।’ ১৩ আগস্ট থেকে রইলেন বেলেঘাটায়। ১৪ তারিখ পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ কী ধরনের ধুমধাম হবে? উত্তরে গান্ধি বলেছিলেন, ‘চতুর্দিকে লোকে না খেতে পেয়ে মরছে। এই ভয়াবহ দুর্দশার মাঝখানে আপনি উৎসবের আয়োজন করতে চান?’ ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক তাঁর কাছে বাণী চাইলে জাতির জনক বললেন, ‘আমার ভাঁড়ার নিঃশেষ হয়ে গেছে।’ বিবিসি থেকে বারবার তাঁর কাছে মিনতি আসে কিছু বলবার জন্য; বারবারই তিনি ফিরিয়ে দেন। শেষে বিরক্ত হয়ে তাঁর সচিবকে বলেছিলেন, ‘ওদের বলে দাও, আমি ইংরাজি ভুলে গেছি।’

এ তো ভারী বিচিত্র স্বাধীনতা! স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যখন নিখুঁত অ্যাকসেন্টে ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’র মহলা দিচ্ছেন, তখন ‘জাতির জনক’ বলছেন, আমি ইংরাজি ভুলে গেছি। আমার বাণীর ভাণ্ডার শেষ! গান্ধির সেই না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর অন্ধকারকে তোয়াক্কা না-করে প্রচুর ধুমধামের মধ্যে দিয়ে উদ্‌যাপিত হল ১৫ আগস্ট ১৯৪৭। দিল্লি সহ সারা ভারত, কলকাতা সমেত, সেজে উঠল। কলকাতায় উড়ল অজস্র পতাকা। তারপরই আবার লাগল দাঙ্গা। আবার অনশনে বসলেন গান্ধিজি। রাজ্যপাল রাজাগোপালচারি তাঁকে বললেন, কতকগুলো গুণ্ডার বিরুদ্ধে আপনি অনশনে বসছেন? উত্তরে গান্ধির উক্তি অমর হয়ে রয়েছে, ‘ওদের গুণ্ডা বানাই আমরাই।’

সবচেয়ে অবাক লাগে, এতবড় একটা দেশ ভাগ হয়ে গেল যেন দাবা খেলতে খেলতে। ২৮ মে ১৯৪৭ মাউন্টব্যাটেন লন্ডনে দুটো রেডিও ভাষণ রেকর্ড করে রেখে দিলেন। পাঞ্জাব আর বাংলা দুটোই যদি ভাগ হয়ে যায়, তাহলে ভাষণ ‘এ’ প্রচারিত হবে। আর যদি বাংলা ভাগ না হয়, তাহলে প্রচারিত হবে ভাষণ ‘বি’। ৩০ মে তিনি ভারতে এলেন। নেহরু আর প্যাটেল তাঁকে জানালেন, তাঁরা বাংলাকে অবিভক্ত রাখার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছেন। সুতরাং ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন সাহেবের পূর্ব-রেকর্ডিত ভাষণ ‘এ’ সম্প্রচারিত হল। শুনে গান্ধিজি রেগে আগুন। কেউ তো তাঁকে জানায়নি যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেছে! নেতাদের মধ্যে গান্ধিজি, খান আবদুল গফ্‌ফর খান, জয়প্রকাশ নারায়ণ আর রাম মনোহর লোহিয়া ছাড়া আর কেউ দেশভাগ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রা কাড়েননি। হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ তো নাওয়াখাওয়া ভুলে বাংলা ভাগের দাবি তুললেন। এমনকী আমাদের সাধের কমিউনিস্ট পার্টিও। গান্ধিজির আপস-ভরা জীবনের চরমতম আপসটি এবার অনুষ্ঠিত হল। রাগ পড়ে এলে তিনি বললেন, যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন বরং দেখা যাক, ব্রিটিশদের বাদ দিয়ে কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করা যায়। আশ্চর্য! তাঁর এতদিনকার জো-হুজুর ভক্তরা তাতেও গররাজি। ব্রিটিশদের বাদ দিয়ে নয়, তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই দেশভাগ সুসম্পন্ন করবে! ক্ষমতার সিংহাসনটা তখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। জাতির জনককে নিয়ে আবেগ ফলানোর সময় কোথায়? ফলে মাউন্টব্যাটেন তাঁর ‘সাধের ব্যাটন’ পছন্দমতো হাতেই তুলে দিলেন। চিরকালের মতো শান্তি বিদায় নিল এই উপমহাদেশ থেকে।

এদিকে দেখতে দেখতে সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত। সেই খণ্ডিত দেশে একটা প্রজন্ম যখন জন্ম নিচ্ছে, বা নেবে নেবে করছে, তখন একটা মসজিদ উপড়ে দেওয়া হল মাটি থেকে, যার প্রভাব ভারতের রাজনীতিতে থেকে যাবে পরের দুই থেকে তিনটি দশক। যখন তারা জন্মে গেছে, হামাগুড়ি দেবে বলে ঠিক করছে, তখন গ্যাট চুক্তি সাক্ষর হয়ে গেল, অর্থনীতির সঙ্গে পালটাতে শুরু করল সমাজছক। নয়ের দশকের এই দুই বদল আত্মস্থ করতে সময় লেগেছিল ভারতবাসীর, অন্তত শূন্য দশকের শুরু অবধি। আর মিলেনিয়াল প্রজন্মর সে অর্থে জ্ঞানগম্যিই হল তখন, ফলে তারা চিনতেই শুরু করল সেই বিশ্বায়িত, ক্রিকেটসর্বস্ব, ‘মিশন কাশ্মির’-এর ভারত, কার্গিল, ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর এবং গুজরাত গণহত্যার ভারত।

নয়ের দশকের শেষ বা প্রথম দশকের গোড়ার। ১৯৯৭ সালে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর, এবং নেতাজির শতবর্ষ। অর্ধশতক পেরিয়ে আসা একটা স্বাধীন দেশ তখনও হজম করছিল ভারত নামের একটি মণ্ডকে, যে ভারত মুক্ত, ধ্বস্ত, বিভক্ত, রক্তাক্ত। মুখার্জি কমিশন থেকে গুমনামি বাবা, বালক ব্রহ্মচারী হয়ে নেতাজির অন্তর্ধান তখন মিথ এবং আশা-বেদনার এক অন্য সমষ্টিগত অচেতনের দ্যোতক, যেখানে ব্যক্তি নেতাজির থেকেও বেশি জরুরি ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতা, এক অন্য স্বাধীনতার আখ্যান হারিয়ে যাওয়ার মর্মযন্ত্রণা। শুধু এই সালটিকে ভরকেন্দ্র করলে বোঝা যাবে, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’, দেশভাগ, কলোনির চাপা রক্তছাপ, শরণার্থীর ঢেউ, গান্ধিহত্যা থেকে খাদ্য আন্দোলন, জরুরি অবস্থা থেকে নকশাল অভ্যুত্থান, ইন্দিরা-রাজীব হত্যা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্রোত— এই নানা প্রতিতরঙ্গের ভেতর দিয়ে নতুন দেশের চেতনা তখনও প্রোথিত ছিল।

সেই নতুন দেশ খুব তাড়াতাড়ি পুরনো হলো। বহু বছরের প্রতিবেশীর শত্রুতা, দাঙ্গা, ধর্মীয় বিশ্বাসঘাত এবং সন্ত্রাসের কাড়ানাকাড়ায় আন্দোলিত হল মূলধারার গণমাধ্যম। এবং একটা প্রজন্ম বড় হল মূলত রাজনীতির ঘাঁতঘোঁত সম্পর্কে অসচেতন হয়ে, একটু একটু দেশপ্রেম, অনেকটা নব্য পুঁজির আকর্ষণ নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে, একরাশ চয়েজ এবং নিত‍্যনতুন ‘নিও লিবারাল’ পণ্যমুখরতায় বাঁচতে বাঁচতে হঠাৎ ‘আওয়াজ তোলা’-র অঙ্গীকার করতে শিখল এই প্রজন্মই। ২০১২ সালটা খুব জরুরি ছিল এইদিক থেকে। নির্ভয়ার ধর্ষণকাণ্ড সেই প্রথম ঝড় তুলল দেশের মহাতারকাদের নিজস্ব ব্লগে। অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দাবি তুললেন ধর্ষকদের। রাজধানীর রাস্তা স্তব্ধ হয়ে গেল তরুণদের ভিড়ে।

সরকার-বিরোধিতার ব্যাপক ঢেউ উঠছে সে-সময়। সেই একই সময় লোকপাল বিল আন্দোলনেরও। আন্না হাজারে তখন নতুন গান্ধি। কেজরিওয়াল থেকে প্রশান্ত ভূষণ হয়ে রামদেব, কে না ছিলেন সেই রেড কার্পেট পাতা দুর্নীতিবিরোধী জেহাদে। এসএমএস বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া চলল এই সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে। এবং যা খুব আগ্রহব্যঞ্জক, এর বেশ কিছু বছর আগে দেশ কাঁপিয়েছিল তাজ-ওবেরয়ের ভয়াবহ সন্ত্রাস। সেই সময় অরাজনৈতিক তারুণ্য ফুঁসছিল সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের ভাষ্য তখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ভাষ্য ঢাকা পড়ে মোমবাতি মিছিলে। রাজকুমার গুপ্তার জরুরি ছবি ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ চিনিয়ে দিয়েছিল মোমবাতি হাতে নীরব প্রতিবাদে সামিল হওয়া সেই প্রজন্মকে। তারা জানত, দীর্ঘদিন স্বাধীন হয়ে যাওয়া দেশের সব ব‍্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। থিতু থাকার সময় নেই।

কেন তারা এমন ভাবছে? দু-একটি ঘটনায় মাত্র? না। এই শতকের নির্মমতম, ভয়াবহতম রিসেশনের ধাক্কাও ততদিনে লেগেছে। ওয়াল স্ট্রিটে দেখা যাচ্ছে আলতো চিড়। ফলে গোলকায়নের দেখানো স্বপ্ন বিপন্নতার মুখে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে তখন। সেই সময় স্বাধীন দেশের অন্যতম শিউরে দেওয়া ধর্ষণ, টুজি-কমনওয়েলথ-এর মতো মারাত্মক দুর্নীতির বদ হাওয়া এই প্রজন্মকে বিরক্ত ভাবিত করছে। বিব্রত করছে। কী করবে তখন তারা? তারা ওই গোলকায়নের দেখানো পথেই প্রতিবাদ করবে। হ্যাঁ, এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠবেই, বোফর্স যখন ঘটেছিল, তহেলকার হাত ধরে বঙ্গারু লক্ষ্মণকে যখন প্রকাশ‍্যে ঘুষ নিতে দেখা গেল, তখন এমনটা হল না কেন? কারণ, তখনও দেশ ছিল একটি সামগ্রিক স্বপ্নের আঁতুড়। দেশ যখন গ্লোবাল ভিলেজের টুকরোমাত্র, তখন কীভাবে সেই স্বপ্নের বুনন ঘটবে? সেই স্বপ্ন ততদিনে মিশে গেছে ধূসরতায়।

আর এখান থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হল আজকের ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর প্লট। নতুন দেশ, নতুন ভারতের আখ‍্যান স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি করার দরকারই হয়নি। কারণ এক শতাব্দীরও কম বয়সি স্বাধীন দেশ তখনও বৃদ্ধ, বস্তাপচা হয়নি একচুলও। এবার সেই দেশের হাড়পাঁজর, কোঁচকানো চামড়া নিয়ে সচেতন হয়ে পড়ল নতুন প্রজন্ম। তারা চাইছিল, স্বাধীন ভারতের এক অন‍্যতর চেহারা। ‘আচ্ছে দিন’-এর ভারত যা তুলে ধরল। বিদ্বেষ নির্মাণ, শত্রুপক্ষ নির্মাণের তৎপরবর্তী গতিবাঁক নিয়ে কিছু বলবে না এই লেখা, কারণ তা এখনও দৃশ্যের জন্ম হওয়ার পর্যায়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত, আইটি সেলের নিরন্তর চলচ্ছবি যে জম্বি-ভারতের নির্মাণে হাত লাগাল, স্বাধীনতার মেরামতের নাম করে ইতিহাসের গঠনতন্ত্রে যে অবনির্মাণ ঘটাল, তা স্বাধীনতা দিবসের দিন মাইক বাজানো, ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ এবং রক্তদান শিবিরের চেয়ে বৃহত্তর। সেজন্যই হর ঘর তিরঙ্গা প্রকল্পে কর্পোরেট সংস্থা সেলস টার্গেট স্থির করে দেয়। অন্তত দশটা করে পতাকা না বেচলে চাকরি যাওয়ার ভয় আছে যার, সে কি উমর খলিদ থেকে ভারভারা রাও, কাউকে তার কমরেড বলে ভাববে? সে জানে, নতুন ভারতে রোবট হতে হবে।

নেহরুকে নাকি কোনও এক কিশোর স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছিল, আপনি যে বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে, কী হল সেই প্রতিশ্রুতির? নেহরু তার চোখে চোখ রেখে বলেন, গণতন্ত্র আছে বলেই একজন কিশোর প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করতে পারে। এই উন্নাসিকতার মূলে ছিল গণতন্ত্রের অহমিকা। আজ সেই অহমিকা শূন্যগর্ভ কামানের গোলামাত্র। আজ গণতন্ত্র কতটা তামাশার, তা সেই কিশোরও জানে। আজ প্রধানমন্ত্রীও জানেন, ওই আঙুল তাঁর দিকে ওঠার আগেই দাফন হয়ে যাবে নিমেষেই।

সেদিন উইনস্টন চার্চিলের শিকারসন্ধানী সাম্রাজ্যবাদী শ্যেনচক্ষু সত্যিই কিছু ভুল দেখেনি। তার প্রমাণ তাঁর আরও একটি উক্তি: ‘ব্রাহ্মণদের হাতে ভারতের শাসন ছেড়ে দিয়ে চলে আসাটা নিষ্ঠুর নির্লজ্জ অবহেলার কাজ হবে। … এইসব ব্রাহ্মণরা মুখে পাশ্চাত্য উদারনীতিবাদের বুলি আওড়ায়, ভান করে যেন এরা দর্শনঋদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ, কিন্তু এরাই তো বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে প্রায় ষাট কোটি সহ-দেশবাসীকে, যাদের এরা বলে “অচ্ছ্যুৎ”। হাজার বছরের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের এরা শিখিয়েছে এই দুঃসহ দশাটা মেনে নিতে।…’ (১৯৩১)

Advertisement