মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
একটা উপনির্বাচন, একটা অকালমৃত্যু, একটা সংবাদ শিরোনাম, একটা মিছিল, তার প্রতিবাদে আরও একটা মিছিল। কালিগঞ্জের রক্তভেজা পথ থেকে বিধানসভার ঠান্ডা ঘর। কি অসাধারণ সমাপতন। শাসক শিবির নিঃশর্তে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আঙুল তুললেন পূর্ববর্তী শাসক দলের দিকে। বর্তমান বিরোধী দলগুলি পরস্পরের মধ্যে ভাগ করে নিলেন বর্তমান শাসকের আমলের হত্যা তালিকা। শাসক শিবিরও থেমে নেই, বাকি ইতিহাস সামনে আনলেন। কিন্তু যে এগারো বছরের মেয়েটা অকারণে চলে যেতে বাধ্য হল, সেই মর্মান্তিক অপচয়ের খতিয়ান দেবে কোন দল?
Advertisement
সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি সন্তান হারা মায়ের হাহাকারের ছবি দেখিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল শোকের আঁচে তাঁদের স্বার্থের রুটি সেঁকছেন। কিন্তু তামান্নার এই অপমৃত্যু কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কোনও সঠিক উত্তর আছে কি কারো কাছে। খুব স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে এটা সবার কাছেই একটা বিষয় মাত্র। এমন ঘটনা দশকের পর দশক ধরে ঘটে চলেছে। নির্লজ্জ আস্ফলন আর নির্বিকার কৈফিয়তের ঘাত প্রতিঘাতে শোকের গভীর যন্ত্রণাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে। যে মা সদ্য তাঁর কন্যাটিকে হারিয়েছেন তাঁকে একলা শোকে কান্নাটাও কাঁদতে দেওয়া যাচ্ছে না। একটা পরিচ্ছন্ন শাড়ি ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে কাঁদতে বসতে হচ্ছে। এমন অবস্থান কি সভ্য সমাজের কাম্য?
Advertisement
আমরা যারা যথেষ্ট বয়স্ক, যাঁদের ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কিছু কিছু ঘটনা মনে আছে, তাঁরা বলুন তো এমন রাজনৈতিক আন্দোলনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জীবনহানি কি তাঁদের মনে নেই? আমি প্রাত্যহিক রাজনৈতিক তর্জার মধ্যে উঠে আসা উদাহরণ টানলাম না। সেই সময় প্রায় প্রত্যেক পাড়ায় ছোট ছোট শহিদ বেদী গড়ে উঠত— ‘তোমায় ভুলছি না ভুলবো না’—এই শপথে। এরা কারা ছিল? দিন বদলের আশায় যারা এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা আজ কোথায়? একটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হবার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে গিয়ে দেখলাম সব দোকান হুটপাট করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবাই পালাচ্ছে। সম্ভবত ১৯৭০ কিংবা ৭১। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও হেয়ার স্কুলের মাঝখানের রাস্তার ট্রাম লাইনের ধারে পড়ে আছে একটি ছেলে। বোধহয় সদ্য তার গলার নলি কাটা হয়েছে, রক্ত গড়িয়ে চলে যাচ্ছে নর্দমায়। জীবনের এ কোন সমাপন আজও বুঝিনি। কিন্তু যখনি ওই পথে হাঁটি, ছবিটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে সেই সন্তানের মাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি। পরিবর্তনের এমন দলিল দেখে দেখে বড় হয়েছি আমরা। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইছি কেন।
এই সব রক্ত ঝরানো রাজনৈতিক অবক্ষয়ের পথ ধরেই আজকের নিরপরাধ তমন্নারা লাস হয়ে যাচ্ছে। আজকে রাজনৈতিক বিভাজনের গণ্ডিটাও প্রকট। তুমি আমার দলের না হলে, তোমার বিপন্নতা অনিবার্য। আমরা খুব ছোট বেলা থেকে কংগ্রেস-সিপিএম-এর মারামারি দেখতাম। তাতে নিষ্ঠুর আঘাত দেখেছি কিন্তু সেখানে দুপক্ষই দলীয় কর্মী, তাদের পরিবার অথবা অন্যান্য শিশুর শৈশব অথবা কৈশোর এমনভাবে হারিয়ে যেতো না। যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে সব দল একত্রে অথবা আগে পরে গিয়ে বিনম্রভাবে ক্ষমা চেয়ে আসতেন। রাজনীতির সঙ্গে সৌজন্য, আন্তরিকতা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ছিল। সে বালাই খসতে শুরু করেছিল গত শতকের শেষ ভাগ থেকে। সেই সঙ্গে ‘বিভাজন’ হাতিয়ার হয়ে ঢুকতে শুরু করেছিল রাজনীতিতে ছোট্ট তমন্নার বাবা হোসেন শেখ পরিযায়ী শ্রমিক। ওড়িশায় কাজ করতেন। দুঃসংবাদ শুনে ছুটে এসেছেন। তাঁর কন্যার তমন্না ছিল কত ছোট বস্তুর জন্য। সে আব্দার তার রক্তের স্রোতে ধুয়ে গেছে। আজকে নানা প্রশ্নের অবতারণা হচ্ছে। ওরা বামপন্থার সমর্থক, ওরা অন্য ধর্মের, ওরা দরিদ্র শ্রমজীবী। সুকৌশলে তাদের ধর্ম পরিচয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে। আবার পুরানো স্মৃতির ঝুলি থেকে একটা কথা বার করে আনি, সত্যনারায়ণের পূজার একটি ‘মোকাম’ ওদের না দিলে পূজা সম্পূর্ণ হয় না। আজও বহু বাড়িতে এই রীতি মানা হয়।
তবে কেন সকলে আজ গার্জে উঠছেন না— যে চলে গেল সে একজন মানুষের কন্যা— তার জাতি ধর্ম রাজনীতি সব কিছুকে অতিক্রম করে সে মানুষ। এখানে বোধহয় রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি অনিবার্য— ‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা’— অসহ্য এক অসহায়তায় বিলকিস বানুর অজাত সন্তানের তুলনা দিতে ইচ্ছে করছে। মর্মান্তিক নারকীয়তায় তার সন্তান গর্ভেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সূর্যের অথবা চন্দ্রের আলোয় স্পর্ধিত কান্নায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে পারেনি। কিন্তু তমন্না তো আলোকিত পৃথিবীর স্পর্শ পেয়েছিল। তবুও সে হারিয়ে যেতে বাধ্য হল। কার কি ক্ষতি ছিল। বর্তমান রাজনীতি ‘লাশ’ পেল। কিন্তু কন্যা হারা মা কি তার নিজস্ব অনুভব দিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা মেয়ের অকারণ মৃত্যুকে ভবিতব্য বলে মেনে নিত পারবেন? সারাটা জীবন কি তাঁর অকালে হারানো কন্যার ছোটবেলার খেলনা, কাজললতা কিংবা প্রাথমিকে পড়ার বই খাতা তাঁকে তিল তিল করে যন্ত্রণায় রক্তাক্ত করবে না? আজ বিজয় মিছিল ও তার পরিণাম দেখে বলতে ইচ্ছে করছে, জীবনের এই অকারণ উন্মাদনা বন্ধ করবে কে।
বর্তমান সমাজে মৃত্যুর শেষ নেই। বহু লাশ আজ নীরবে মুখর হয়ে প্রশ্ন করছে তাদের অপমৃত্যুর প্রতিকার কবে হবে। কত সন্তান হারা মা-বাবা, কত রিক্তসিঁথি, যুবতী, কত ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার কল্যাণ কামনা শূন্য বোন সমাজকে প্রশ্ন করছে। কিন্তু উত্তরকে দেবে। যেমন বিলকিস বানুর ধর্ষকরা মুক্তি পেয়ে গলায় মালা পরে বিজয় গর্বে ঘুরছে, যেমন অভয়া, নির্ভয়া আরও অনেক কন্যার চিতাভস্ম সকলকে প্রশ্ন করছে, উত্তর কোথায়? কাব্যকথা এখানে লজ্জায় ম্লান। শুধু কন্যা সন্তান অথবা অন্য ধর্মের মেয়েদের কথা নয় বহু বালক, যুবক, প্রৌঢ় বর্ণ হিন্দু গোষ্ঠির মানুষও এই মিছিলে সামিল। তাদের প্রশ্নে যোগ হয়েছে নতুন বাক্য—তারা তো সংখ্যাগুরু, শাসকদলের লোক— তবে কেন তারা আজ মৃত। উত্তর দেবার দায় নেবার কেউ নেই। আছে শুধু নির্বিকার স্তব্ধতা আর পরস্পরের প্রতি আঙুল তোলা। তাই আট থেকে আশির মিছিলে যেমন লাশেরা হাঁটছে, সঙ্গে হাঁটছে অপমানিত এই সমাজ। হাঁটছে তামান্নারাও।
Advertisement



