কোহিনূর কর
যাঁরা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করেন তাঁদের মধ্যে কেউ যদি শীতের মরশুমে আমেরিকার উত্তর বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এসে প্রচন্ড ঠান্ডা আর তুষারের কবলে পড়ে ঘরে বসে বসে বিরক্ত হতে থাকেন, তাঁদের জন্যে সুখবর। চলে আসুন আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুময় রাজ্য অ্যারিজোনায়। খুব বড় শহরের কেউ কেউ আপনাকে সাবধান করে দিতে পারে— ওরে বাবা, ওদিকে তো পুরো মরুভূমি ধু-ধু করছে ফাঁকা মাঠ, নানাধরনের জন্তু আর সাপ-খোপ ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি অন্যের মুখে এরকমই অনেক গপ্পো শুনে এখানে কাজের সূত্রে এসে আজ কুড়ি বছরের ওপর দিব্যি কাটিয়ে দিলাম। এত ভালো লেগেছে যে সুযোগ পেয়েও অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি এখনও। বললে বিশ্বাস করবেন না হয়তো, এত বছর থেকেও অ্যারিজোনার সবকিছু দেখে উঠতে পারিনি। প্রকৃতি আর স্থানীয় উপজাতিদের সংস্কৃতি অত্যন্ত মনোরম, কোনও সন্দেহ নেই।
Advertisement
অ্যারিজোনার প্রতিবেশী রাজ্যগুলো হল ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, উটাহ, কলোরাডো, নিউ মেক্সিকো আর দক্ষিণে পুরোটাই মেক্সিকোর সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা। আরিজোনার সবচেয়ে বড় শহর ও রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রহল ফিনিক্স (Phoenix)। রাজ্যের গভর্নরের অফিস-সহ ফেডারাল ও স্টেটের অনেক প্রশাসনিক দপ্তর রয়েছে ফিনিক্সের স্টেট ক্যাপিটলও তার চারপাশে। ফিনিস্কের স্কাই হারবার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-এ যাওয়ার জন্যে বেশ কিছু শহর থেকে সরাসরি উড়ানের ব্যবস্থা আছে, মাঝে কোথাও থেমে যাওয়াও যায়। সরাসরি ফিনিক্স থেকে আমেরিকার মোট ১২০ টি বিভিন্ন শহরে এবং কানাডা, মেক্সিকো, ইংল্যান্ড ওফ্রান্সের ২৫ টি শহরে যাতায়াত করা যায়। দেশে যাওয়ার সরাসরি উড়ানের কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়, হয়তো হয়ে যাবে কোনওদিন। তবে এই মুহূর্তে দেশে যাওয়ার সময় হয় লন্ডন বা প্যারিস হয়ে, নয়তো আমেরিকারই অন্য কোনও এয়ারপোর্ট হয়ে যাওয়া যায়।
Advertisement
ফিনিক্সে বেশ আন্তর্জাতিকমানের বিমান, ইলেকট্রিক গাড়ি, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য কিছু কারিগরী সংস্থা ভালোই ব্যবসা করে চলেছে। এছাড়া কয়েকটা বড় বা মাঝারী হাসপাতাল রয়েছে। টেম্পী শহরে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাস। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, দোকান, বাজার, মল, ইত্যাদি যা প্রয়োজন সবই আছে। ইন্ডিয়ান গ্রোসারী বা রেস্টুরেন্ট তো বেড়েই চলেছে। ফিনিক্সের উত্তরে ঘন্টা-দুই উঁচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করে গেলে ফ্ল্যাগস্টাফ (Flagstaff) শহর পড়ে। খুব সুন্দর ছোট্ট একটা শহর যেখানে আছে নর্দার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। এখানেই আছে লাওয়েল পর্যবেক্ষণাগার (Lowell Observatory) যেখান থেকে গবেষণা করে প্লুটো আবিষ্কার করা হয়েছিল। সারা শীত এখানে বরফ থাকে। ফিনিক্স থেকে ফ্ল্যাগস্টাফের মধ্যে পড়ে সেই বিখ্যাত লাল পাহাড়ে ঘেরা সেডোনা (Sedona) যার উপত্যকায় খুবই শান্ত আর সুন্দর একটা সরু নদী বয়ে নিয়ে চলেছে ঝর্নার জল, নাম ওক ক্রীক (Oak Creek)। নৈঃস্বর্গিক বলাই চলে। ফটোগ্রাফি আর সিনেমা জগতের অনেকেই এখানে যাতায়াত করেন। এরকম ঘোরার জায়গা এখানে অবশ্য অনেক আছে আর তাদের মধ্যে বৈচিত্রও অনেক। ফিনিক্স থেকে দক্ষিণে ঘন্টা দেড়েক ড্রাইভ করলে এসে যায় টুসন (Tucson) —যথেষ্ট ব্যস্ত শহর। এখানে আছে ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার ক্যাম্পাস। এছাড়াও বেশ কয়েকটা অপেক্ষাকৃত ছোট শহর ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।
আজ আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ফিনিক্সে আসার আগে আমি জানতামই না এখানে একটা সুন্দর শহর আছে (সহজেই যাকে মরূদ্যান বলা যায়), শহরের একটু বাইরে গেলেই গ্রাম, মরূভূমি, পাহাড়, লেক, খরস্রোতা নদী, গিরিখাত। কোথাও ক্যাকটাস আবার কোথাও পাইন বা দেবদারু গাছের আধিক্য। সমুদ্রতল থেকে ১ হাজার ফুট উচ্চতায় এই ফিনিক্স শহর থেকে ৮ হাজার ফুটেরও বেশী উচ্চতায় জায়গায় অনায়াসে চলে যাওয়া যায় দু’চারদিনের ছুটি কাটাতে। গ্রীষ্মে যেমন ফিনিক্সের মত সমতল (valley) অঞ্চলে খুব শুকনো গরম পড়ে, ৫ হাজার ফুটের ওপর যত শহর আছে সেখানে আবার আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক। যেহেতু ফিনিক্সের ওপর দিয়ে সবাইকে যেতে হয়, তাই গ্রীষ্মকালটা বাদ দিয়ে আসলেই ভাল৷
এখানকার আদি বাসিন্দা বা উপজাতি— যাঁদের আমরা নেটিভ অ্যামেরিকান বা ইন্ডিয়ান ট্রাইব বলে থাকি, তাঁদের কথা একটু বলতেই হয়। অ্যারিজোনাতে মোট ২২টা ইন্ডিয়ান ট্রাইব আছে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এরা সবাই সার্বভৌম, অর্থাৎ ওঁদের সবকিছু আমেরিকার সাধারণ সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কর্মসূত্রে বেশ কিছু ট্রাইবের সাথে আলাপ-আলোচনার সুযোগ আমার হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যায়গা নিয়ে যাদের রিজার্ভেশন তাঁদের নাম নাবাহো (Navajo), ওঁদের ভাষায় Diné Bikéyah বা নাবাহো-ল্যান্ড (Navajoland)। উটাহ, নিউ মেক্সিকো আর অ্যারিজোনা— মূলত এই তিন রাজ্যে এই নাবাহো ছড়িয়ে আছে। ৭০হাজার স্কোয়ার মাইল জুড়ে এই নাবাহো নেশন। লোকসংখ্যা আড়াই লাখের কিছু বেশী হবে। ট্রাইবদের মধ্যে নাবাহোরা অন্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে— শিক্ষায়, উন্নয়নে কিম্বা মানসিকতায়।
আমরা জানি পৃথিবীর সাতটা প্রাকৃতিক আশ্চর্য্যের মধ্যে একটা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে একটু উত্তরে উপজাতি অঞ্চলে বিশাল এই গিরিখাত। নিজের চোখে না দেখলে তার গভীরতা বা বিস্তার কতটা তা আন্দাজ করা অসম্ভব। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল গাড়ি নিয়ে সোজা ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের (একটা ফেডারাল ডিপার্টমেন্ট) পার্কিং লটে চলে যাওয়া। সামান্য ফি দিতে হয়। সেখান থেকে মূল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পার্কে ওদের বাসে যাওয়া যায়, আবার কেউ কেউ হেঁটেও যায়। যখন বরফ কম থাকে পার্কের মধ্যে সোজা গাড়ি নিয়েও ঢোকা যায়। গাড়ি নিয়ে গেলে নিজের ইচ্ছেমত থেমে-থেমে যাওয়া যায়, বাসে গেলে ড্রাইভ করার ঝক্কিটা থাকে না। বেশ কয়েকটা ভিউপয়েন্টে বাস দাঁড়ায়, সেখানে নেমে সব দেখে ছবিটবি তুলে আবার কয়েক মিনিট বাদে পরের বাসে চেপে বসলেই হয়। এভাবে পুরো পার্কটাই বাসে ঘোরা সম্ভব। শুধু গিরিখাতের অপূর্ব দৃশ্য কেন, মাঝেমাঝে চোখে পড়ে হরিণ বা অন্যান্য পাহাড়ী বন্যপ্রাণী।
সারাবছর এখানে পর্যটকদের ভীড়৷ তবে কোনদিন এখানে ঘুরতে আসলে, যেটা আগেও বলেছি, গ্রীষ্মকালটা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করবেন৷ তাহলে ফিনিক্সের মত ভ্যালি অঞ্চলেও অনেককিছু দেখে নিতে পারবেন। অনেকগুলো ভালো আর্ট মিউজিয়াম আছে, আছে ট্রাইবদের সংস্কৃতির সমাহার। শীতকালে আসলে কখন কোথায় বেশী স্নো পড়ে রাস্তা বিপদজনক হয়ে যায় বা একদম বন্ধ হয়ে যায়, সেগুলো জেনে ঘোরার প্ল্যানটা করবেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ভিজিটার সেন্টার রয়েছে, সেখানে গিয়ে কিছু গাইড, ম্যাপ বা টিপস নিতে পারেন (তার জন্যে কোনও পয়সা দিতে হয় না), প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত কাজ সারতে পারেন। কোনও কোনও ভিজিটার সেন্টারে স্ন্যাকস-কফি জাতীয় খাবারও বিক্রী হয়। তবে পেট ভরার মত খাবার পেতে হলে ম্যাপে বা ফোনে দেখে নিলে অনেক সুবিধে।
অ্যারিজোনায় বেড়ানোর অনেক জায়গা যেমন আছে, অনেকেই ড্রাইভ করে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস, হলিউড, স্যান দিয়েগো চলে যান। ফিনিক্স থেকে যেতে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা মত লাগে। ফিনিক্স ছাড়ার আগে একটা জিনিস দেখে যাওয়ার অনুরোধ করব। আপনি সঙ্গীতানুরাগী হন বা নাই হন, এটা অবশ্যই আপনার লিস্টে রাখবেন৷ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট মিউজিয়াম (MIM)৷ মোট ২০০-এর ওপর দেশ থেকে ৮ হাজারের ওপর বাদ্যযন্ত্র এখানে সংগ্রহ করা আছে যা ৬ হাজার বছরের সঙ্গীতের ইতিহাসকে তুলে ধরে। মোড়ে মোড়ে গাইড তো আছেনই, ওয়্যারলেস হেডসেট নিয়ে আপনি যে যন্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন সেই যন্ত্রে বাজানো কিছু বিখ্যাত সুর শুনতে পাবেন। এবার অনুমান করুন ভারতীয় সেতারের সামনে দাঁড়ালেই আপনি শুনতে পাবেন পন্ডিত রবিশঙ্করজীর অসাধারণ কিন্তু পরিচিত সুর৷ প্রথমবার ওখানে গিয়ে আমি সত্যিই অবিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
Advertisement



