‘মানুষ’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মগজের খুপরিতে একটি পুরুষের অবয়ব শুধু ভেসে ওঠে, কখনোই নারী-পুরুষ একত্রিতভাবে মানুষ-মানুষী’র ধারণা ধরা দেয় না। এ আমাদের চৈতন্যের দীনতা ছাড়া আর কিছুই না। একটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কখনোই নারী ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না, সভ্যতা হয়ে ওঠে অর্থহীন। এই কথাগুলো আমরা ‘নারী দিবস’ এলে খুব গদগদ হয়ে উচ্চারণ করি, বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলি, বর্তমানের সোস্যাল মিডিয়ার যুগে হোয়াটস্অ্যাপে বা ফেসবুকের দেওয়ালে নারীদের সম্পর্কে ভালো ভালো কথা লিখে (এই লেখক যেমন লিখছে) নারীর প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজেদেরকে প্রগতিশীল ও মহানুভব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি।
কিন্তু আদতেই কি আমরা তাই? তাহলে আমার বৃদ্ধা মায়ের ঠিকানা কেন বৃদ্ধাশ্রম! শুধু মা নয়, পরিবারের সব নারী সদস্যদের অবস্থান কি infra structurally বদলেছে? নাকি আধুনিকতার হাওয়ায় একটা super structural পরিবর্তনকেই আমরা যথেষ্ট বলে মনে করছি?
আর একটা কথা শুধু ‘নারী দিবসে’ এসে নারীদের সম্মান জানানোর মধ্যে কোনো প্রগতিশীলতা ও কৃতিত্ব নেই। বছরের প্রতিটি দিনই যেমন পুরুষের দিন তেমনি প্রতিটি দিনই নারীরও দিন– একথাটি বুঝতে হবে। ‘নারী স্বাধীনতা’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রতিদিন পৃথিবীতে হাজারটা আলোচনাচক্র হচ্ছে কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে নারীর অপমান, লাঞ্ছনা ও অমানবিক অত্যাচার অব্যাহত। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এর নিরসন না হলে শুধু মাত্র ‘নারী দিবসে’ নারীদের প্রতি সম্মানের বিজ্ঞাপন সাজিয়ে নিবেদন করলেই হবে না। এ আর এক ধরনের প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই না।
Advertisement
একটা কথা জনান্তিকে একটু বলেই নিচ্ছি, ‘পুরুষ শাসিত সমাজ’ এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করতে করতে ক্লিশে হয়ে গেলেও আমরা এই শব্দবন্ধটিক অতি আপন, উপযুক্ত ও জুতসই মনে করে এর মোহ থেকে মুক্ত হতে চাই না। ঠিক আছে, একটা অর্জিত শব্দবন্ধ যদি হাত এবং মন ছাড়া না ই করতে চাই অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রশ্নটা রাখছি অন্যত্র। উপযুক্ত ছেলেরা বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে অবহেলা করে বা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেয়। এখানে লক্ষ্যনীয় ‘মা’, যিনি একজন নারী, শুধু তিনিই নন ‘বাবা’, যিনি একজন পুরুষ তিনিও অবহেলিত। এখানে পুত্রবধূ যিনি একজন নারী — তার ভূমিকা কি প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে না? ভারতীয় সমাজ ব্যাবস্থায় পারিবারিক বৃত্তে যে গৃহ হিংসার (Domestic Violence) এর কথা বলা হয়, বা যা হয়ে আসছে এবং হয়ে চলেছে সেই গৃহ হিংসা সংঘটনে যদি ধরেই নিই আশি ভাগ দায়ী পুরুষরা, বাদবাকি কুড়ি ভাগের জন্য কি কোনোভাবেই মহিলারা দায়ী বা যুক্ত নন? পরিবারের পুরুষ সদস্যরা (অবশ্যই সবাই নয়), যারা গৃহবধূকে নির্যাতন করেন তার পিছনে কি পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের কোনো ভূমিকা থাকে না? গৃহবধূ নির্যাতনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতের শাস্তির রায়গুলোর রেকর্ড যদি সংগ্রহ করা যায় তবে সেখানে কি মহিলাদের অনুপস্থিতি নিশ্চিতভাবে লক্ষ্য করা যাবে?
এই প্রসঙ্গে আরো দু-একটি কথা বলার ইচ্ছেকে দমন করতে পারছি না। এই অস্বস্তিকর ও অপ্রীতিকর কথাগুলো না উচ্চারণ করলে বড্ড একপেশে এবং একচোখে দেখার মতো হয়ে দাঁড়াবে। আর তাছাড়া কোনো বিষয়ের বিশ্লেষণ তখনই একটা সম্পূর্ণতার সঙ্গে মান্যতা পায় যখন সেই বিষয়ের বহু কৌণিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। শুধু তাই নয়, যে কোনো বিষয়ের সামগ্রিকতাহীন আলোচনা পুরোই ব্যর্থ হয় এবং তা পাঠকের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে।
Advertisement
আমাদের ইতিহাস বোধ এবং জ্ঞান এই কথাই জানান দেয় যে, সভ্যতার প্রথম যুগ থেকেই মানুষ তার আত্ম আবিষ্কার নিয়ে ভীষণ সচেতন। কিন্তু আত্মসমীক্ষার বিষয়টি আরো অনেক পরের বিষয়। এই বিষয়টি নিজেকে চেনা বোঝার জন্য ভীষণ জরুরী। এই আত্মসমীক্ষার বিষয়টি কত শতাংশ মানবীদের মধ্যে উপস্থিত সে সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন থেকেই যেতে পারে। নারীবাদী হওয়া মানে কি পুরুষ বিরোধিতা? একজন নারী সে শুধু মানুষ– এই বোধ আমাদের মধ্যে কি সঞ্চারিত হয়েছে? নারীসত্তার অস্তিত্বের স্বরূপ এবং নারীর আত্মসমীক্ষা নির্মাণের দিগন্ত কত দূর প্রসারিত? এই প্রশ্নটা কিন্তু এই সময় দাঁড়িয়ে এক যথার্থ প্রশ্ন বলেই মনে হয়। প্রশ্নটা পুরুষ ও নারী না হয়ে কেন “মানুষ” এর প্রশ্ন হয়ে উঠবে না? কেন মানবিক সম্পর্কের কথা উঠবে না? এই উচ্চকিত নারীবাদী কথা, আলোচনা , শ্লোগানের ভিতর যখন পুরুষের নীরব সহনশীলতার কথাগুলো চাপা থাকে,ঢাকা পড়ে যায় অসংখ্য পুরুষের নীরব আত্মনিবেদনের আশ্চর্যজনক গভীর মানবিক অদৃশ্য এবং অনুচ্চারিত ইতিহাস তখন স্বাভাবিকভাবেই তথাকথিত আধুনিক যুগের তথাকথিত নারীবাদীদের প্রতি কেমন যেন এক অবজ্ঞা মিশ্রিত করুণারই উদ্রেক হয়।
যদি এক সার্বিক কল্যাণকামী মানসিকতার আলোয় সবকিছু দেখা যায় তাহলে এক বৈষম্যমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে এক মহান বৈষম্যহীন সমাজের রূপরেখা গড়ে তুলতে আমাদের বেশি কাঠ খড় পোড়াতে হবে না। এই কথাটা সমাজের পুরুষ সদস্যদের যেমন বোঝা দরকার ঠিক তেমনি নারীদেরও বোঝা দরকার। এখানে বলতে দ্বিধা নেই সমাজের আর্থিকভাবে একেবারে তলানিতে যারা বাস করছেন সেই সমাজে কিন্তু এই বৈষম্য আমাদের চোখে পড়ে না। যত বিপত্তি তথাকথিত শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই। তাদের মধ্যেই এই বৈষম্য ভীষণভাবে কাজ করে চলেছে দিন দিন, নিত্যদিন, প্রতিদিন। অথচ তারাই বছরজুড়ে বিশেষ দিনগুলিতে নানা ধরণের আলোচনার মহামঞ্চে চেতনাকে ধোঁয়াশাসাচ্ছন্ন করে নারী প্রগতির তথাকথিত তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা ইথারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই বড্ড বিরক্ত লাগে প্রতিবছর এই নারী দিবসের এইসব নারীদের এই বিজ্ঞাপনী ও আত্মপ্রচারমূলক (খুব সচেতনভাবেই বলছি) মার্কা পোস্ট দেখলে। এদের হাস্যকর তথাকথিত নারীবাদী লেখালেখি, গবেষণা, আলোকিত মঞ্চে ভাষণ তথা চিল চিৎকার শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে তেভাগা আন্দোলনের নারীদের, স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের ভাষায় দেগে দেওয়া পতিতাদের উজ্জ্বল ভূমিকা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের সন্দেশখালির পিঠে খাওয়ার গল্পের এক একটা দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। এর সঙ্গে মহাবিস্ময়ে লক্ষ্য করি সারাদিন পুরুষের মুন্ডুপাত করে সন্ধ্যাবেলায় শিবরাত্রির দিন শিবের মাথায় জল ঢেলে পুরোহিতের পায়ে নতগ্রীবে আশীর্বাদ প্রার্থনা করার এক কুৎসিত ছবি। যেখানে গিয়ে নারীবাদ একটু বিশ্রাম খোঁজে বোধহয়!
Advertisement



