সুদর্শন নন্দী
বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। এটি শুধু প্রবাদ বাক্য নয়, বাস্তবে পার্বণ,মেলা, উৎসবের সংখ্যাটি আরো বেশি। সবচেয়ে বড় কথা শুধুমাত্র বই নিয়ে যে এরকম আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি মেলা হতে পারে তা ১৯৭৬ সালের আগে ভাবা যায় নি। প্রথম বইমেলা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ৫ই মার্চ। মেলা তখন নিতান্তই চার গাছ। আদৌ সে গাছ টিকবে কিনা সে নিয়ে সংশয়। কিন্তু সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাঙালি পাঠকরা প্রমাণ করেছেন পুস্তকমেলা বা বইমেলা দুর্গোৎসবের মতোই সারা বছর হা পিত্যেশ করে অপেক্ষা করার মেলা। আর সেই জন্যই এই মেলা যে চারাগাছ ছিল তা আজ প্রায় অর্ধশতক পরে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Advertisement
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না নিবিড় বইটান কখনো কখনো তৃষ্ণার্তের জলপানকেও ভুলিয়ে ছাড়ে। বইয়ের অপর নাম জীবন, যে জীবন মানুষকে প্রকৃত মনস্ক করে তুলে নিজের প্রতি, প্রিয়র প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, বিশ্ব চরাচরের প্রতি।
Advertisement
১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হল। মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ অবধি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে (বর্তমানে মোহরকুঞ্জ উদ্যান) আয়োজিত হয়েছিল এই মেলা। প্রথম বইমেলায় কলকাতার সব প্রকাশক সংস্থা যোগ দেননি। তাই মেলার মাঠ ছোট হলেও তা ভর্তি হওয়ার মতো স্টল পাওয়া যায়নি। তবে যথেষ্ট জনসমাগম হওয়ায় পরের বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বইমেলার আয়তনও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৮ সালে আয়োজিত তৃতীয় কলকাতা বইমেলায় মোট ১১২টি প্রকাশক সংস্থা বইমেলায় অংশ নিয়েছিলেন। মেলা আয়োজিত হয়েছিল রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে ভিক্টোরিয়া-সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত বড় মাঠে আর ১৯৮৩ সালে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ২৮৫টি প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সংস্থা। সেবার বিড়লা তারামণ্ডল থেকে রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে অবস্থিত অধুনা ‘মোহরকুঞ্জ’ উদ্যানের সম্পূর্ণ অংশটিই মেলার জন্য পেয়ে যায়। আর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সম্ভবত ১৯৮৪ সাল থেকে মেলা আয়োজিত হয়েছিল।
১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ কলকাতা বইমেলার আগে ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে ১০-১২ দিন সময় নিয়ে অপর একটি বইমেলার আয়োজন করে। বছর দশ চলেছিল। বইমেলাটির নাম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’ যা লোকমুখে মেলাটি ‘সরকারি বইমেলা’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই মেলাটি কলকাতা বইমেলার মতো জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা বন্ধ হয়ে যায়। উল্টোদিকে কলকাতা বইমেলার উন্মাদনা বাড়তে থাকে হুহু করে। এখন তো সল্টলেকের করুণাময়ীর সেন্ট্রাল পার্কে পাকাপাকি ঠাঁই করে নিয়েছে পুস্তক মেলা। সল্টলেকবাসীরা সত্যিই ভাগ্যবান।
ব্যক্তিগতভাবে আমার পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা তথা সরকারি বইমেলা এবং কলকাতা বইমেলার প্রথম দর্শন ১৯৮১ সালে। সেও নয় নয় করে চুয়াল্লিশ বছর আগের কথা। পুলকিত মনে রোমাঞ্চ টানে ঘুরি সেই বইমেলা। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সরকারি বইমেলা অনেকটা সরকারি অফিসের মতোই গয়ংগচ্ছভাবের হওয়ায় আর টানেনি খুব একটা। সুখের বিষয় পাঠকের এই দুঃখানুভূতির কথা বুঝতে পেরে সরকার তাদের বইমেলার ইতি টানে আর গতিদানে সাহায্য করে কলকাতা পুস্তকমেলার। সে আজ আড়ে বহরে উচ্চতায় বেড়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। বাঙালি হিসেবে, পাঠক হিসেবে সেই অহংয়ের একজন ভাগ্যবান ভাগীদার আমিও। কলকাতা পুস্তকমেলায় কম করে চার পাঁচদিন যেতাম। এরপর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সর্বাধিক জনপ্রিয়,বহুল প্রচারিত ও পঠিত, নামিদামী থেকে হবু লেখকদের লেখায় পরিপূর্ণ পত্রিকা “অমৃতলোক” এর পরিশ্রমী ও কর্মঠ সম্পাদক, প্রকাশক, সুলেখক সমীরণ মজুমদারের সাথে পরিচয়। তাঁর ম্যাগাজিন ও বইয়ের স্টল থাকত বইমেলাতে। তখন প্রতিদিনই থাকতুম আমরাও। তাঁর সূত্রে অন্যান্য পত্রিকার সম্পাদক ও লেখকদের সাথে বাড়ল পরিচিতি। আর এই বইমেলা পার্বণে হত সবাই মিলে গেট টুগেদার।
আজ সমীরণ নেই! সাহিত্যিক বন্ধু অনিল ঘড়াই নেই। নেই কবি মানস চিনিও। নেই কবিতা পাক্ষিকের প্রবর্তক ও সম্পাদক কবি প্রভাত চৌধুরিও। এদের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে কারণ বইমেলার আড্ডার সঙ্গী থাকত এঁরাও।
খড়গপুর বা মেদিনীপুর থেকে নিয়মিত যাতায়ত হত বইমেলাতে। একা গেলে বাড়ি থেকে খিচুড়ি আর পোস্তু বড়া নিয়ে যেতাম। ফোর্ট উইলিয়মের সামনে যে ট্যাঙ্কটা ছিল তাঁর নীচে বসে খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে লাইন দিতাম টিকিটের জন্য। কখনো কখনো সমীরণবাবুর “অমৃতলোক” স্টলের দৌলতে সরাসরি প্রবেশ। টিকিট কাটার লাইনে অনেক সময় লাগায় পরবর্তী কবছর কাঁধে চামড়ার ব্যাগ আর হাতে ক্যামেরা ঝুলিয়ে প্রেস বলে ঢুকে যেতাম। কোন বছরে ঢুকতাম অফিসের কার্ড দেখিয়ে। বলতাম, মেলার টেলিফোন সিস্টেম চেক করতে এসেছি। এসব শুধু সময় বাঁচাতে করা।
অসংখ্য ঘটনা বইমেলা নিয়ে গেঁথে রয়েছে স্মৃতিতে। কত ঘটনা যে আজও স্মৃতির ঝুলিতে রয়ে গেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। বইমেলাতে হাওড়ার কার্ত্তিক দাসকে দেখেছি কি নিপুণভাবে সবাইকে বোঝাচ্ছেন, প্রচার করছেন যে সূর্য পৃথিবীর চার দিকেই ঘোরে। ওর সাথে গল্প করে বেশ ভালো লাগত। তাঁকে পাঠানো নাসা সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিঠির কাটিং, নিউজ পেপার কাটিং বিজ্ঞাপন হিসেবে রাখা থাকত। ভিড় হত বেশ। নিয়মিত দেখা করতাম সরস কার্টুন স্টলের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও লেখক সুকুমার রায়চৌধুরীর সাথে, রসসাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত যষ্টিমধুর সম্পাদক, প্রকাশক, শিশু ও রসসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষের সাথে। লিটল ম্যাগাজিনের স্টল চষে বেড়ানো হত। পরিচিত কিছু প্রবীণ ছাড়া আজ যেন সব অচেনা অচেনা লাগে। কতো মজার মজার ঘটনা যে ঘটত বইমেলায়!
জীবনের গোধূলি বেলায় আজ আছি কাল নেই, বলা ভাল ফাউ বেঁচে থাকা। তবুও মনে হয় বইমেলা প্রতিবছর দেখার জন্য বছর বছর বেঁচে থাকি। ভবী তা হবার নয়। আজও বইমেলা আমার কাছে প্রথম বছরের মতোই আনন্দ দেয়। স্মৃতিমেদুর মনে মেলায় ঘুরি একা একা, নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকি। নব লেখকদের উচ্ছাস যেন নিজের বুকেও জানান দেয় তুমিও একদিন ছিলে এমনই।
Advertisement



