বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ফাটল ধরার কথা বলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু তাদের কথার আমল না দিয়ে দেখা গেল জোটে থাকা দলগুলির নেতাদের মধ্যে ঐক্য এবং ভুল বোঝাবুঝির অনেকটাই অবসান ঘটেছে। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, রাজ্যসভার দীর্ঘ ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম বিরোধী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দিল। ‘ইন্ডিয়া’ নামে এই বিরোধী জোট গঠন হওয়ার পর বিরোধী দলগুলির মধ্যে সমন্বয় তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায়নি— কোনও বিষয় নিয়ে নেতাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি চোখে পড়েনি। সম্প্রতি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের মুখ কে হবেন, তা নিয়ে কথা উঠেছিল। অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, তিনি যদি মুখ হোন, তাহলে এই জোটকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। কারণ দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং প্রশাসন চালানোর দক্ষতার জন্য তাঁকে জোটের প্রধান মুখ হিসেবে এগিয়ে রাখা যায়। মতানৈক্য পাশে সরিয়ে রেখে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধনকড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনল।
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধীদের মধ্যে একতা সেভাবে চোখে পড়েনি— তাই তারা দিল্লির মসনদ দখল করা থেকে দূরেই রইলেন। বিজেপি তৃতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে সরকার গঠন করল, যদিও এই দলকে তা করতে নির্ভরশীল হতে হল বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এবং অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের উপর। কারণ এবার লোকসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার আসন লাভ করতে পারেনি। ফলে এককভাবে দিল্লির মসনদে বসতে পারল না। তবে কখন কী করে বসে, তাই তাকে বিশ্বাস করা যায় না। বিরোধী জোটে কংগ্রেস ৯৯ আসন পেয়ে সবার উপরে রয়েছে। নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবুর দল এনডিএ-তে যোগ দেওয়ার জন্য গত বাজেটে এই দুই রাজ্যের জন্য প্রচুর টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে।
Advertisement
রাজ্যসভার পরিচালনা কালে চেয়ারম্যান ধনকড়ের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এই অনাস্থা প্রস্তাব। যদিও এই প্রস্তাব আনার ঘটনাকে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে বিরোধীদের এই পদক্ষেপ। রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা এখন ২৩৭— এনডিএ ১১৯। তাই ভোটাভুটিতে পরাজয় হবে জেনেও, ধনকড়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করাকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল। কীভাবে এই ঐক্য সম্ভব হল, তা নিয়ে অবশ্য নানা বিশ্লেষণ। গত বাদল অধিবেশনে তৃণমূল নেতৃত্ব এই অনাস্থা প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস তাতে সায় দেয়নি। এবারও কংগ্রেস যখন ঘুষ কাণ্ড নিয়ে সরব হয়েছে, তখন তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রায় এক সপ্তাহ আগে তৃণমূল রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রস্তাব দেয় কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধির কাছে। কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ জয়রাম রমেশ বলেছেন, লোকসভার স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার নজির রয়েছে। কিন্তু রাজ্যসভার এই ৭২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বিরোধীরা একত্র হয়ে সরকারিভাবে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনল।
Advertisement
রাজ্যসভার চেয়ারম্যান দেশের উপরাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাজ্যসভার অধিবেশনের হাল এতই খারাপ যে, অনাস্থা প্রস্তাব আনা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তৃণমূলের রাজ্যসভার এক নেতা বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করার স্বার্থে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা একটি নজির হয়ে রইল। রাজ্যসভার ৬০ জন বিরোধী সাংসদের প্রস্তাবের প্রারম্ভে লেখা হয়েছে ধনকড় বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
এখন প্রশ্ন এটাই যে, তৃণমূল ও কংগ্রেস মিলে যে কাজটি করল, অর্থাৎ ধনকড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ দিল বটে, তবে এই দুই দলের মধ্যে ঐক্য চিরস্থায়ী হবে তো? কংগ্রেস লোকসভায় দ্বিতীয় বিরোধী দল— তার আসন সংখ্যা ৯৯। সুতরাং বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার প্রধান মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস তা মেনে নেবে তো? কারণ বিরোধী জোটে যেসব দল রয়েছে, তার মধ্যে কংগ্রেসই বড় দল— যার সর্বভারতীয় প্রাধান্য রয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে শাসক তৃণমূলের সম্পর্ক এখন খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে।
কংগ্রেসের নেতারা সুযোগ পেলেই তৃণমূল নেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনায় মুখর হন। কংগ্রেস রাজ্যের সিপিএমের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে লোকসভায় লড়েছিল, কিন্তু ফল অত্যন্ত শোচনীয়। রাজ্য কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অধীররঞ্জন চৌধুরি সুযোগ পেলেই মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। সুতরাং বিরোধী জোট ইন্ডিয়ায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের সম্পর্ক কোনদিকে গড়াবে, তা বলা যায় না। কারণ কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় দল, যেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গেই। অন্য রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেলেও, তার ফল ভালো নয়।
ইন্ডিয়া জোট এখন সর্বদাই এই চিন্তাতেই মগ্ন, কখন কেন্দ্রে এনডিএ সরকারের শরিক দলগুলির মধ্যে ভাঙন ধরে— বিশেষ করে বিহারের নীতিশ কুমারের দল কখন কী করে বসে, তা বলা যায় না। ইন্ডিয়া জোটের নেতারা আগেই বলেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পুরো পাঁচ বছর টিঁকবে না। তখন সুযোগ মিলবে ইন্ডিয়া জোটের সরকার গড়ার। জোটের নেতারা এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।
Advertisement



