নিজস্ব রাজনৈতিক দল ঘোষণা করে চমক দিলেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, টেসলা ও স্পেসএক্সের কর্ণধার ইলন মাস্ক। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, তাঁর গঠিত ‘আমেরিকা পার্টি’ ২০২৬ সালের ‘মিড-টার্ম ইলেকশন’-এ অংশগ্রহণ করবে। তবে এই ঘোষণার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে – যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় মাস্কের নতুন দল আদৌ টিকতে পারবে কি?
মার্কিন রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুই দলের মধ্যে – ডেমোক্র্যাটস ও রিপাবলিকানস। এর বাইরে ‘তৃতীয় দল’ হিসেবে টিকে থাকা বা প্রভাব তৈরি করা সবসময়ই কঠিন ছিল। মাস্কের দলের সামনে রয়েছে ৬টি বড় চ্যালেঞ্জ, যা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক বাধা: আমেরিকায় তৃতীয় দল গঠনের ক্ষেত্রে একাধিক আইনি ও প্রশাসনিক বাধা রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যের আলাদা নির্বাচন আইন রয়েছে, যেখানে নতুন দলের ব্যালটে নাম তুলতে গেলে হাজার হাজার ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়। সেই সঙ্গে, দলের বৈধ স্বীকৃতি পেতে প্রদেশ ও ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের নিয়মও মানতে হয়। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স নোয়েল বলেন, ‘আমেরিকায় এমন কোনও সফল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই, যা তৃতীয় দলকে মাথা তুলতে সাহায্য করে। এখানে জিতলেই সব পাওয়া যায়, হারলে কিছুই নয়।’
তৃতীয় দলের ইতিহাস আশাব্যঞ্জক নয়: আমেরিকার ইতিহাসে তৃতীয় দল একাধিকবার চেষ্টা করলেও জাতীয় স্তরে তাদের সাফল্য খুবই সীমিত। ১৯৬৮ সালে জর্জ ওয়ালেস আমেরিকান ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টির হয়ে কিছু ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেলেও প্রেসিডেন্ট হননি। ১৯৯২ সালে ধনকুবের রস পেরট ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোট একটিও পাননি। ২০০০ সালে গ্রিন পার্টির র্যাল্ফ নাদের ভোট ভাগ করে নেওয়ায় ফ্লোরিডায় জর্জ বুশের জয়ে সহায়ক হয়েছিলেন, তবুও নিজে ইলেক্টোরাল ভোট পাননি।
কৌশলগত সীমাবদ্ধতা: মাস্ক নিজেকে গ্রীক কৌশলবিদ এপামিননডাসের সঙ্গে তুলনা করলেও তাঁর রাজনৈতিক কৌশল এখনও অস্পষ্ট। কোন রাজ্যে কোন আসনে লড়বেন, কীভাবে ভোট বিভাজন করবেন, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, তাঁর প্রার্থীরা হয়তো নির্দিষ্টভাবে জিতবেন না, কিন্তু ভোট কাটতে পারেন – বিশেষত রিপাবলিকানদের ভোট। উত্তর ক্যারোলিনার মতো সুইং স্টেটে মাস্কের প্রার্থীরা ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারেন।
সমর্থকদের মধ্যে একতার অভাব: নতুন দল গঠনের পর সেটিকে সংগঠিত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মাস্কের সমর্থকেরা মূলত সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হলেও রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ নন। তাঁর দলের নেই কোনও স্থায়ী রাজনৈতিক ভিত্তি, নেই কোনও ভোটব্যাঙ্ক। সেই সঙ্গে আমেরিকার রাজনীতিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই প্রধান দলের প্রতি মানুষের আনুগত্যও প্রবল। এই পরিস্থিতিতে মাস্কের জন্য দল হিসেবে ‘আমেরিকা পার্টি’-কে গড়ে তোলা হবে দুঃসাধ্য।
রাজনৈতিক ‘বন্ধু’র অভাব: প্রথমে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করলেও, ‘বিগ অ্যান্ড বিউটিফুল বিল’ নিয়ে বিরোধে ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমানে রিপাবলিকানদের একাংশ তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। রাজনৈতিক মিত্র খুঁজে পাওয়া তাই মাস্কের জন্য আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও জানা গিয়েছে, রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান টমাস ম্যাসি ও দুটি ছোট অরিপাবলিকান গোষ্ঠী তাঁর পাশে থাকতে পারেন। তবে শুধুমাত্র অর্থ বা প্রভাব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন আদায় সহজ হবে না।
ধৈর্যের পরীক্ষা: সবচেয়ে বড় প্রশ্ন – মাস্ক এই লড়াইয়ে কতটা ধৈর্য ধরতে পারবেন? রকেট, গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এমনকি মস্তিষ্কের চিপ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই দ্রুত সাফল্য পেতে অভ্যস্ত মাস্ক। কিন্তু রাজনীতিতে সাফল্য আসতে সময় লাগে, লাগে বারবার পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা। অধ্যাপক হান্স নোয়েল বলছেন, ‘যিনি প্রতিষ্ঠানের বাইরে চলতেই পছন্দ করেন, তাঁর পক্ষে রাজনীতির ধাপে ধাপে নিয়ম মেনে এগনো সম্ভব হবে কি?’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ, জনপ্রিয়তা ও প্রযুক্তির দাপট নিয়ে ইলন মাস্ক নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে আমেরিকার রূঢ় রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবের লড়াই কঠিন। ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান, আইন, জনসমর্থন, রাজনৈতিক শত্রুতা— সবকিছু পেরিয়ে মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ আদৌ একটি শক্তিশালী বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে কি না, তা সময়ই বলবে।