নীল রঙের তীব্র বিষাক্ত সাপ নিয়ে অদ্ভুত এক মোহে মজেছে চিনের শহুরে তরুণ-তরুণীরা। বিপুল অর্থ খরচ করে বাড়িতে পুষছে নীলাভ বিষধর ভাইপার প্রজাতির সাপ। সমাজমাধ্যমে ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার তাগিদে এই ঝুঁকিপূর্ণ শখ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ পোষ্য নয়, বরং বিরল ও প্রাণঘাতী সাপকেই পছন্দের তালিকায় নিয়ে আসছে নতুন প্রজন্মের একাংশ।
চিনের একাধিক শহরে সাম্প্রতিক কালে এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে। তরুণদের বক্তব্য, নীল রঙের এই সাপ দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই বিরল। অনেকে আবার দাবি করছেন, এমন বিপজ্জনক সাপ পোষা নাকি সাহস ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। কিন্তু বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সামান্য অসতর্কতায় এই সাপের ছোবল যে কোনও মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রবল।
Advertisement
এই সাপ পোষার খরচও কম নয়। অবৈধ বাজারে একেকটি নীল পিট ভাইপারের দাম কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে বলে খবর। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বিশেষ কাচের খাঁচা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, আলাদা খাবার ও জরুরি চিকিৎসার প্রস্তুতি। এত কিছুর পরেও তরুণদের একাংশ বিপুল খরচ করতে পিছপা হচ্ছেন না।
Advertisement
বন্যপ্রাণ সংরক্ষণকর্মীদের অভিযোগ, এই প্রবণতার নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে অবৈধ পাচারচক্র। বনাঞ্চল থেকে এই বিষধর সাপ ধরে এনে শহরের গোপন বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং বিরল প্রজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
এই উন্মাদনার পিছনে একটি বিশেষ কারণও সামনে এসেছে। সাপকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি অ্যানিমেটেড ছবি ‘জুটোপিয়া টু’-র একটি চরিত্র চিনা তরুণ সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছবির নতুন চরিত্র ‘গ্যারি ডি’স্নেক’ একটি নীল রঙের সাপের আদলে তৈরি। এই চরিত্র থেকেই নীল বিষধর সাপ কেনার আগ্রহ বেড়েছে বলে চিনের সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছবিটি মুক্তির পর চিনা যুবক কিউ ওয়েইহাও একটি নীল ইন্দোনেশিয়ান পিট ভাইপার কিনেছেন। তিনি এটিকে পোষ্যের মতো যত্ন করতে শুরু করেছেন। জানা গিয়েছে, ছবির প্রিমিয়ার হওয়ার মাত্র দু’দিনের মধ্যেই প্রায় এক হাজার আটশো পঞ্চাশ ইউয়ান খরচ করে ওই সাপ কেনা হয়েছে। এই ঘটনার পর বাজারে নীল পিট ভাইপারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে।
চিনের বাজারে এই বিশেষ ধরনের সাপের অভাব দেখা দিয়েছে। কোথাও কয়েকশো ইউয়ান, কোথাও আবার কয়েক হাজার ইউয়ানে বিক্রি হচ্ছে এই বিষধর সাপ। অনলাইনে অর্ডারের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় বহু বিপণন মাধ্যমে এই সাপের বিক্রি বন্ধ করতে হয়েছে।
সরীসৃপ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পিট ভাইপার গোত্রের সাপ অত্যন্ত বিপজ্জনক। এদের চোখ ও নাকের মাঝখানে থাকা সংবেদী গর্তের সাহায্যে উষ্ণ রক্তের প্রাণী শনাক্ত করে মুহূর্তে ছোবল বসাতে পারে। নীল পিট ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ট্রাইমেরেসুরাস ইনসুলারিস’। শক্তিশালী হেমোটক্সিক বিষের কারণে কামড়ের জায়গায় তীব্র ব্যথা, ফুলে যাওয়া ও রক্তপাত হয়। অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে মৃত্যু বিরল হলেও অঙ্গ বিকল হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
চিনের আইন অনুযায়ী, বিষাক্ত ও বিপজ্জনক জীবন্ত প্রাণী কুরিয়ারে পাঠানো নিষিদ্ধ। তবে ইন্দোনেশিয়ান পিট ভাইপার রাখা পুরোপুরি বেআইনি নয়। সেই সুযোগ নিয়েই অনলাইনে গোপনে কেনাবেচা চলছে বলে অভিযোগ। সরকার-অনুমোদিত সংবাদমাধ্যমের মতে, কোনও বিষধর সাপ পালিয়ে গেলে বা আক্রমণ করলে তা জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
মনোবিদদের মতে, সমাজমাধ্যমে নজরে আসার আকাঙ্ক্ষা ও স্বীকৃতির লোভই তরুণ প্রজন্মের এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। ঝুঁকি যত বেশি, আকর্ষণ তত বাড়ছে। কিন্তু এই শখ যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এখন জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
Advertisement



