কলকাতার খুব কাছে মাত্র ৭০-৭৫ কিলোমিটার দূরে বাস করতেন কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণে বিশ্বকবির কলমে শ্রদ্ধাঞ্জলি ঝরে পড়েছিল, ’যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে/ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে, দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি/দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি’।
হাওড়া স্টেশন থেকে উঠে পড়লাম সাউথ-ইস্টার্ন রেলের মেচেদা-খড়গপুরগামী ট্রেনে। ‘দেউলটি’তে নেমে পড়লাম। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই এক-ঝাঁক গাড়ি, অটো, টোটো আর সাইকেল রিক্সা চালকের দল ঘিরে ধরল, ’শরৎ স্মৃতি মন্দির’?
Advertisement
উঠে পড়লাম একটা সাইকেল রিক্সাতে- উদ্দেশ্য চালকের সঙ্গে গল্প করতে করতে সামান্য তিন কিলোমিটার গ্রাম্য পথ অতিক্রম করব। মনে মনে ভাবলাম, দেব-দর্শন ত হয়নি, দেবালয়ই সই। দেখতে দেখতে সবুজে ঘেরা পুকুর, ডোবা আর খুচরো কয়েকটি কুঁড়েঘরের পাস কাটিয়ে এসে পৌঁছলাম ‘শরৎ স্মৃতি মন্দিরে’। রাস্তা থেকে বাড়ির গেটে ঢুকতেই, এক ভীষণ সম্ভ্রমে আপনা-আপনিই মাথাটা নত হয়ে এল।
Advertisement
ছোট লোহার গেটটি পেরুতে গিয়ে চোখে পড়ল অমর কথা-শিল্পীর মর্মস্পর্শী ছোট গল্প ‘মহেশ’ থেকে উদ্ধৃতি বাড়ির সিংহ দরজায় পাথরে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। গফুরের কান্না- ‘আল্লা,আমাকে যত-খুশি সাজা দিও কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনও মাপ ক’রো না’।
ঢুকেই দেখলাম ফুলে ফুলে ভরা ছোট বাগানটির মাঝখানে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে দোতলা বাড়িটি। বাঁদিকে ফুলের বাগানের মাঝে শরৎ চন্দ্রের একটি আবক্ষ পাথরের মূর্তি। দোতলা টালির ছাদের বাড়িটি বিদেশি ‘বর্মা’ স্টাইলে তৈরি। জীবনের বহুমূল্য শেষ বারোটা বছর শরৎ চন্দ্র এই বাড়িতেই কাটিয়েছিলেন, লেখা হয়েছিল কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাস, গল্প আর প্রবন্ধ।
রূপের বন্যা ছড়িয়ে বয়ে যাওয়া রূপনারায়ণ নদীর ধারে ‘সমতা’ গ্রামে, এই বাড়ির জমিটি উনি কিনেছিলেন বার্মা থেকে ফেরার পর ১৯১৭ সালে- মাত্র এগারোশো টাকায়। তখন রূপনারায়ণ নদী জমিটির গা ঘেঁষেই বইত। এখন অবশ্য নদী বেশ খানিকটা সরে গেছে।
শরৎ চন্দ্র ১১ বছর কাটিয়েছিলেন হাওড়ার বাজে শিবপুর অঞ্চলের পরপর তিনটি বাড়িতে। ‘সমতা’ গ্রামের জমিতে মাটির দেওয়ালের বাড়িটি তৈরি করা শুরু হয় ১৯২৩ সালে। ওই বছরেই স্বামী-স্ত্রী নতুন বাড়িতে উঠে আসেন। পরে অবশ্য, আশপাশের কিছু জমি আর পুকুর কিনে বাড়িটির সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করানো হয়। উনিই তখন এই এলাকার নাম দিলেন ‘সমতাবেড়’। বাড়ির পিছনের অংশে একটি কাঁচা মাটির কুঁড়েঘর ছিল যা এককালে রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পরে ১৯৭৬-এর বন্যায় সেটি ভেঙে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০১ সালে ‘হেরিটেজ অ্যাক্ট’ অনুসারে এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। পরে ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়িটির সম্পূর্ণ সংস্কার সাধন করান। বর্তমানে এটি একটি সংরক্ষিত স্মৃতি-স্থান, তবে কোনও প্রবেশ-মূল্য দিতে হয় না।
বর্মায় মাত্র দুই বছর প্রথমা স্ত্রী শান্তিদেবীর সঙ্গে ঘর করেছিলেন শরৎ চন্দ্র। কিন্ত রেঙ্গুনের ভয়াবহ প্লেগ রোগে একটি শিশুপুত্র-সহ স্ত্রীয়ের মৃত্যু হয় কিছুদিনের মধ্যেই। শান্তিদেবীর মৃত্যুর (১৯০৮) দু’বছর পরে ১৯১০-এ শরৎ চন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করেন- হিরণ্ময়ীদেবীকে। বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল মোক্ষদা। শরৎ চন্দ্রই সে নাম পাল্টে ‘হিরণ্ময়ী’ রেখেছিলেন। শরৎ চন্দ্রের মেজ ভাই প্রভাস, বেলুড় মঠের দীক্ষিত স্বামী বেদানন্দও এই বাড়িতেই থাকতেন ওঁর সঙ্গে। এখন বাড়ির পিছনের অংশে শরৎ চন্দ্র, হিরণ্ময়ীদেবী আর স্বামী বেদানন্দের তিনটি সমাধি-স্মৃতি প্রস্তর দেখা যায়।
সম্ভবত অনেক বছর বর্মাতে থাকার ফলেই শরৎচন্দ্রের বাঁশ আর পেয়ারা গাছের উপর আন্তরিক আকর্ষণ হয়। এই বাড়ির পিছনে তাই আছে একটি ছোট বাঁশঝাড় আর পেয়ারা গাছ।
এই বাড়িতে অবস্থানের সময়ই কথাশিল্পী, কালজয়ী কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প রচনা করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে আছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘মহেশ’, ‘শেষ পত্র’ ইত্যাদি। জনপ্রিয় উপন্যাসগুলি ছাড়াও এই অসাধারণ প্রতিভাধর সাহিত্যিক, ২৭টি বড় গল্প ও চারটি নাটকও রচনা করেছিলেন। ‘নারীর মূল্য’, ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ ইত্যাদি কয়েকটি বিখ্যাত প্রবন্ধও তাঁর অমর কৃর্তির অংশ। ‘মহেশ’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘নব-বিধান’ ইত্যাদির আংশিক বা সম্পূর্ণ রচনা, সমতাবেড়ের বাড়িতেই হয়েছিল।
বাজে শিবপুরে থাকার সময়ে ১৯২১ সনে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে, শরৎ চন্দ্র দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি পদে অভিষিক্ত ছিলেন। সক্রিয় বিপ্লবী না হলেও শরৎ চন্দ্র অহিংস কংগ্রেসের একজন ছোটখাটো নেতা ছিলেন এবং বরাবরই ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বহু বিপ্লবীকে অনেকবার তাঁর নিজস্ব রিভলভার, বন্দুকের গুলি, অর্থ আর সময়ে সময়ে ওঁদের এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েও সাহায্য করতেন। মহান নেতা রাসবিহারী বসু ছাড়াও, সে যুগের অনেক বিপ্লবী নেতাই এ বাড়িতে এসেছিলেন। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু বেশ কয়েকবার এসেছিলেন এখানে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এ বাড়িতে এসে শরৎ চন্দ্রকে একটি রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ মূর্তির যোগ্য স্থান এই বাড়িতেই।’ সেই থেকেই এখানে ওই দু’ফুট উঁচু মূর্তির ভক্তিভরে দৈনিক পূজা-অর্চনা হয়। দোতলার একটি ঘরে আজও প্রতিদিন একজন পুরোহিত এসে ফুল-ফল সহকারে এই বিগ্রহের পূজা করে যান।
সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল ও পত্নী-প্রেমিক। মোট বারো বছর শরৎ চন্দ্র কাটিয়েছিলেন সমতাবেড়ের বাড়িতে। পরে সম্ভবত স্বাস্থ্যের কারণেই, কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে (অশ্বিনী দত্ত রোড) একটি ছোট দোতলা বাড়িতে বাসস্থান স্থানান্তরিত করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণেই এইসময় কখনও সমতাবেড়ে, আবার কখনও কলকাতার বাড়িতে থাকতেন। সেকালের বিখ্যাত চিকিৎসক ড. বিধান চন্দ্র রায়, করুণা শঙ্কর রায় প্রমুখরা ছিলেন ওঁর চিকিৎসক। পরিশেষে,স্বনামধন্য শল্য-চিকিৎসক ড. ললিত মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৮ সনের ১২ জানুয়ারি, ওঁর পেটে অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না। চারদিন পরে ১৬ তারিখে মাত্র ৬১ বছর ৪ মাস বয়সে এই মহান মানবদরদী সাহিত্যিক দেহত্যাগ করেন।
বেশ কিছুটা সময় শরৎ স্মৃতি মন্দিরে কাটানোর পরও ফেরার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু জীবনে আরও কিছু ঐহিক কাজ-কর্মের তাড়নায় ফিরতেই হয়। ফেরার পথে চললাম কাঁচা রাস্তায় এই পুণ্যভূমির স্পর্শ নিয়ে কয়েকশো গজ এগিয়ে, রূপের ছটা ছড়িয়ে বয়ে যাওয়া রূপনারায়ণের তীরে। নদীতে তখন ভাটা চলছিল। কুলু কুলু করে বয়ে চলেছে অপরূপ রূপনারায়ণ। দিনটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর, তাই রূপনারায়ণের জলে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখে, ডাবের জল খেয়ে ফেরার জন্য টোটো-তে উঠলাম।
Advertisement



