শঙ্খ অধিকারী
‘বাঁকুড়ার ঘোড়া, তোকে কে করেছে সৃষ্টি
চার পায়ে ছুটে যাস… কত যে তেপান্তর
শিল্পীর হাতে গড়া বাংলার কৃষ্টি
শুধু নোস পোড়ামাটি, কত বড় অন্তর।’
চারণকবি বৈদ্যনাথের এই কবিতার সূত্র ধরে বাঁকুড়ার ঘোড়ার আঁতুড়ঘর ঘুরে আসা যেতে পারে একদিনেই। বাঁকুড়ার পর্যটন মানচিত্রে পোড়ামাটির জন্য বিখ্যাত এই স্থানটি সবার কাছেই আকর্ষণের কেন্দ্র। বাঁকুড়া জেলার নানা শিল্পের মধ্যে এই পোড়ামাটির ঘোড়া তৈরির শিল্পটি যথেষ্ট প্রাচীন এবং রাজ্য জুড়ে এর গুরুত্বও রয়েছে। শুধু দেখনদারি সৌন্দর্য নয় এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও নেহাত কম নয়। সুপ্রাচীন এই গ্রামের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে পোড়ামাটির শিল্পের কাজ। নিকটবর্তী বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির হাটে বিকোনো অনেক কাজই এই পাঁচমুড়ার। তাই যারা মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর আসবেন, তাঁরা এই পোড়ামাটির কাজের সূতিকাগারটি না ঘুরে গেলে বেড়ানোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঘরের শোভা বাড়ানোর উপকরণ থেকে শুরু করে আজ এই পোড়ামাটির কাজ বড়ো বড়ো উৎসব, অনুষ্ঠানে, সেমিনারে স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া ধর্মরাজ ঠাকুরের নিজভূমি এই বাঁকুড়ায় দেবতা হিসেবে মনসা বা হাতি-ঘোড়া বোঙা ঠাকুরের চাহিদা থাকে। মূলত সেই চাহিদা থেকেই পাঁচ মুড়ার কুম্ভকার বংশ এই কাজ শুরু করে। এখন এই পোড়ামাটির কাজ শুধু হাতি ঘোড়া আর মনসাতেই আটকে নেই। পুজোর সময় দেশ বিদেশেও চাহিদা থাকে এখানকার পোড়ামাটির দুর্গামূর্তির। কুমোরপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে সেইরকম এক শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল, যাঁর তৈরি প্রতিমা জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে। এই শিল্পের ঐতিহ্য আজকের নয়। বহু বছর ধরে রয়েছে এর স্থানীয় চাহিদা রয়েছে, যে সময় সাধারণ বাড়িঘরে ব্যবহার করা হত মাটির তৈজস।
১৯৬৯ সালে এই গ্রামের এক প্রথিতযশা শিল্পী রাসবিহারী কুম্ভকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শিল্পকর্মের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। তারপর থেকে দ্রুত প্রসার ঘটে এই শিল্পের। আর এই শিল্পকর্মগুলি কীভাবে তৈরি হয়, তা চাক্ষুষ করার জন্য ভীড় জমান দেশ বিদেশের নানা প্রান্তের পর্যটকরা। ২০১৮ সালে এই পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়াকে জিআই ট্যাগ দেওয়া হয়। এই জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব বাড়ে এই শিল্পের। তথ্য বলছে বর্তমানে প্রায় একশোর কাছাকাছি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। পুরো পাড়া যেন একটি ওয়ার্কশপ। প্রায় সমস্ত ঘরের উঠোনে শুকোচ্ছে পোড়ামাটির নানা কাজ। কেউ বা চাকা ঘুরিয়ে মনের আনন্দে আঙুলের খেলায় কাঁচা মাটির তালকে আকার দিচ্ছেন শিল্পে। এরই মাঝে বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে চতুর্দিকে। সবটা মিলিয়ে এ যেন এক টেরাকোটার স্বর্গরাজ্য। তবে বেশ কিছু শিল্পীর কন্ঠে খানিকটা আক্ষেপ আর দুঃখের স্বরও শোনা যাচ্ছিল। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই এই পেশাকে গ্রহণ করতে পারছেন না নানা কারনে। চাহিদা থাকলেও বছরের সবসময় নাকি এর দাম সমান থাকে না। আর বিদেশে রপ্তানি করতে না পারলে তাঁরা কিছু বাড়তি মুনাফাও পান না।
কাঁচা মাটিকে তুলে এনে তা পাট করে চাকা ঘুরিয়ে বানানো এবং পরে তা রোদে শুকানো, তারপর আগুনে পোড়ানো– এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাতে অনেকেরই ধৈর্য থাকে না। কথা বলে জানা গেল, এই ঘোড়ার উচ্চতা ১ ফুট থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। দাম শুরু ২০০/৩০০টাকা থেকে। এই শিল্পের প্রচারও রয়েছে। সরকারি মেলা অনুষ্ঠানে তাদের স্টল থাকে। বিশেষ করে বিষ্ণুপুর শিল্পমেলায় তাঁরা তাঁদের শিল্পকর্ম তুলে ধরেন। ইদানীং কয়েক বছর একটি বেসরকারি উদ্যোগে পাঁচমুড়ার কুম্ভকার পাড়ায় ‘টেরাকোটা মেলা’র আয়োজন করা হয়, কিন্তু তা একেবারেই জৌলুসহীন। তবু এই শিল্পের কদর শিল্পবোদ্ধা মানুষের মনে চিরকাল থাকবে। আর এই ছোট্ট গ্রামটি ঘুরতে এলে ফাউ হিসেবে মিলবে আরেকটি ধর্মীয় স্থান যা ইদানীং ভক্তদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। প্রধান সড়কের একেবারে গায়ে পাঁচমুড়া ত্রিধারা মিলন মন্দির। বিষ্ণুপুর শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার ব্যাবধানে এই জনপদ। জঙ্গলের মাঝে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে কখন বিভোর হয়ে পড়বেন নিজেই বুঝতে পারবেন না।