• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

খাজিয়ার ভারতের ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’

উত্তর-পশ্চিম ভারতে হিমালয়ের কোলে এর অবস্থান। সুন্দরী পাহাড়ি রাজ্য হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত, খাজিয়ারকে বলা হয় ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’। প্রকৃতির এই এক টুকরো স্বর্গ, দর্শন করে এলেন অনামিকা মণ্ডল সেনগুপ্ত।

ফাইল চিত্র

এখানে মেঘেরা নীল আকাশের আঙিনায়, কুসুমরঙা সূর্যের সঙ্গে বারো মাস লুকোচুরি খেলে। মখমলের মতো সবুজ ঘাসের গালিচায় শুয়ে থাকা, টলটলে স্বচ্ছ জলের বুকে আকাশের ছায়া পড়ে। এ যেন প্রকৃতির এক নিজস্ব আয়না। মাথার উপরের আকাশ কিংবা আশেপাশের পাইন বন, সকলেই যেখানে মুখ দেখে। এ রকমই ভারতের ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ খাজিয়ারের সৌন্দর্য।

উত্তর-পশ্চিম ভারতের হিমালয়ের বুকের এক সুন্দরী পাহাড়ি রাজ্য হিমাচল প্রদেশ। পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ সব কিছু মিলিয়ে হিমাচল প্রদেশ এক কথায় অতুলনীয়। তারই টানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে। ডালহৌসি এবং খাজিয়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলে, তা সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে।

Advertisement

১৯৯২ সালের ৭ জুলাই, সুইজারল্যান্ডের ভাইস চ্যান্সেলার ও ভারতে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত উইলি ব্লেজার, খাজিয়ারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের সাদৃশ্য দেখে খাজিয়ারের নাম দেন, ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’। আমাদের এবারের ভ্রমণ সেই সুরম্য স্থানেই।

Advertisement

অক্টোবরে পূজা শেষ হওয়ার পরেই একটু খোঁজ খবর নিয়ে ঠিক করলাম ধরমশালা, ডালহৌসি, খাজিয়ারের মতো, হিমাচলের এমন কিছু জায়গায় যাব যেখানে তুলনায় কম টুরিষ্ট যায় এবং সেখানে ক্যাম্পিং করব। এ যাত্রায় আমাদের এক দিল্লি প্রবাসী বন্ধুও সঙ্গী হল।

প্রথমে কলকাতা থেকে দিল্লি, তারপর কাশ্মীরি গেট থেকে রাত আটটার ধরমশালাগামী বাসে উঠে, পরের দিন বেলা ন’টায় ধরমশালা গিয়ে পৌঁছলাম। আমাদের নির্ধারিত হোটেলটি ছিল ম্যাকলয়েডগঞ্জে। সারাটা দিন বিশ্রাম করে, বিকেলে গেলাম ম্যাল রোডে। ধরমশালায় তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা থাকেন। তাঁর ভক্তদের অনেকেই এখানে বসবাস করেন। তাই এখানে তিব্বতি সংস্কৃতির ভীষণ প্রভাব।

সন্ধের ঝলমলে ম্যাল রোডে চারিদিকে তিব্বতি থাঙ্কা ও পতাকা ঝুলছে। তার সঙ্গে নানা স্বাদের কুকিজ, শীতের পোশাক, কেক, হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর শো-পিস! সব কিছু নিয়ে ভীষণ সুন্দর আর জমজমাট জায়গাটা। অক্টোবর মাসে বেশ ঠান্ডা পড়ে। আমরা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে, একটা ভালো তিব্বতি রেস্টুরেন্ট দেখে রাতের খাবার খেতে ঢুকলাম। প্রথমেই খেলাম বাটার দেওয়া তিব্বতি নোনতা চা, ‘পো চাও’। এরপর টেবিলে এল তিব্বতি বান, নুডুলস, আচার ও দু-তিন রকমের সবজি-সহ একটা স্পেশাল থালি। সত্যি বলতে কি, এই টুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওনা এই থালি।

পরের দিন দালাই লামার আবাসস্থল-সহ ধরমশালার কয়েকটা দর্শনীয় স্থান দেখে নিয়ে, চললাম ডালহৌসির উদ্দেশ্যে। ডালহৌসি থেকে ধরমশালার দূরত্ব ১১৮ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। যাওয়ার পথে চোখে পড়ছিল মখমলের মতো নরম ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর, আবার কোথাও ঝরনা নামছিল পাহাড়ের মাথার উপর থেকে। হিমালয়ের এই অনন্য সুন্দর পথশোভা দেখতে দেখতে, পড়ন্ত বিকেলে আমরা ডালহৌসিতে এসে পৌঁছলাম।

ডালহৌসি, হিমাচলের চাম্বা জেলার একটি ছোট শৈলশহর। মনোরম আবহাওয়া ও হিমালয়ের অপার সৌন্দর্যের কারণে, ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এটি একটি খুব পছন্দের জায়গা। তবে সিমলা অথবা মানালির মতো টুরিস্টদের ভিড় এখানে নেই। সরু একফালি গলির মতো ডালহৌসির ম্যাল রোড। তারই ডাইনে-বাঁয়ে রয়েছে সারি সারি দোকান। পর্যটকরা কখনও গলির কিনারের দেওয়ালে হেলান দিয়ে গল্প করছেন, আবার কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাবার খেতে খেতে পিছনের লোকের চলাচলের জায়গা করে দিচ্ছেন। আমরাও ওই গলির মধ্যে কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে, ম্যালের অন্য প্রান্তের ভুটিয়া বাজারে চলে গেলাম। ওখান থেকে মোটা শীত-পোশাক ও কিছু ড্রাই ফ্রুটস কিনে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

আমাদের হোটেলটা ছিল ডালহৌসির নির্জন পাহাড়ের ঢালের মধ্যে। হোটেলের বারান্দা থেকে দূরের ডালহৌসি শহরের বিন্দু বিন্দু আলো দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিল। অনেক রাত অবধি আমরা হোটেলের বারান্দা থেকে ডালহৌসি শহরকে দেখছিলাম। এক আকাশ তারার নিচে অন্ধকার রহস্যময় পাহাড়! আর তার গায়ে টিমটিমে আলোগুলো দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিল। কিন্তু তারই মধ্যে কয়েকজন অবিবচক পর্যটকের তারস্বরে ডিজে-তে গান বাজানোর কারণে, প্রকৃতির নির্জনতা যেন খানখান হয়ে যাচ্ছিল।

পরের দিনের প্ল্যান মাফিক আমরা গেলাম খাজিয়ারে। ডালহৌসি থেকে খাজিয়ারের দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। পাহাড়ি পথে যেতে সময় লাগে একঘন্টার মতো। জলখাবার খেয়ে নিয়ে, বেলা ন’টার মধ্যেই আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। পরিকল্পনায় ছিল আমরা খাজিয়ারের ক্যাম্পে থাকব।

বেলা সাড়ে দশটার সময় আমরা খাজিয়ারে এসে পৌঁছলাম। ক্যাম্প সাইটে কী মিলবে জানি না। তাই আমরা রাস্তা থেকে বেশ কিছু খাবার ও জল কিনে নিয়েছিলাম। যদিও দেখলাম খাজিয়ারে সব কিছুই পাওয়া যায়। প্রথমেই আমরা সেই সাইনবোর্ডটা দেখতে পেলাম, যেখানে স্বয়ং সুইজারল্যান্ডের রাস্ট্রদূত ও ভাইস চ্যান্সেলার, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের এই খাজিয়ার গ্রাউন্ডের মিল পেয়ে একে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলকের মধ্যে ওখান থেকে সুইজারল্যান্ডের দূরত্ব ৬,১৯৪ কিমি লেখা আছে।

আমরা চলে এলাম খাজিয়ার গ্রাউন্ডের সামনে। রাস্তা থেকে নেমেই ঘন মখমলের মতো ঘাসে ছাওয়া বিশাল এক প্রান্তর। আর মাঝে একটা টলটলে জলে ভরা লেক। তার উপর দিয়ে গেছে কাঠের সেতু। মাঠের শেষে দুটো নির্জন কটেজ। খোঁজ নিয়ে জানলাম ওগুলো আসলে হিমাচল গভর্মেন্টের টুরিজম ডিপার্টমেন্টের।

মাত্র দুটো কটেজ। তাই অনেক আগে থেকে বুক করতে হয়। ঠিক করলাম পরের বার এলে, অবশ্যই এই কটেজে থাকব। কিছুক্ষণ ওখানে থেকে আমরা চলে এলাম খাজ্জিনাগ বা সর্পদের প্রভুর মন্দিরে। মন্দিরটি বারোশো শতকে হিন্দু ও মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে শিব, হিড়িম্বা, পাণ্ডব ও কৌরবদের মূর্তি আছে। এরপর আমরা মন্দিরের পাশের উপত্যকায় রোমাঞ্চকর প্যারাগ্রাইডিং সেরে, চলে এলাম খাজিয়ারের মূল গ্রাউন্ডের সামনে।

এখান থেকে হুডখোলা ভ্যানে চেপে আমাদের গন্তব্য খাজিয়ার ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। ওখানে একসময় একটা জলাশয় বা পোখরি ছিল। কিন্তু এখন সেটা শুকিয়ে গেছে। লোকে ওই জায়গাটাকে বলে খোরপোখরি।  কালাটপ অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে আমাদের ভ্যান ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আমাদের নিয়ে চলল। পথে পড়ল ঘন দেওদার, পাইন, ফারের বন। নানা ধরনের পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমরা চললাম অভয়ারণ্যের ভেতরে।

প্রায় তিরিশ মিনিট পরে এসে পৌঁছলাম পাহাড়ের মাথার এক সমতল জায়গায়। চারিদিকে ফুলের বন, দূরে পশ্চিম হিমালয়ের ধৌলাধার পর্বতমালার তুষারশুভ্র চূড়ায়, সূর্যের কিরণ পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে চূড়াটা যেন সোনার মুকুট পরেছে। তারই মাঝে ক্যাম্প করা রয়েছে। ড্রাইভারের সাহায্যে ক্যাম্পে থাকার এবং স্থানীয় হিমাচলি কুইজিন খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। খুবই সাধারণ তাঁবু। হোটেলের মতো সুবিধা সেখানে নেই। তবুও প্রতি মূহুর্তে অনুভব করলাম প্রকৃতির রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য।

পরদিন আবার ওই গাড়িতেই ফিরে এলাম খাজিয়ার গ্রাউন্ডের সামনে। তারপর ডালহৌসি থেকে যে-গাড়িতে করে এসেছিলাম, তাতে চড়েই পঞ্চপুল্লা জলপ্রপাত দেখে, আমরা ফিরে গেলাম ডালহৌসিতে। সেদিনই রাতের বাসে চড়ে পরদিন সকালে আবার দিল্লি ফিরে এলাম।

Advertisement