• facebook
  • twitter
Sunday, 16 February, 2025

ছুটির মেজাজে কেওনঝাড়ে

ওড়িশার কেওনঝাড় জেলা সবুজ বনানী, নদী এবং জলপ্রপাত নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পূর্ণ। এটি মূলত একটি উপজাতি অঞ্চল, যেখানে ভূমিজ, হো, কোরা, ওরাওঁ, বাথুডি এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাস। ছোট্ট ছুটিতে ঘুরে এলেন অবন্তী সিনহা।

কলকাতা থেকে কেওনঝাড় ট্যুরের জন্য একটি সপ্তাহান্তের ছুটিই যথেষ্ট। তবে একটু খুঁটিয়ে দেখতে হলে ৪টে দিন হাতে রাখা খুব জরুরি। কিন্তু আমাদের সে উপায় ছিল না, ফলে সপ্তাহান্তের দুটো দিনকেই সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম শীতের এক শুক্রবারে। কেন্দুঝাড় বা কেওনঝাড় মূলত একটি উপজাতি এলাকা, যেখানে ভূমিজ, হো, কোরা, ওরাওঁ, বাথুডি এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাস। শহরটি ওড়িশা রাজ্যের কেওনঝাড় জেলায় অবস্থিত।

কেন্দুঝারে পৌঁছনোর জন্য হয় জাজপুর রোড নামতে হবে বা বারবিল। আমরা হাওড়া থেকে সকাল ৬.২০-র বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে রওনা হলাম। বারবিল পৌঁছতে প্রায় ২টো বেজে যায়। বারবিল থেকে গাড়িতে ৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে কেওনঝাড়ের অবস্থান।
ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযাগ আগেই করা ছিল। আমাদের থাকার জায়গা নির্দিষ্ট হয়েছে ওড়িশা টুরিজমের পান্থনিবাসে। তারই উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম।

লাঞ্চ সেরে ঘাটগাঁওয়ে মা তারিণীর মন্দির দর্শন করতে গেলাম। ঘাটগাঁওকে ঘিরে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। একবার কাঞ্চির রাজা মা তারিণীকে তাঁর দেশে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দেবী তারিণী তাঁর আমন্ত্রণে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন যে, তিনি কখনওই পিছন ফিরে তাকাবেন না। রাজা নিষেধ সত্ত্বেও যদি এই কাজ করেন, তবে সেই জায়গাটিতেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাঞ্চিরাজ সেই শর্তে সম্মত হন এবং যাত্রা শুরু করেন। ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ যাত্রার পর ঘাটগাঁওয়ে তাঁর সন্দেহ হয় যে দেবী তাঁকে অনুসরণ করছেন না, তাই পিছন ফিরে তাকান। সঙ্গে সঙ্গে দেবী মূর্তিতে পরিণত হন। সেই দিন থেকে সেখানেই দেবীর পূজা করা হয়। এছাড়াও তাঁর উপাসনার জন্য অন্যান্য শর্তও ছিল। তাঁর জন্য কোনও মন্দিরের প্রয়োজন নেই, উপজাতি পুরোহিত তাঁর পূজা করবেন ইত্যাদি। তাই প্রাথমিক অবস্থায় মূর্তিটিকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য কেবল সাধারণ একটি আচ্ছাদন তৈরি করা হয়। কিন্তু পরে ভক্তদের ভক্তির জেরে শেষ পর্যন্ত একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

আরেকটি কিংবদন্তি হল নারকেলের প্রতি দেবীর অনুরাগ। তাই তাঁর দর্শনের জন্য সঙ্গে করে অন্তত একটি নারকেল নিয়ে আসুন। এছাড়াও আপনি যদি দেবীর মন্দিরে নারকেল পাঠাতে চান, তবে যে-কোনও গাড়ির চালককে দিন, তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং মন্দিরে পাঠানোর দায়িত্ব তাঁর। তারিণী ভক্তদের নেটওয়ার্ক খুব বড়, তাই যে-কোনও উপায়ে এটি মন্দিরে পৌঁছনো যাবে।

ভিড়ে ঠাসা মন্দির চত্বর। জানতে পারলাম চৈত্র পূর্ণিমার মাসে স্থানীয় মানুষ মহা বিশ্ব সংক্রান্তি জাঁকজমকের সঙ্গে এখানে পালন করে। রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং রাজ্যের বাইরে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী সারা বছর দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে ভিড় করেন।

পরদিন সকালে প্রাতরাশে চিঁড়ের পোলাও, পুরি-সবজি আর কফি খেয়ে, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লোকাল সাইট সিয়িংয়ের উদ্দেশে। আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন কাঞ্জারি ড্যাম। শালবনে ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে এই বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছেই চোখ জুড়িয়ে গেল। এই সেচ প্রকল্পটি তৈরি হয়েছে বৈতরণী নদীর একটি উপনদী, কাঞ্জারি নালা জুড়ে। প্রায় ৯৮০০ হেক্টর আয়তনের এই জলাধার প্রকল্প। ১৯৮০ সালে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। বাঁধের প্রান্ত অবধি যাওয়ার জন্য রয়েছে সিমেন্টে বাঁধানো সেতু।

একটু চা বিরতি সেরে আমরা রওনা দিই গুন্ডিচাঘাগী জলপ্রপাতটি দেখব বলে। ভেষজ বৃক্ষে ঢাকা পরিবেশের মাঝখানে এই প্রপাতটিকে ঘিরে, গড়ে উঠেছে পিকনিকের জায়গা। দূর থেকেই নজরে আসে ফলস। এই জলপ্রপাতটির দূরত্ব ঘাটগাঁও থেকে মাত্র ১২ কিমি।

জলপ্রপাতের সৌন্দর্য যারা দেখতে চান, তাঁদের ভ্রমণের জন্য আদর্শ এই কেওনঝাড়। একাধিক প্রপাত আছে এর আশেপাশে। কিন্তু মনে মনে প্রস্তুতি রাখুন প্রতিটি লোকেশনে পৌঁছতেই বেশ কিছুটা পথ পেরোতে হবে। আমাদের পরের ডেস্টিনেশন ভীমকুণ্ড।

ভীমকুণ্ড জলপ্রপাত এক অসামান্য প্রাকৃতিক বিস্ময়। যে না নিজে চোখে দেখেছে এর বিশালত্ব এবং সৌন্দর্য, ছবিতে বা ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না। পথেই লাঞ্চ সেরে, সবুজে ঢাকা পাহাড় শ্রেণী, শাল, মহুয়া, গরানে ঢাকা জঙ্গুলে পথ পেরিয়ে, অবশেষে পৌঁছলাম ভীমকুণ্ডে। দেখে বুঝতে আসুবিধা হয় না যে, বর্ষায় এই জলপ্রপাত কী ভয়ংকর সুন্দর রূপ ধারণ করে! আমরা শীতে গেছি, তাই জলধারা এবং স্রোত কিছুটা কম। ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে বিশালাকার চ্যাটালো পাথর আর তার মাঝে জলপ্রপাতের ছোট, বড় ও মাঝারি ধারাস্রোত কিন্তু বয়ে চলেছে।

সবুজ বনে বেষ্টিত একটি দর্শনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে এই ভীমকুণ্ডে। বৈতরণী নদী তার রাজকীয় বৈভব নিয়ে এখানে সানাকুণ্ড ও বাদাকুণ্ড নামে দুটি সুন্দর জলপ্রপাতকে একত্রিত করেছে। তা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই ভীমকুণ্ড।

এক বিশাল উল্লম্ব আকৃতির গিরিখাত এবং দ্রুতগতির স্রোতের কারণে, জলপ্রপাতটি দর্শনার্থীদের দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী করে। পুরো ভূখণ্ডটি টপ শটে দেখার জন্য রয়েছে একটি ওয়াচটাওয়ার। জলপ্রপাতের গর্জন এই স্থানটিকে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই জলপ্রপাতটিকে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মকর সংক্রান্তির বার্ষিক উদযাপনের সময়, স্থানীয় মানুষ এখানে প্রচুর সংখ্যায় জড়ো হন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, পাণ্ডবরা তাঁদের নির্বাসন কালে, এখানে কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন। তবে পর্যটকদের রাতে থাকার এই মুহূর্তে ব্যবস্থা নেই, কিন্তু কিছু কটেজ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। আগামী দিনে সীতাবিঞ্জি স্টেশনে নেমে এই ভীমকুণ্ডে এসে থাকতে পারবেন ভ্রমণার্থীরা।

পরের ডেস্টিনেশন সীতাবিঞ্জি। এই অঞ্চলটির পাহাড়, খুব খাড়া এবং এর শিলা গঠনের উৎস ডোলেরাইট। সীতাবিঞ্জি ফ্রেস্কো পেইন্টিং এবং শিলালিপি, পবিত্র সীতা নদীর তীরে একটি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত। এখানে রয়েছে একটি চমৎকার পাথর, দেখে মনে হয় গ্রামের উঠোনে একটি মন্দির যেন দাঁড়িয়ে আছে। এর উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট।

মিথ আছে সীতা তাঁর দুই পুত্র লব ও কুশকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাবণ চাহায়া নামে একটি পাথরের উপর রয়েছে বিখ্যাত প্রাচীন ফ্রেস্কো চিত্র, যা দেখতে অর্ধেক খোলা ছাতার মতো। ফ্রেস্কোতে রাম ও রাবণের কিংবদন্তি যুদ্ধকে চিত্রিত করা হয়েছে। এই স্থানের কাছাকাছি একাধিক শিলালিপিও পাওয়া গেছে, যা এখনও আধুনিক ইতিহাসবিদদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়নি। এক সময় একটি মহান সভ্যতা হয়তো এখানে ছিল, কারণ এই স্থানের ইট এবং অন্যান্য প্রাচীন নিদর্শনগুলি মূলত মাটির তৈরি। ইতিহাসের চিহ্ণগুলির সর্বশেষ অবশিষ্টাংশ, ভারতের গুপ্ত যুগের বলে দাবি করা হয়। বর্তমানে এএসআই সংরক্ষণ করে এই স্থানটির। সন্ধে নামছে ধীর পায়ে। দূরে কোনও গ্রামে পরব আছে। কানে আসছে মাদলের শব্দ আর আদিবাসীদের গান। সেই সুরকে সঙ্গী করে, সেদিনের মতো ফিরে এলাম ওটিডিসিতে।

পরের দিন আমাদের ফেরার পালা। সড়কপথে কলকাতা ফিরব বলে গাড়ি বুক করা আছে। গাড়ির চালকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, ফেরার পথেই আমাদের দেখিয়ে দেবে সানা ঘাগরা জলপ্রপাত।

সম্বলপুরের দিকে জাতীয় মহাসড়ক নং ৬-এ কেওনঝাড় শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে অবস্থিত এই ঝরনা। মিশ্র পর্ণমোচী এবং নানা বনজ উদ্ভিদে ঘেরা জায়গাটিকে, বর্তমানে কিছুটা সাজানো পার্কের আকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবু সানা ঘাগরা জলপ্রপাত প্রাচীন বনভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেই যেন বাড়িয়ে তুলেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা ছায়া ঘেরা জায়গাটি দেখে, প্রচুর ছবি তুলে এবার ফেরার পথ ধরি। মন এবং শরীরে আর কোনও ক্লান্তি নেই, কেওনঝাড়ের বনজ প্রকৃতি এতটাই সতেজ করে তোলে।