পূর্বে আরও কয়েকবার হায়দরাবাদে এলেও দেখা হয়ে ওঠেনি চৌমহল্লা প্যালেস, যা এই শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। গত আগস্টে তাই প্রথম সুযোগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ওই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাসাদটিকে দেখব বলে। বেলা ১১টা নাগাদ গোপানপল্লী থেকে লাইনের অটোয় চেপে, চলে এলাম গাড়ির স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বহু কষ্টে উবের অটো বুক করে এগোলাম আমাদের দ্রষ্টব্য, ওল্ড হায়দরাবাদে অবস্থিত চৌমহল্লা প্যালেসের উদ্দেশে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা জার্নির পর আমরা এসে পৌঁছলাম প্যালেসের কাছে। অটো থেকে নেমে প্রথমেই প্যালেসে প্রবেশের টিকিট কেটে নিলাম। প্রবেশদ্বার থেকে নির্দেশিত বাঁদিকে এগিয়ে বড় ইমাম পেরিয়ে এসে হাজির হলাম চোখধাঁধানো এক বিশাল প্রাসাদের সামনে। আমরা হতবাক হয়ে গেলাম এই ‘খিলওয়াত মুবারক’-এর রাজকীয় সৌন্দর্যে, যাকে চৌমহল্লা প্যালেস-এর হৃদপিণ্ড বলা হয় ।
অতীতে এই চৌমহল্লা প্রাসাদটি ছিল হায়দরাবাদ স্টেট-এর নিজামদের অধীনে, যা বর্তমানে তেলেঙ্গানা রাজ্যে অবস্থিত। এই প্যালেস ছিল আসাফ জাহি বংশের (১৭২০-১৯৪৮) শক্তিস্থল এবং নিজামদের রাজত্বকালে সরকারি বাসভবন। বর্তমানে এই প্যালেস একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে, যার মালিকানা আজও নিজাম পরিবারের অধীনে।
চৌমহল্লা প্যালেস তৈরি হয়েছিল চারমিনার-এর কাছেই, যেখানে কুতুব শাহি বংশ এবং আসাফ জাহি বংশের পূর্বতন প্রাসাদ ছিল। এই প্যালেসের নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল নিজাম আলি খাঁ আসাফ জাহি (২)-এর রাজত্বকালে, ১৭৬৯ সালে। তিনিই আদেশ দিয়েছিলেন ওই চারটি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য এবং ‘চৌমহল্লা’ নামের উৎপত্তি তার থেকেই। প্রাসাদগুলির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয় আফজল উদ্ দৌলা আসাফ জাহি (৫)-এর রাজত্বকালে (১৮৫৭-১৮৬৯)। বেশ কয়েক দশক ধরে নির্মাণকার্য চলার ফলে এই প্রাসাদগুলিতে বিভিন্ন স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। চৌমহল্লা প্যালেস দুটি আঙিনা, দরবার হল, বাগান ও ঝরনা নিয়ে তৈরি। প্রথমে প্যালেস ছিল ৪৫ একর জায়গা জুড়ে কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১২ একর জায়গায় তার অবস্থান।
আমরা প্রথমে উত্তর আঙিনায় অবস্থিত বড় ইমাম-এর সারিবদ্ধ ঘরগুলির দালান পেরিয়ে একটি ঝরনা ও জলাশয়ের কাছে এসে পৌঁছলাম, যেখানে একসময়ে ছিল প্রশাসনিক দপ্তর এবং শিস-এ-আলত (দর্পণ-প্রতিচ্ছবি)। এখানে রয়েছে কয়েকটি মুঘল স্টাইলের গম্বুজ ও খিলান এবং বেশ কয়েকটি পার্সিয়ান সামগ্রী যা খিলওয়াত মুবারক-কে ভূষিত করেছে। আসাফ জাহি বংশের এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাসাদ হায়েদ্রাবাদের মানুষদের কাছে পরম গর্বের।
অসাধারণ সুন্দর স্তম্ভগুলির উপরে ‘দরবার হল’-এ রয়েছে সেরা মার্বেল পাথরে তৈরি প্ল্যাটফর্ম, যার উপর শোভা পাচ্ছে ‘তখত-ই-নিশান’ বা রাজসিংহাসন। এখানে বসেই নিজাম-রা তাঁদের ‘দরবার’ চালাতেন, পালন করতেন ধর্মীয় এবং অন্যান্য প্রতীকী অনুষ্ঠান। সেখানে দেখলাম বেলজিয়াম কাচে তৈরি ১৯টি অসাধারণ ঝাড়বাতি রয়েছে। আরও দেখলাম, ‘সেলাহ খানা’ যেখানে সাজানো আছে আসফ জাহি বংশের অস্ত্রসম্ভার ।
এগোলাম পশ্চিম দিকে প্যালেসের প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে, যেখানে রয়েছে একটি ‘ক্লক টাওয়ার’ যার আরেক নাম ‘খিলাফৎ ঘড়ি’। তিনতলা বিশিষ্ট শুভ্র বর্ণের ওই টাওয়ারে রয়েছে ব্যালকনি এবং মুঘল শৈলীর ঝারোখা। সেই ১৭৫০ সাল থেকে সময়ের জানান দিচ্ছে এই ঘড়ি। এরপর ‘কাউন্সিল হল’-এ না গেলেই নয়, যেখানে রয়েছে পাণ্ডুলিপি ও অমূল্য পুস্তকের দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ। নিজাম এই স্থানে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও তাঁর অতিথিদের সঙ্গে মিলিত হতেন।
দক্ষিণ আঙিনায় পৌঁছে দেখলাম আফজল মহল ছাড়া আরও তিনটি প্রাসাদ– মেহতাব মহল, তেহনিয়ত মহল এবং আফতাব মহল। এই চারটি প্রাসাদের অবস্থান একে অপরের প্রতিসম বিপরীতে, ‘নিওক্লাসিকাল শৈলী’-তে নির্মিত প্রাসাদগুলির মাঝে রয়েছে সুন্দর বাগান ও জলাশয়। এই নিওক্লাসিকাল প্যালেসে রয়েছে ইউরোপিয়ান শৈলীতে তৈরি স্তম্ভের সুউচ্চ বারান্দা। আফতাব মহল ও মেহতাব মহলের স্তম্ভগুলি আইকনিক অর্ডারের কিন্তু আফজল মহল ও তেহনিয়াত মহলের স্তম্ভগুলি কোরিয়ান্থান শৈলীর।
আমরা এবার চলে এলাম রোশন বাংলো-র কাছে। ষষ্ঠ নিজাম মীর মেহবুব আলি খান এই অট্টালিকায় থাকতেন। বাংলোর নাম তাঁর মায়ের নামে। অষ্টম নিজাম, বরকত আলি খান মুকাররম জাহি এবং তাঁর পরিবার, চৌমহল্লা প্যালেসের জৌলুস পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আজও এই চৌমহল্লা প্যালেস নিজাম বংশধরদের মালিকানায় রয়েছে এবং বর্তমানে এই সম্পত্তির মালিক বরকত আলি খান মুকাররম জাহি।
সব শেষে আমরা এসে পৌঁছলাম নিজামদের ব্যবহৃত রোলস রয়েস-সহ বিভিন্ন পুরনো গাড়ির সংগ্রহশালায়। ছবি তুলতেই হল সেই সব ঐতিহ্যপূর্ণ গাড়ির। আমরা অবশ্য আগেই দেখে নিয়েছিলাম প্যালেসের মিউজিয়াম, যেখানে সাজানো হয়েছে হায়েদ্রাবাদ শহরের উৎপত্তি ও বিবর্তন, নিজামদের সফলতার কাহিনী এবং এই শহরের উন্নতির জন্য তাঁদের অবদান। রাজপরিবারের সামাজিক জীবনধারার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় এই মিউজিয়ামে রক্ষিত বেশ কয়েকটি ছবির মাধ্যমে ।
এক ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়ে আমরা চৌমহল্লা প্যালেস থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা অটো ভাড়া করে ড্রাইভারকে বললাম, প্রথমে আমরা লাঞ্চ করব ‘পিস্তা হাউস’-এ এবং তারপর যাব ‘কুতুব শাহি টুম্বস’ দেখতে। বাতানুকূল হোটেলে ঢুকে বসলাম পছন্দসই জায়গায়। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিতে তৃপ্তির লাঞ্চ সারলাম।
লাঞ্চ করার পর ড্রাইভার মহম্মদ চাঁদকে ডেকে নিলাম এবং পাঁচ মিনিট পরেই আমাদের অটো চলতে শুরু করল। প্যালেস থেকে ‘কুতুব শাহি টুম্বস-’এর দূরত্ব কম নয়, প্রায় ১৪ কিমি। আমাদের ইচ্ছে, এবারে হায়েদ্রাবাদের কুকিস কিনব ‘নিমরাহ’ থেকে। নানা ধরনের কুকিস কিনে ফিরে এলাম অটোর কাছে। অবশেষে সোয়া ৩টে নাগাদ অটো যাত্রা শুরু করল কুতুব শাহি সমাধিস্থলের উদ্দেশে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে প্রায় এক ঘণ্টা পরে অটো এসে থামল ইব্রাহিম বাগের কাছে অবস্থিত কুতুব শাহি টুম্বস-এর টিকিট ঘরের কাছে। এই সমাধিক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থান গোলকোণ্ডা ফোর্ট এবং তার ‘বাঞ্জারা দরওয়াজা’-র বাইরে ঘেরা প্রাচীরের উত্তরে।
লক্ষ্য করলাম, প্রতিটা সমাধিই একটি উত্থিত প্ল্যাটফর্মের উপর তৈরি। সমাধির গম্বুজাকৃতি গঠন একটি বর্গকার ভিত্তির উপর তৈরি যা ছুঁচালো খিলান দিয়ে ঘেরা। এ যেন পারসি ও ভারতীয় শৈলীর সংমিশ্রণ। যেটা সহজেই চোখে পড়ে তা হল, ছোট সমাধির গ্যালারিগুলো একতলা বিশিষ্ট এবং বড় সমাধির গ্যালারিগুলো দুইতলা বিশিষ্ট। প্রতিটা সমাধির মধ্যস্থলে রয়েছে দাফন খিলান। একটি সমাধি অন্যটার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে তৈরি হয়েছিল এবং প্রতিটাই সুন্দর বাগান দিয়ে ঘেরা। সমাধির গম্বুজ একসময় নীল ও সবুজ টাইলস-এ সজ্জিত ছিল। কালের প্রকোপে আজ মাত্র কয়েকটি গম্বুজই সেখানে অবশিষ্ট আছে।
কুতুব শাহিদের রাজত্বকালে সমাধিগুলির বেশ মর্যাদা ছিল। তার পরের ইতিহাস ছিল নির্মম। ১৬৮৭ সালে গোলকোণ্ডা ফোর্ট অধিকারের সময় সমাধিগুলি পরিণত হয়েছিল আক্রমণকারী মুঘল সৈন্যের ব্যারাকে, ময়দানে তৈরি হয়েছিল ক্যাম্প। সমাধিস্তম্ভের উপর কামান রেখে দুর্গের দিকে গোলাবর্ষণ করা হতো। উনিশ শতকের প্রথমে সমাধিগুলির এই দুরবস্থার অবসান ঘটান স্যার সালার জাং তাঁর পুনরুদ্ধার কার্যের মাধ্যমে। সমাধিক্ষেত্রের বিস্তৃত বাগান ঘিরে দেন সুউচ্চ প্রাচীরে। এই স্থানে কুতুব শাহি বংশের মোট সাতটি সমাধি আছে– শুধু নেই শেষ সুলতানের সমাধি। হায়দ্রাবাদে এলে এই দ্রষ্টব্যগুলো অবশ্যই দেখবেন। চিরদিন মনে আঁকা থাকবে অনুপম চৌমহল্লা প্যালেস।