• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রাজস্থানের চিতোরগড় ও থর মরুভূমি ভ্রমণ

রাত্রিযাপনের পরের দিন উদয়পুরের সিটি প্যালেসের উদ্দেশে বাসে উঠলাম। রাজা উদয় সিং দ্বিতীয় কর্তৃক ১৫৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিমলকুমার শীট

বৈচিত্রময় ভারতে ভ্রমণপিপাসুরা স্থির থাকতে পারেন না। সময় পেলেই অগ্র পশ্চাৎ না ভেবে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। ভ্রমণে যে কায়িক ক্লেশ হয় তা দৃষ্টি সুখে সব ভুলে যান। এবারের পূজোর ছুটিতে আমরা কয়েকজন এক ভ্রমণ এজেন্সির সঙ্গে ১৩ দিনের জন্য রাজস্থানের উদ্দে​শে বেরিয়ে পড়লাম। খড়গপুরে সাপ্তাহিক কলকাতা–আজমের এক্সপ্রেস ট্রেন ধরলাম। বিকেল আড়াইটে ট্রেনে উঠে দু-দিকের দৃশ্য বন-জঙ্গল, কোথাও বাজরার খেত, কোথাও পশুচারকদের পশু নিয়ে যাতাযাত দেখতে দেখতে চললাম। ট্রেন ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ হয়ে রাজস্থান পৌঁছল।

Advertisement

রাত্রি সাড়ে ১২টায় রাজস্থানের চান্দেরিয়া স্টেশনে পৌঁছলাম। স্টেশনের আদল দেখে রাজস্থানে যে এসে পৌঁছে গেছি, তা বুঝতে পারলাম। অটো করে দেড় কিমি দূরে হোটেলে পৌঁছলাম। আগে থেকেই হোটেল বুক করা ছিল। টিম ম্যানেজার সৌরভ সবাইকে বলে দিলেন, সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সবাই প্রস্তুত থাকতে হবে।

Advertisement

৫-৬ কিমি দূরে ঐতিহাসিক চিতোরগড় দুর্গ দেখার জন্য বেরতে হবে। এ কথা শোনার পর মনকে আর বশে রাখতে পারলাম না। ঘুম তেমন হল না তবুও চিতোরগড়ের স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে স্নান সেরে, প্রাত:রাশ করে দুর্গ জয়ের জন্য প্রস্তুত হলাম। অটো আসতেই আমরা উঠে বসলাম। ধীরে ধীরে অটো দুর্গের কাছাকাছি এল। এখানে অনেক লোক পায়ে হেঁটে, কেউ গাড়িতে করে এসেছে। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার দীর্ঘ সারি। পুলিশের বাড়াবাড়ি নেই। দুর্গের ভিতর পর্যন্ত গাড়ি ঢুকে গেল। চিতোরগড় দুর্গ রাজপুতদের বীরত্ব ও গর্বের মূর্ত প্রতীক। এই চিতোরগড় দুর্গকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করেছে। ২.৮ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে (৬৯১.৯ একর) দুর্গটি বিস্তৃত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম দুর্গ হিসাবে খ্যাত। দুর্গে সাতটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এগুলি হল রাম পোল, লক্ষণ পোল, বলরাম পোল, গণেশ পোল, মাদা পোল প্রভৃতি । আমরা মূল প্রবেশদ্বার সুরজ পোল দিয়ে প্রবেশ করলাম। পুরো দুর্গ কমপ্লেক্স ঘুরতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগল। আমরা একটা গাইড নিলাম। গাইড তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে দুর্গের বর্ণনা দিতে লাগলেন। এখানে ৪টি প্রাসাদ, ১৯টি বড় মন্দির, ২০টি বৃহৎ জলাশয়, ৪টি স্মৃতিস্তম্ভ এবং কয়েকটি বিজয়স্তম্ভ রয়েছে। বানাস নদীর উপনদী বেরচ নদীর তীরে এই দুর্গ অবস্থিত। ১৬ শতকে কামান প্রবর্তনের ফলে দুর্গটি প্ররিত্যক্ত হয়। রাজধানী আরও নিরাপদ স্থানে উদয়পুরে স্থানান্তরিত হয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় হল রানা কুম্ভ ​(১৪৩৩-১৪৬৮)- নির্মিত (১৪৪৮) বিজয় স্তম্ভ, রানি পদ্মিনীর প্রাসাদ, মীরাবাঈ মন্দির। তিনি মালওয়া ও গুজরাতের সম্মিলিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর বিজয় স্মরণে এটি তৈরি করেন। পাশেই জহর স্থলটি গাইড দেখাল। সেখানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক ১টি ফলক লাগানো হয়েছে। লেখা আছে, এই স্থানে তিনবার জহর হয়েছিল। প্রথমবার ১৩০৩ সালে রতন সিংহের রানি পদ্মিনীর নেতৃত্বে হয়। যখন রতন সিং আলাউদ্দিন খিলজির (১২৯৬-১৩১৬) নেতৃত্বে যুদ্ধে পরাজিত হন, তখন তাঁর স্ত্রী পদ্মিনী-সহ এক হাজার মহিলা নিজের দেশমাতৃকা রক্ষা ও সতিত্ব রক্ষার জন্য অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। দ্বিতীয়বার ১৫৩৫ সালে গুজরাতের শাসক বাহদুর শাহ পূর্বের পরাজয়ের বদলা নিতে চিতোরগড় আক্রমণ করলে রানা সঙ্ঘের বিধবা রানি কর্ণাবতীর নেতৃত্বে এক হাজার মহিলা জহর ব্রত করে আত্মাহুতি দেন। তৃতীয় জহর হয় ৩৩ বছর পর আকবরের রাজ্যলিপ্সার কারণে। ১৫৬৮ সালে জয়মাল সিং রাঠোরের যুদ্ধে আহত হবার সংবাদে এবারেও হাজারো বীরাঙ্গনা আত্মাহুতি দেন।

এরপর দুপুর সাড়ে বারোটায় চান্দেরিয়া হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে আমরা রিজার্ভ বাসে উদয়পুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রাচ্যের ভেনিস উদয়পুরের নর্থ স্টার হটেলে উঠলাম। রাত্রিযাপনের পরের দিন উদয়পুরের সিটি প্যালেসের উদ্দেশে বাসে উঠলাম। রাজা উদয় সিং দ্বিতীয় কর্তৃক ১৫৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাস থেকে নেমে প্রথমে ‘সহেলিওঁ কি বারি’ এবং মোমের যাদুঘর, পিচোলা হ্রদের কাছে মনমুগ্ধকর উদয়পুরে ফোক ড্যান্স দেখলাম। তারপর এলাম পিচোলা হ্রদের কাছে যা উদয়পুর শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে খ্যাত। এখানে রয়েছে মন্দির এবং রেস্তোরাঁ। হ্রদে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। সময় সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত। বিকেলে সিটি প্যালেস দেখতে গেলাম যা ৪০০ বছর ধরে নির্মিত, রাজস্থানী এবং মুঘল স্থাপত্য শৈলীর মনোমুগ্ধকর মিশ্রণে এই প্যালেস পিচলা হ্রদের পূর্বে তীরে বরাবর বিস্তৃত। ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্যালেসের বিভিন্ন কক্ষ, তাদের অস্ত্রসস্ত্র, রান্না ঘর, রানির কক্ষ প্রভৃতি। এরপর হোটেলে ফিরে এলাম।

পরের দিন সকালে প্রাত:রাশ সেরে উদয়পুর থেকে বাসে করে মাউন্ট আবু রোড এর উদ্দেশে যাত্রা করলাম। আবু রোডে ব্রহ্মকুমারীদের বড় আশ্রম শান্তিবনে (৫০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত) প্রবেশ করলাম। এই ব্রহ্মকুমারী আশ্রম একটি আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং এই সংস্থার আর্ন্তজাতিক সদর দপ্তর হিসাবে কাজ করে। প্রচার করে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের। রয়েছে দুর্দান্ত ডায়মন্ড হল মাঝে কোনও স্তম্ভ নেই, এখানে এক সঙ্গে ২০ হাজার লোক বসতে পারে। এই আশ্রমে একটি জাদুঘরও রয়েছে তা ঘুরে দেখলাম। সেখানে কিছু সময় কাটালাম। মনটা শান্ত হয়ে এল। ওখান থেকে বেরিয়ে সিরোহি জেলায় মাউন্ট আবুর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে আনা রান্না করা খাবার খেয়ে দিলওয়াড়ার বিখ্যাত জৈন মন্দির পরিদর্শন করলাম। ভিতরে মোবাইল, ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া বারণ। এখানে ৫টি জৈন মন্দির একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। সোলাঙ্কি স্থাপত্যের শৈলীতে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। সূক্ষ খোদাই করা ছাদ, দরজা, স্তম্ভ এবং প্যানেলের ওপর ছড়িয়ে থাকা অলংকরণী বিশেষ উল্লেখ্য। এই সমস্ত মন্দির তৈরির জন্য শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে বলা হয় তাঁরা মার্বেল কাটার পর যে গুঁড়ো পড়ে তার সমান ওজনের সোনা দেওয়া হয়। পাঁচটি মন্দির হল— মল ভাসাহী, যা ১ম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছে ২য় লুনা ভাসাহি যা ২২তম তীর্থঙ্কর নেমিনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ৩য়টি পিওলহর মন্দির যা আদিনাথের নামে উৎসর্গীকৃত, ৪র্থ ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথকে উৎসর্গীকৃত, ৫ম মহাবীর স্বামী মন্দির, শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরকে উৎসর্গীকৃত। এর মধ্যে বিখ্যাত হল বিমল ভাসাহি ও লুনা ভাসাহি মন্দির। দিলওয়াড়ার মন্দিরগুলি শ্বেতাম্বর পঞ্চতীর্থ নামে পরিচিত। ১৩১১ সালে আলাউদ্দিন খিলজি মন্দির আক্রমণের ফলে এর বেশ ক্ষতি হয়। আবু পাহাড়ে কয়েকটি হিন্দু মন্দির রয়েছে। আমারা ৩৬৫টি সিঁড়ি বেয়ে অরর্বুদা দেবীর মন্দিরে গেলাম। মন্দিরের অভ্যন্তরে গেলাম সরু গুহার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে। অরর্বুদা দেবীকে ক্যাতায়নী দেবীর অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গণটি নবরাত্রির সময় ভক্ত সমাগমে আলাদা মাত্রা পায়। কাছেই মাউন্ট আবুতে ব্রহ্মকুমারী ধর্ম-সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক সদর দপ্তর রয়েছে। নীচে নেমে এলাম নাক্কি হ্রদের কাছে। এখানে বোটে ঘোরার ব্যবস্থা রয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম এই হ্রদের বিসর্জন দেওয়া হয়ে ছিল। এর কাছাকাছি রয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীতে মেওয়ার রাজ কুম্ভ কর্তৃক নির্মিত অচলাগড় দুর্গ। মাউন্ট আবু রাজস্থানের আরাবল্লি পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত, বনভূমিতে ঘেরা একটি ছোট শহর। অচলেশ্বর মহাদেব মন্দির রয়েছে।
ফিরে সন্ধ্যায় আবু রোডে হোটেলে থাকলাম। পরের দিন স্বর্ণনগরী হিসাবে পরিচিত জয়সালমেরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। এটি থর মরুভূমির প্রবেশদ্বারও বটে। ৪০৭ কিমি পথ অতিক্রম করে জয়সালমেরের ওয়েসিস হোটেলে পৌঁছলাম সন্ধ্যার সময়। হাত মুখ ধুয়ে ৪ তলায় যাওয়ার পর যা দেখলাম তাতে মন খুশ হয়ে গেল। দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা বিখ্যাত ‘সোনার কেল্লা’। রাতের আলোতে ঝলমল করে উঠেছে। সকালে প্রাতরাশ সেরে বাসে পৌঁছে গেলাম ১৪ শতকে নির্মিত কৃত্রিম গদিসার হ্রদে, কাছেই রয়েছে সোনার কেল্লা (জ্যসালমের ফোর্ট)। কেল্লার ভেতরে জৈন মন্দির খুব সুন্দর। অনেক দোকান দানি রয়েছে। মিউজিয়াম দেখার পর রয়েছে, পাটেওলা হাভেলি সহ ৫টি হাভেলি দেখে হোটেলে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বাসে করে পৌঁছে গেলাম থর মরুভূমির জাহাজে চড়ার জন্য। উটে চড়ার আগে জীপ সাফারি সেরে নিলাম। চারদিকে বালি আর বালি আর উট ও উটের গাড়ির সমাহার । উটে চড়ে মরুভূমির উপর চললাম। সে এক নতুন অনুভূতি। ভিউ পয়েন্টে নেমে সূর্যাস্তের অপেক্ষা করলাম। কিছুক্ষণ পর সূর্য অস্ত গেল। বালিয়াড়িতে এখন আকন্দ গাছ আর যোযোবা নামে কাঁটা গাছের আধিক্য। উট সাফারি যেখানে হয় সেখানে রাত্রে থাকার জন্য ক্যাম্প রয়েছে। স্থানীয় রাজস্থানী ফোক ড্যান্স হয় বুকিং করেছিলাম তাই সন্ধ্যা ৭টার পর গেলাম আমাদেরকে বাদ্য বাজিয়ে ফোঁটা দিয়ে বরণ করে নিল। ভিতরে গিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে ড্যান্স দেখলাম। তারা চা ও পকোড়া পরিবেশন করল। রাত্রি ৯টায় ফিরে এলাম। এই কয়েক ঘণ্টায় থর মরুভূমির উপর মায়া পড়ে গিয়েছিল।

Advertisement