• facebook
  • twitter
Wednesday, 15 January, 2025

ঝাউবন মিহিবালি আর বকখালি

একেবারে নির্জন সোনালি সি-বিচ। পোশাকি নাম কিরণ সৈকত। লাল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক পাখিদের একচ্ছত্র আধিপত্য এই সৈকতে। যতদূর চোখ যায় জল আর জল। ঢেউ-এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে শান্ত সাগরবেলায়। ভিজে বালির আকুলতা, সঙ্গে লাল কাঁকড়ার ক্ষিপ্রতা। সময় যে কখন পেরিয়ে যাবে বুঝতে পারবেন না। বকখালি বেড়িয়ে এলেন মানস মুখোপাধ্যায়।

শান্ত নীল সাগর পাড়। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মুগ্ধতা। লাল কাঁকড়া, ঝাউবন, নির্জনতা, ম্যানগ্রোভ অরন্য- সব মিলিয়ে সুন্দরবনের সুন্দর গন্ধমাখা বকখালি অনবদ্য। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় সমুদ্র সৈকত। দিঘার মতো খুব বেশি হোটেল-রিসর্টের আতিশয্য এখানে এখনও নেই। পুরীর মতো উত্তাল নয়, পণ্ডিচেরির মতো পাথুরে নয়। চাঁদিপুরের মতো জোয়ারে ডুবে, ভাটায় ত্রিসীমানার বাইরে পালিয়ে যাওয়া নয়। জোয়ার-ভাটা খেলা এক শান্ত সাগর। সঙ্গে প্রশস্ত নিরিবিলি রুপোলি সৈকত। যেখানে হকারের উৎপাত ছাড়া বসে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা- ঝাউবনের দিকে অথবা জলের দিকে তাকিয়ে। ভিড় নেই কিন্তু জনমুখরতা আছে। মেলে হাতেগোনা দোকানপাট কিন্তু নেহাতই সাদামাটা।

কলকাতা থেকে খুব সকালে যাত্রা করলেও, পৌছতে পৌঁছতে ভরদুপুর। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের পর্ব মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। প্রোগ্রামটা যদি ১ রাত্রি ২ দিন হয়, প্রথম দিনেই আপনাকে সাইট সিয়িংটা সেরে নিতে হবে। একটা টোটো বুক করুন। আর সঙ্গে গাড়ি থাকলে তো কথায় নেই। এবার ইচ্ছে খুশির ডানা মেলা।

প্রথমে হেনরি আইল্যান্ড। দূরত্ব মাত্র ৩ কিমি। কলকাতামুখী রাস্তায় প্রথমে ছুটে যাবে গাড়ি। একটু পরেই ডানহাতি শাখা রাস্তায় ঢুকে পড়ে। শুরু হয় গ্রাম্য পথ। দু’দিকে প্রচুর পানের বরজ, নারকেল গাছ আর ভেড়িকে পাশ কাটিয়ে পৌঁছবেন গন্তব্যে। জন হেনরির নামে এই দ্বীপভূমি। অসংখ্য মাছের ভেড়ি পরিবেষ্টিত এই অঞ্চল। প্রথম দর্শনেই জায়গাটা একেবারে মন ছুঁয়ে যাবে। এখানে থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের একটি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স রয়েছে। সুন্দরী, বাইন, হেতাল প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ গাছের প্ল্যান্টেশন করছে মৎস্য বিভাগ। এর সঙ্গে চিংড়ি, লবস্টার, পার্শে, তেলাপিয়া, ভেটকি, ট্যাংরা- এমন হাজারো মাছের চাষ হচ্ছে স্টেট ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ৬২টি মাছের ভেড়িতে। এখানকার ওয়াচটাওয়ারে উঠে চোখে পড়বে শুধু খাল, বিল,খাঁড়ি আর অগভীর অরণ্য। দূরে বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত বেলাভূমি।

ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে খানিকটা সামনের দিকে এগোলে, ম্যানগ্রোভ অরন্যের বুক চিরে সরু রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। মাঝে কাঠের তৈরি ছোট্ট সেতুটি এই পথের অ্যাডভেঞ্চার বাড়িয়েছে। বিশেষত দু’দিকে শ্বাসমূল তোলা স্যাঁত-সেঁতে পরিবেশটা। কিছুটা এগোতেই খোলামেলা ফাঁকা জমি। স্থানে স্থানে জোয়ারের জল জমে একটা আঁশটে গন্ধ। আপনি যত এগোবেন, সমুদ্রের গর্জন তত জোরালো হবে। সামনে বাবলা ও ঝাউবনের জমাটি সংসার। দু’পাশের গাছ এসে একসঙ্গে মিশে সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তাটিকে একদম গুহার মতো রূপ দিয়েছে। ঝাউয়ের অবগুণ্ঠন সরিয়ে এবার সামনে দেখুন, একেবারে নির্জন সোনালি সি-বিচ। পোশাকি নাম কিরণ সৈকত। লাল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক পাখিদের একচ্ছত্র আধিপত্য এই সৈকতে। যতদূর চোখ যায় জল আর জল। ঢেউ-এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে শান্ত সাগরবেলায়। ভিজে বালির আকুলতা, সঙ্গে লাল কাঁকড়ার ক্ষিপ্রতা- সময় যে কখন পেরিয়ে যাবে বুঝতে পারবেন না।

হেনরি আইল্যান্ডের মোহময় পরিবেশ কাটিয়ে এবার পৌঁছে যান মৎস্য বন্দর ফ্রেজারগঞ্জে। বিচে ঢুকতেই স্বাগত জানাবে বড় বড় হাওয়াকল। নাকে আসবে শুঁটকি মাছের গন্ধ। বাংলার ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের নামে ফ্লেজারগঞ্জ। এখানকার তটভূমি খুবই সাধারণ। ভাটার সময় জল সরে গেলে অনেকটা দূর পর্যন্ত কর্দমাক্ত পরিবেশ। বিচ লাগোয়া পরিত্যক্ত দুটি ভাঙা বাড়ি দেখে সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপফুটে ওঠে। ভিজে বালিতে জলের দাগের নকশা। ইতস্তত নৌকা দাঁড়ানো। ঝাউ-ক্যাসুরিনার বন এখানে অনেক পাতলা। রয়েছে বেনফিশের আবাস সাগরকন্যা।

তবে বন্দর অঞ্চলের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অতি চমৎকার! সমুদ্রের খাঁড়ি ঢুকে এসেছে কিছুটা ভিতরে। অন্য দিকটাতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সেই গাছগুলোর গোড়া দেখা যাচ্ছে না। জলের নীচে ডুবে রয়েছে। ঘোলাজল তাদের নুয়ে পড়া ডালপালা ছুঁয়েছে। জেটির ধারে পরপর নৌকা বাঁধা। নদী বা গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে ঢেলে দিচ্ছে জেটির ওপরে। প্রচুর বরফ সহযোগে সেই মাছ বাক্সবন্দি হয়ে চলে যাচ্ছে নানাদিকে। এখানকার অনেক নৌকাতেই জেলেদের পুরোদস্তুর সংসার। মাছ ধরার সময় মাঝ দরিয়ায় নৌকোটাই ওদের ঘরবাড়ি। রান্নার সরঞ্জাম থেকে বিশ্রামের জায়গা সবই এখানে মজুত। কাছেই আছে কার্গিল বিচ। এখান থেকে খুব ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায় বলে,অনেকে একে সানসেট পয়েন্টও বলে। জায়গাটা সুসনি আইল্যান্ড নামেও পরিচিত। এখানকার জেলে গ্রামগুলোর যাপনচিত্র দেখতে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে হবে বিচ সমান্তরাল পথ ধরে। ঢলে পড়া সূর্যকে সাক্ষী রেখে এবার বকখালি ফেরা।

হোটেলে না ঢুকে সোজা সি-বিচে চলে যান। দেখবেন মোহময় গোধূলিতে সমুদ্রের জল লাল হয়ে গেছে। পিছনে এক সরলরেখায় সারিবদ্ধ সবুজ ঝাউয়ের দল নীল আকাশের দিকে যেন নিরাসক্তভাবে চেয়ে আছে। ফিরে আসছে জেলে নৌকারা। নাম না জানা ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ভর করে, দিনের আলোটুকু তখন আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। রাত বাড়তেই ঝাউবনের শনশন শব্দ আর দূরের সমুদ্র মনটা উদাস করে দেবে। একটু একটু করে জলস্রোত এগিয়ে আসছে। তার মানে জোয়ার আসছে। এখানে জোয়ার-ভাটার প্রেক্ষিতে সৈকতের ভূগোলই যায় বদলে। হঠাৎ মনে হতে পারে আপনি কোনও ব্লু লেগুনের দেশে পাড়ি দিয়েছেন। ভাজা মাছের গন্ধে পর্যটকরা ভিড় করেছে, বিচ লাগোয়া মাছের গুমটিতে। তবে সামুদ্রিক খাবারে অ্যালার্জি থাকলে, এইসব মাছভাজা না খাওয়াই শ্রেয়। রাতের স্বপ্নেও হয়তো আছড়ে পড়বে বকখালি সৈকতের উতলানো ঢেউ। এই কর্মব্যস্ত পৃথিবীতে যে এত শান্তি, এত সুখ লুকিয়ে আছে, তা হয়তো এতদিন উপলব্ধিই করেননি।
পরদিন সূর্যোদয় দেখতে হলে একটু তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়তে হবে। সৈকতে হাতে গোনা দু’একজন পর্যটক। বিচ লাগোয়া দোকানপাট সেভাবে খোলেনি। জেলেরা তার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে। আড়মোড়া ভেঙে সূর্যদেব ধীরে ধীরে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারলেন। ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে দিগন্তে জন্ম নিল অবিশ্বাস্য সব ছবি। এবার লোনা হাওয়ার ঝাপটা সামলে বিচ ট্রেকিং-এ বেরিয়ে পড়ুন। যেদিকে খুশি যান। তবে সৈকতের মিহি বালুকণা হাঁটাচলায় ব্যাঘাত ঘটাবে। এখানের বালিয়াড়িতেও ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র লাল কাঁকড়া। আর পায়ের আওয়াজ পেলেই ঢুকে পড়ছে গর্তে। দেখবেন বকখালিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার কাজ চলছে। ঝাউবনের কোলে সৈকত। ঘন ঝাউবনের সবুজ ছায়া ও ফাঁকফোকর দিয়ে আসা আলোর আলপনা আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্রকৃতি প্রেমে বিভোর হয়ে রোমান্টিকতার স্বাদ উপভোগ করে হয়তো গুনগুনিয়ে উঠবে হৃদয়। বাঁদিকের ঘন ঝাউবনের মধ্য দিয়ে বেশ কিছুটা যেতেই চোখে পড়বে একটি মন্দির। চারদিকে বট, নিম, বিষবাবলা, বেহেড়া আর ঝাউগাছের জঙ্গলের মাঝে এক অদ্ভূত শান্ত ও নিস্তব্ধ পরিবেশ। সঙ্গে রোদ-ছায়ার অপূর্ব কোলাজ। টিনের ছাউনি দেওয়া মন্দিরে রয়েছে বনবিধি, বিশালক্ষী ও গঙ্গামাতার মূর্তি। মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে আছে নানান লোকগাথা। মন্দির প্রাঙ্গনে এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ। অরণ্যের মধ্যে এই মন্দিরের অবস্থান ও পরিবেশ আপনাকে সাগর সঙ্গমে নবকুমারের কথা মনে করিয়ে দেবে। আরও কিছুটা দূরেই ছবির মতো সাজানো অমরাবতী গ্রাম।

ব্রেকফাস্টের পর বাস স্ট্যান্ডের কাছে দেখে নিতে পারেন বনবিতান। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এক সংরক্ষিত মুক্তক্ষেত্র। টিকিট কেটে ভিতরে চলে যান। ঢুকতেই বাঁদিকে পড়বে ম্যানগ্রোভ নার্সারি। ডানদিকে পাশাপাশি একাধিক জলাশয়ে গোটা ছয়েক কুমির নিয়ে গড়ে উঠেছে কুমির প্রকল্প। আছে অনেকটা ঘেরা জায়গায় কিছু হরিণও। এবার লাঞ্চের পর্ব মিটিয়ে কলকাতা ফেরা। যদি ওই দিনটাও বরাদ্দ রাখেন, তাহলে ফ্রেজারগঞ্জের ফিশিং হারবার থেকে জলপথে ঘুরে আসতে পারেন জম্বুদ্বীপ। নিজের জায়গায় ফিরে এসেও, বারে বারে হাতছানি দেবে বকখালি। আসলে কিছু বেড়ানোর গন্ধ গায়ে লেগে থাকে সারাজীবন।