দেবাশিস ভট্টাচার্য
অরুণাচলপ্রদেশে মেচুকা (Menchuka), ভারত-চীন সীমান্তবর্তী দুর্গম ভয়ংকর সুন্দর এক অফ্বিট জায়গা। যাঁরা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন তাঁদের কাছে গত দু-তিন বছর আগেও এটি খুব একটা পরিচিত নাম ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, অরুণাচল প্রদেশের কিছু জায়গা যেমন মেচুকা, আনিনি ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। আগে তো অরুণাচল প্রদেশ বেড়াতে যাওয়া মানেই আমরা জানতাম— তাওয়াওং, বোমডিলা, ভালুকপং। কিন্তু এখন আরও সমস্ত নতুন নতুন দিক দুর্গম জায়গা টুরিস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে এই মেচুকা ও আনিনি। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য, ঘন সবুজ ভ্যালি, চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা, পাহাড়ের মাথা বরফে ঢাকা। অরুণাচল প্রদেশের গালো ও আদি সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বাস করেন। খুবই দুর্গম রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছতে হয়। প্রথমে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল আনিনি, ডিব্রুগড় থেকে রোয়িং হয়ে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় ধস নামায় রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যায়, আমাদের ফিরে আসতে হল পাসিঘাটে। সেখানে এক রাত কাটিয়ে আমরা পরের দিন যাত্রা শুরু করলাম ইয়ং কিম-এর দিকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আবার সেই রাস্তায় ধস। ফিরে আসতে হল বোলিং বলে একটি জায়গায়। সেখানে সরকারি টুরিস্ট লজে রাত কাটিয়ে আলো নামে একটি জায়গায় এলাম। আলো বেশ বড় জায়গা ও ভারী সুন্দর। ওখান থেকে পরের দিন মেচুকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ভয়ংকর রাস্তার অবস্থা, অসতর্ক হলেই যে কোনো মুহূর্তে যা কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। ১৮৬ কিমি পাহাড়ের রাস্তা। চারিদিকে ধস নামার নিদর্শন, রাস্তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে বিপদের সম্ভাবনা। মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি। কিন্তু আমাদের গাড়ির চালক ঝন্টু গগৈ অত্যন্ত সজাগ ও বিচক্ষণ। যাবার সময় বেশ কিছু গ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম, যার মধ্যে কয়েকটি গ্রাম বেশ উল্লেখযোগ্য। আমি তিনটে গ্রামের কথা বলবো— এক, পাঞ্জিম, দুই, তারকা, তিন, দ্বারকা।
অরুণাচল প্রদেশে শি ইয়াং জেলায় এই গ্রামগুলি, ভারী সুন্দর, পাশিঘাট থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে এই গ্রামগুলো। আদি জনজাতির বাস এই গ্রামে। এখানে সিওম নদী, শিয়াং নদীর সঙ্গে মিশেছে। নদীর উপর বাঁশের সেতু নড়ছে মচমচ আওয়াজ করছে, এই বুঝি ভেঙে পড়ে। নিচে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে সিয়াম নদী। আর পাঁচটা গ্রামবাংলার গ্রামের মতোই এই গ্রামগুলো। তবে খুব নিরিবিলি, চুপচাপ, সকলে নিজের মতো কাজ করে চলেছে। আমরা গ্রামের ভিতর গিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলাম। খুব বেশি হলে শ’খানেক বাড়ি। পাঞ্জিম গ্রামের গ্রামপ্রধান তারিখ পানগ্রাম বললেন, তাঁদের গ্রাম ‘মডেল ভিলেজ’ হতে চলেছে। সেই কারণেই উৎসব হবে, আর তার প্রস্তুতি চলছে। তাঁরা নিজেদের গ্রামকে খুবই ভালোবাসেন। গ্রামপ্রধান তাঁর বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন, তাঁদের ট্রাডিশনাল ড্রেস পরালেন। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও ওঁদের আন্তরিকতায় তা পরতেই হল। না বলতে পারলাম না। প্রায় সব বাড়িগুলো একইরকম দেখতে, বাঁশ ও কাঠের তৈরি। প্রতিটা বাড়িতে বারান্দা আছে, ফুল গাছ রয়েছে। সাধারণত তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে। মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে, কাঠের উপর, সম্ভবত বৃষ্টির জল বা বন্যপ্রাণী যাতে ঢুকতে না পারে, তাই একটু উঁচুতে তৈরি হয়েছে। বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, খুবই সহজ-সরল জীবন যাপন, গ্রামের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে যাচ্ছে। সেখানে পড়াশুনো করে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। স্থানীয় স্কুল, কলেজ, ডাক্তারখানা রয়েছে। প্রত্যেকে নারী- পুরুষ নির্বিশেষে তাঁরা তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন। ‘গালো’ সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি, ডনি পোলো ধর্মে বিশ্বাসী। ডনি মানে সূর্য, পোলো মানে চন্দ্র। এখানে সূর্য হলেন ‘মা’, আর চন্দ্র হচ্ছেন ‘পিতা’। চেষ্টা করেছি তাঁদের সঙ্গে কথা বলার। এঁরা প্রকৃতিকে পুজো করেন, এঁদের মধ্যে কোনো বাধা-নিষেধ নেই, না খাওয়া নিয়ে, না জামা-কাপড় পরা নিয়ে। ধর্ম নিয়ে এঁদের কোন ভেদাভেদ নেই। সব ধর্মকেই এঁরা সমানভাবে সম্মান করেন। মিথুন বলে এক প্রাণী, যা গরুও নয় আবার মোষও নয়, তাকে এঁরা খুবই ভক্তি করেন। এঁদের কাছে মিথুন খুবই প্রিয় প্রাণী, যাকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়, কিন্তু বাড়িতে পোষা হয় না। মিথুন রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। আমরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্রচুর দেখেছি। এঁরা বিয়ের সময় ছেলেদের পক্ষ থেকে মেয়েদের বাড়িতে দুটো করে মিথুন দেন। যেতে যেতে চারিদিকে ঘন সবুজ জঙ্গলে ভরা অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। রাস্তায় অজস্র ঝরনা, একদম পাহাড়ের মাথা থেকে ঝরে পড়ছে। বেশ কিছু ঝরনার মধ্য দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়েছিল। বৃষ্টির জন্য রাস্তার ওপর পাহাড় থেকে প্রবল বেগে জল নামছিল, দেখে ভয় লাগছিল, কিন্তু আমাদের ড্রাইভার যথেষ্ট এক্সপার্ট। তার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলল। ঘন সবুজ জঙ্গলের পাহাড়গুলো আমাদের সঙ্গী হয়েছিল এই দীর্ঘ যাত্রাপথে। যদিও রাস্তায় চার-পাঁচবার দাঁড়াতে হয়েছেই। প্রায় ১২ ঘন্টার পথ পেরিয়ে সন্ধের সময় মেচুকা পৌঁছলাম। ওখানে পৌঁছনোর পর সারাদিনের ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা, কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
শিয়ম নদীর ধারে, অরুণাচল প্রদেশের শিয়মি জেলা। তারই অন্তর্গত এই মেচুকা জনপদ। এত ভালো ল্যান্ডস্কেপ, সবুজ ভ্যালি— চোখ জুড়িয়ে যায়। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। ৪৭ কিলোমিটার উত্তরে, লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, ভারত-চিন বর্ডার। ধীরে ধীরে এই জায়গাটা পপুলার হয়েছে টুরিস্টদের জন্য। কিছু হোম-স্টে রয়েছে। যদিও হোম-স্টে বললেও সব রকমেরই ব্যবস্থা আছে। এখনো হোটেল কালচার শুরু হয়নি। লোকসংখ্যা খুবই কম। একটা বাজার আছে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। দুর্গম জায়গা হলেও মোটামুটি সব রকম জিনিসপত্রই পাওয়া যায়। জনমানবহীন রাস্তায় ঘুরলে মনেই হয় না নিজের দেশে রয়েছি। পাশে বয়ে চলেছে শিয়াম নদী। রয়েছে ৪০০ বছরের পুরনো স্যামটেন ইয়ংচা মনেস্ট্রি। একটা এয়ার স্ট্রিপ রয়েছে, আর্মিদের ইউনিট রয়েছে, কাছেই চিন বর্ডার বলে।
আমরা তিনদিন ছিলাম ‘ইয়ারগিয়াপ চু’ হোমস্টেতে। হোমস্টের মালিক লাকপা সোনা ও তাঁর স্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন আমাদের সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার যাতে কোনোরকমের অসুবিধা না হয়। খাওয়া-দাওয়া ছিল যথেষ্ট ভালো। যেহেতু রাত্রের তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছিল ৮-৯ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে, সন্ধেতে ‘বুখারী’ (আগুন) জ্বালিয়ে ঘর গরম করে রাখার সমস্ত রকম ব্যবস্থা ছিল। হোমস্টের পাশেই নিজেরাই বিভিন্ন শাকসবজি চাষবাস করেন। বেশিরভাগ সময় খাবারের পাতে ডিম ও চিকেন। পর্কও ছিল, আবার ছিল শুঁটকি মাছও। আগে জেনারেটর ছিল এখন ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে। ফোনের নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল, এয়ারটেল বা বিএসএনএল। কখনো কখনো আসা-যাওয়া করে। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের কোনও প্রশ্নই নেই। ওখানকার মানুষের সেসব প্রয়োজনও পড়ে না। বলা যেতে পারে, দেশের অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মেচুকা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে লামাং সীমান্ত। সেখানে আমরা একদিন ঘুরে এলাম। ২০২২ সালে চিনা সৈনিকরা আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, যেখানে ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। দেশের একদম উত্তর-পূর্ব ভারত-চিন সীমান্ত অরুণাচল প্রদেশের লামাং। রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হয়েছে, এখানে যাওয়ার জন্য আলাদা করে পারমিট নিতে হয়েছিল। রাস্তার মধ্যে এক শিখ রেজিমেন্টের গুরুদোয়ারা সেখানে আমরা দুপুরবেলায় ফ্রিতে খাবার পেলাম। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই গুরুদোয়ারা। পাশেই একটা নদী প্রবল বেগে বয়ে চলেছে। পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে হনুমানের মুখ, বিশাল হনুমানের মন্দির। ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ বা আইটিবিপি-র বেশ কয়েকটা চেকপোস্ট পেরিয়ে আমরা গেলাম। বিশাল বড় বড় গাছে ঘেরা এই আর্মি ক্যাম্পগুলো। হেলিপ্যাড আছে, মেচুকাতে অ্যাডভান্স ল্যান্ডিংয়ের জন্য এয়ার স্ট্রিপ রয়েছে। যেখানে এয়ারফোর্সের ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট ওঠানামা করে। আর্মি ক্যাম্পের চারিদিকে প্রচুর বাংকার তৈরি করা রয়েছে। গিয়ে দেখলাম একটা ক্র্যাশ হেলিকপ্টার পড়ে রয়েছে। সামনেই বিশাল পাহাড়ের ওপারেই চিন। পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ভারত-চিন দুই দেশের সৈনিকেরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তাঁরা তৈরি। তবে এটা ঠিক যে কী কষ্টে যে এঁরা রয়েছেন! কী নির্জন নির্বান্ধব জায়গা! কী হার্ড লাইফ! আমরা কল্পনাও করতে পারব না! শীতকালে সম্পূর্ণ বরফে ঢেকে যায়। মেচুকায় তিনটে দিন মন-প্রাণ খুলে প্রকৃতিকে উপভোগ করে ফিরে এলাম। যতই দুর্গম হোক, যদি বেড়াতে ভালবাসেন ক’টা দিন মনের শান্তিতে কাটানোর জন্য এখানে যেতেই হবে। ভারতের বৈচিত্রে ভরা এক অনন্য দিক দেখা হবে।
ডিব্রুগড় থেকে ডিব্রুগড় পুরোটাই গাড়িতে যাতায়াত করতে হয়েছিল। সব ধরনের গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো ব্যবস্থা নেই।
রয়্যাল নিড ট্র্যাভেল এজেন্সি, জান্টু গগৈ, ফোন: ৮৮১১৮৬০২৮৮। এরাই আমাদের বিভিন্ন জায়গায় হোটেল, হোমস্টেতে থাকার ও গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
গুগল বা ফেসবুকে সার্চ করলে অনেক ট্র্যাভেল এজেন্সি পাওয়া যাবে, এখন অনেক ট্র্যাভেল এজেন্ট ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। তবে একটু দেখে শুনে খোঁজখবর নিয়ে বুক করাই ভালো। আমরা রয়্যাল নিড ট্র্যাভেলের সঙ্গে গিয়েছিলাম, এটি জান্টু গগৈয়ের নিজের সংস্থা, নিজের গাড়ি, নিজেই গাড়ি চালান। আমাদের খুবই হেল্প করেছেন এবং খুবই ভালোভাবে ঘুরিয়েছেন এবং খুবই যুক্তিসঙ্গত দরে।
ছবি— লেখক