জনতার দরবারে

Written by SNS April 20, 2024 1:06 pm

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

বিবেক আমাকে কিছু প্রশ্ন করে চলেছে৷ তার কিছু আমি আগের এক প্রবন্ধে আপনাদের দরবারে পেশ করেছি৷ আপনাদের দরবারে আমি যদি ভাঁড় প্রতিপন্ন হই, তাহলেও আমি আমার প্রশ্নগুলো আপনাদের করব৷ চিন্তা নেই, সম্ভাব্য উত্তর আমি দিয়ে দেব পাঠসহায়িকার মতো৷ বাজারে তো পাঠ্যবইয়ের থেকে সহায়িকার চাহিদা শতগুণ বেশি৷

প্রশ্ন : অবসরপ্রাপ্ত জীবনে খবরের কাগজ প্রধান সহায় সময় অতিবাহিত করার জন্য৷ মুদ্রিত দুটো কাগজ মুখস্থ হয়ে গেলে ইন্টারনেটে অন্য কাগজ খুঁজে বেড়াই৷ তাই আপনাদের দরবারে প্রবেশ করার টিকিট পেয়ে যাই৷ এক খবরে জানতে পারলাম যে ২০২২ সালে করা এক দ্রুত সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের ১৮ শতাংশ মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না— প্রায় ২০ কোটি৷ এরা কি বিজেপিকে ভোট দেন?
উত্তর : এরা আদৌ ভোট দেন কিনা তা কে বলবে? ঈশ্বর বিশ্বাস না করলে কি হিন্দুত্বে বিশ্বাস না করা বোঝায়?

প্রশ্ন : বুঝলাম কঠিন প্রশ্ন৷ কিন্ত্ত, এরা ভোট দিলে দেশের নির্বাচনে বিশাল প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে৷ এদের কথা শাসক দল মনে হয় ভাবেন না৷ আর এদের মধ্যে কিছু দেশদ্রোহীকে খুঁজে বার করেন ভয় দেখানোর জন্য৷ আপনারা কি বলেন?
উত্তর : মনে হয় ঠিক বলেছেন৷ আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেই তো হিন্দুত্বকে মানবেন এমনও তো নয়৷ তাই লড়াইয়ের ময়দানটা একেবারে খোলা নয়৷ দশ বছর ক্ষমতার থাকার পরে শাসক দলের এই বিষয়ে বিচক্ষণতা দেখানো জরুরি গদি বজায় রাখার জন্য৷

প্রশ্ন : আগের দিন সর্বদিক থেকে এক ‘পবিত্র’ ভাবমূর্তির মানুষ প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ এসেছিল৷ সিপিএম ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেই তিনি মনে হয় সেই দলে যোগ দিতেন৷ আর কংগ্রেস যদি পরিবারতন্ত্রদুষ্ট না হত তাহলে সেই দলেও যোগ দিতেন৷ সব শেষে নিজের ঈশ্বর বিশ্বাস তাঁকে বিজেপিতে যোগ দিতে প্ররোচিত করল৷ আপনারা কী বলেন?
উত্তর : আগের দিনই উত্তর দিয়েছিলেন, ওঁর কথা না বলাই ভালো৷ প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র ওঁর থেকে রাজনীতি বেশি বোঝে৷ উনি মনে করছেন দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ হবেন৷ মোদির ভূমিকা তখন অপ্রধান হয়ে পড়বে৷ উনি একটু বিশ্রাম পাবেন৷ এমন ব্যক্তি ইদানিংকালে বিজেপিতে যোগ দেননি৷ তাই তাঁর দিকে সংবাদ মাধ্যমের রাডার তাক করে আছে৷

প্রশ্ন : অভিজিৎবাবুর প্রবেশের ঠিক পরেই শোনা গেল এক আপাতভাবে স্বচ্ছমূর্তির অধিকারী অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ আর নির্বাচনে লড়বেন না, অর্থাৎ তাঁর অন্তর্ধান অবশ্যম্ভাবী৷ এটা
কেন হল?
উত্তর : এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর নির্মলার স্বামী পরকলা প্রভাকর দিয়েছেন একই দিনে৷ তিনি বলেছেন যে, নির্বাচনী বন্ড শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি৷ নির্বাচনী বন্ডে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে৷ আর এর অর্ধেক অর্থ পেয়েছে বিজেপি৷ প্রায় ৯৪% বন্ডের নূ্যনতম মূল্য ১ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ কারা নির্বাচনী বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন তা স্পষ্ট৷ কিন্ত্ত আমাদের জানা আছে যে দিল্লির এক সংস্থা এক সমীক্ষা করে বলেছিলেন যে ভারতের নির্বাচনে ৫০,০০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়৷ সেটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি আম্বানি-আদানিদের নাম বন্ড বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেই৷ কোম্পানি আইন অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ সামাজিক খাতে কোম্পানিগুলিকে ব্যয় করার কথা তা ঘুরপথে রাজনৈতিক দলের ভাণ্ডারে আসে কি না কে জানে?

প্রশ্ন : তার তো কোনও দরকার নেই৷ কারণ কেন্দ্রীয় সরকার কোম্পানি আইনের সংশোধন করে রাজনৈতিক দলকে সীমাহীন অর্থ প্রদান করার অধিকার দিয়েছে৷ আচ্ছা, আমি জানতে চেয়েছিলাম নির্মলা কেন নির্বাচনে লড়বেন না?
উত্তর : আমরা সেই দিকেই যাব৷ একটু ধৈর্য ধরুন৷ নির্মলার স্বামী একজন অর্থনীতিবিদ৷ বুক ফুলিয়ে অর্থমন্ত্রী স্ত্রীর পরিস্থিতি খারাপ করার উদ্দেশ্য তাঁর নয়৷ তাঁর অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা নিশ্চয় তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে অচিরে সামান্য এক বুদবুদসম এই কেলেঙ্কারি এক বিরাট আকার নেবে৷ তাই বিচক্ষণ স্ত্রী সরে দাঁড়াচ্ছেন৷ অতীতে এক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় (যিনি কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির একজন পুরোধা ছিলেন) দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাজনীতির ময়দান কলুষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নির্বাচনই লড়েননি৷ নির্বাচনের পথে এগোলে তিনি অবশ্যই মন্ত্রী হতে পারতেন৷ তিনি বহুদিন সমাজসেবা করে গেছেন৷ নির্মলা কি জানেন না তাঁকে দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্য থেকে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজনীয় অর্থের কি সত্যিই অভাব হত? তিনি নিশ্চয়ই তাঁর দলের নৈতিকতায় আর বিশ্বাস করতে চাইছেন না৷ তাই অর্থাভাবের ঠুনকো কারণ দেখিয়ে তিনি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে সরে দাঁড়াতে চান৷ তাছাড়া নির্বাচনী আর্থিক কেলেঙ্কারির ছোঁয়াচ তিনি কী করে ভবিষ্যতে এড়াবেন? তাঁকেই হয়ত বলির পাঁঠা করা হবে৷

প্রশ্ন : খুব ভালো উত্তর দিয়েছেন৷ আচ্ছা বলুন তো, দু’-দুবার সময় পেয়েও স্টেট ব্যাঙ্ক কেন পুরো তথ্য সুপ্রিম কোর্টে পেশ করতে পারল না? আর কোর্টের মোক্ষম গুঁতো খেয়ে ব্যাঙ্ক ২১ মার্চ কোর্টের কাছে সব তথ্য পেশ করেছে৷ নির্বাচন কমিশনও সেই তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে৷ এখন কী হতে পারে মনে হয়?
উত্তর : ব্যাঙ্কের প্রদত্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়৷ এখন সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নির্বাচনের আগে প্রতিটি দল তাদের পক্ষ থেকে তথ্য প্রকাশ না করলে ধরে নিতে হবে তাঁরা স্বচ্ছ নন৷ এছাড়া আর কী করা যেতে পারে? কিন্ত্ত এই সব প্রকাশিত তথ্য থেকে নিশ্চয়ই কিছু মণিমানিক্য বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতে কোনও একদিন, তা অর্থনীতিবিদ পরকলা প্রভাকর বুঝেছেন৷

প্রশ্ন : সংবাদপত্রে নিশ্চয়ই দেখেছেন আমেরিকাতে ডেমোক্রাট প্রার্থী জো বাইডেনের পাশে বসে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং বিল ক্লিন্টন প্রার্থীর হয়ে জনতার কাছ থেকে অর্থ তুলছেন৷ এর চেয়ে স্বচ্ছ আর কী হতে পারে? ভারতে এই জিনিসটা হতে কি বাধা আছে?
উত্তর : আমেরিকায় মূলত দ্বিদলীয় গণতন্ত্র৷ আর ভারতে হাজারটা দল৷ তাই যে দলের সময় ভালো বা যে দল তার অঞ্চলে প্রভাবশালী তার পক্ষেই অর্থের বিনিয়োগ করা হয়৷ পাল্লার ভার বুঝে অর্থের অভিমুখ বদলে যায়৷ আর ভারতের কোম্পানিগুলির আর্থিক হিসাব সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নয়৷ যে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল তা ২০১৭ সাল থেকে আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে ছিল৷ ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ক্রয় করা নির্বাচনী বন্ডের বিবরণ নির্বাচন কমিশনকে সিল করা খামে জমা দিতে এবং তা নির্বাচন কমিশনকে প্রকাশ করতে বলেন৷ এতদিন তা পালন করা হয়নি৷ মোদির বুকের পাটা নেই বাইডেনের মতো সংবাদমাধ্যমের সামনে বসে দলের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করেন৷

প্রশ্ন : আপনাদের কি মনে হয়? নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যে সব তথ্য জনসমক্ষে এল তার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে?
উত্তর : তার আগে জানতে হবে নির্বাচন কমিশন কতটা কার্যক্ষম৷ সেই সংস্থার মেরুদণ্ড কতটা সোজা? দু’জন কমিশনার তো এই সেদিন অভিষিক্ত হলেন৷ নিশ্চয়ই শাসক দলের কাছের লোক৷ তাই মনে হয় কমিশনের কাছ থেকে ছাড়পত্র আদায় করে তড়িঘড়ি ১০০ দিনের কাজের মজুরি বাড়ানো গেল৷ কমিশন কি মনে করেন যে এর পিছনে নির্বাচনী ফয়দা তোলার উদ্দেশ্য কাজ করছে না? আবার মোদিজি কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায়কে জনতার কাছে প্রচার করতে পরামর্শ দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে ইডির আদায় করা অর্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে৷ বিচারের রায় বের হওয়ার আগেই এই ঘোষণা কী করে প্রধানমন্ত্রী করেন, যে অর্থের অছি এখন স্বয়ং আদালত? তিনি মনে হয় নার্ভাস হয়ে পড়েছেন৷

প্রশ্ন : ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে মোদি এবং বিজেপির জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে পেঁৗছেছিল, সমীক্ষায় তা প্রকাশিত হয়েছিল৷ নিন্দুকেরা বলেন যে পুলওয়ামা কাণ্ড কলকাঠি নেড়ে সংঘটিত হয়েছিল৷ আপনাদের কি মনে হয়, ঠিক সেইরকম কিছু ঘটতে চলেছে?
উত্তর : কেজরিওয়াল যদি নির্বাচনের আগে কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পান তাহলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুরুপের তাস আর থাকবে না৷ এর বেশি আমাদের পক্ষে বলা নিরাপদ নয়৷

প্রশ্ন : শোনা যাচ্ছে ইডির সমন অমান্য করার কারণে কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷
উত্তর : সুপ্রিম কোর্টের পরিষ্কার রায় আছে ইডির সমন অমান্য করা বা জিজ্ঞাসাবাদে সময় অসহযোগিতার কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করতে পারে না৷ তাঁকে তো বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত৷

প্রশ্ন : আরও শোনা যাচ্ছে দিল্লির মুখ্যসচিব দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে অভিযোগ জানিয়েছেন যে আপ দক্ষিণ ভারতের মদ ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়ে ঘুষ নিয়েছে এবং আপ-এর সর্বভারতীয় আহ্বায়ক হিসেবে তাই কেজরিওয়াল অভিযুক্ত হতে পারেন৷ কী বলেন?

উত্তর : ইন্টারনেট ঘেঁটে এটাই আমাদের ধারণা হয়েছে যে ইডি কোনও বস্ত্তগত প্রমাণ দেয়নি৷ মুখ্যসচিবের অভিযোগ ছাড়া অন্য মামলায় তথাকথিত দুই অভিযুক্তকে কেজরিওয়াল মামলায় রাজসাক্ষী করে তাদের বয়ান পেশ করেছে৷ এখন প্রশ্ন হল, দিল্লির মুখ্যসচিব কি করে তাঁর অভিযোগে জানান যে আপ ঘুষের টাকা গোয়ার নির্বাচনে ব্যবহার করেছে? তিনি তো অন্য রাজ্যে গিয়ে তদন্ত করেননি৷ আর মামলায় যদি প্রমাণিত হয়, রাজসাক্ষী অসত্যাচারণ করছে তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে আবার মামলা হবে৷ তাই, এক গোলকধাঁধায় দাঁড়িয়ে আছে মামলা৷ আর এই রাজসাক্ষীদের বয়ান নেওয়া হয়েছে কেজরিওয়ালকে গ্রেফতারের পরে৷ তাই দিল্লি হাইকোর্ট কি তার মান্যতা দিয়ে জামিনের অগ্রাহ্য করবেন?

আমারই মাথা ঘোরাচ্ছে৷ আজকের মতো ক্ষান্ত হওয়া ভালো৷