আলাদাভাবে মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ তেমন চোখে পড়ে না

পাঁচ ফর্মার গ্রন্থ ‘মহিলা বিজ্ঞানী’। গ্রন্থকার শ্রীমতি তপতী দেবী। তাঁর একটা পারিবারিক পরিচয় আছে। তিনি বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সুযােগ্য কন্যা।

Written by Barun Das Kolkata | June 14, 2019 12:48 pm

বিখ্যাত মহিলা বিজ্ঞানী মেরি কুরি (Photo: iStock)

পাঁচ ফর্মার গ্রন্থ ‘মহিলা বিজ্ঞানী’। গ্রন্থকার শ্রীমতি তপতী দেবী। তাঁর একটা পারিবারিক পরিচয় আছে। তিনি বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সুযােগ্য কন্যা। তিনি নিজেও কলেজ স্ট্রিটের এক পরিচিত প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওই প্রকাশনীর টাইটেল সংখ্যাও নেহাত কম নয়। নিজে লেখালেখি ও প্রকাশনা নিয়েই ব্যস্ত। কবিতা, ছােটগল্পসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। নামিদামি অনেক পত্রপত্রিকাতেই তাঁর লেখা প্রায় নিয়মিত পাঠকের চোখে পড়ে। সারস্বত বৈশিষ্ট্য নিয়েই সবার কাছে পরিচিত।

কেন শুধু মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়েই তাঁর এই প্রয়াস? আসলে ‘মেরি কুরির মতাে দু’একজন মহিলা বিজ্ঞানী সম্বন্ধে অনেক লেখালেখি পত্রপত্রিকা কিম্বা বইতে স্থান পেলেও অন্যান্য মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে লেখালেখি কিম্বা পূর্ণাঙ্গ বই খুব একটা চোখে পড়ে না। তাই আলাদাভাবে শ্রীমতি তপতী দেবীর এই অনিবার্য উদ্যোগ। অন্তত আলােচ্য বইয়ের ভূমিকা থেকে জানা যায় এমন প্রাসঙ্গিক কথা। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এই প্রাসঙ্গিক প্রয়াসের পিছনে এমন মহত উদ্দেশ্যকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। করা উচিতও নয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বইতে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান এবং প্রত্নতত্ত্বে যেসব মহিলাদের অসামান্য অবদান রয়েছে, তাঁদের কথাই বিশেষভাবে লেখা হয়েছে। আমরা অনেকেই জানি, উনবিংশ শতাব্দীর আগে মহিলাদের শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশের অধিকার ছিল না। পুরুষশাসিত সমাজে তাঁদের পদে পদে হেনস্থা হতে হয়েছিল। পরবর্তীকালেও অনেকে যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও পর্যন্ত পাননি। তাই তাে জসলিন বেল বার্ণালকে নােবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলা বিজ্ঞানীদের এগিয়ে যাওয়ার এই অনন্য কীর্তিকে উপযুক্ত সম্মান জানাতেই এই বইয়ের প্রকাশ। একই কারণে বইয়ের নামকরণও ‘মহিলা বিজ্ঞানী’- এমনটাই জানা গেল বইয়ের ভূমিকা থেকে। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে। লেখিকা তপতী দেবী প্রকাশক অমিত সামন্তকে এজন্য বাহবা জানাতেই হয়। এ ধরনের মহতী প্রয়াস প্রশংসনীয়। আগ্রহী পাঠক দু’মলাটের মধ্যে সারা বিশ্বের অন্তত ১৭ জন মহিলা বিজ্ঞানীর মহতী কীর্তি সম্বন্ধে জানতে পারবেন এ তাে কম কথা নয়।

আমাদের পরিচিত তাে বটেই, অনেক অপরিচিত মহিলা বিজ্ঞানীর কথাই স্থান পেয়েছে শ্রীমতি তপতী দেবীর এই বইয়ে। কে নেই এই ১৭ জনের তালিকায়? আছেন আইরিন কুরি, হাইপেসিয়া, মারিয়া ক্লেদোৎসকা, হেনরিয়েটা সােয়ান লেভিট, লিজা মাইটনার, রােজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, আনতােনিয়া মারি, আমেলি এম্মি নােথার, অ্যাডাই ইয়ােনাথ, বিয়েট্রিস টিনসলে, রসায়ন বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়, প্যালিও অ্যানথ্রোপলস্টি মেরি লিকি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী জসলিন বেল বার্ণাল, ক্যারােলিন হার্শেল ও ইউলিয়ামিনা।

এছাড়াও স্বমহিমায় আছেন বিস্ময় বিজ্ঞানী সিলভিয়া আর্লে এবং পরিবেশবিদ রাচেল কারসন। এই ১৭জন কীর্তিময়ী বিজ্ঞানীকে নিয়েই ‘মহিলা বিজ্ঞানী’ শিরােনামে শ্রীমতি তপতী দেবীর অনবদ্য গ্রন্থ । এবং বলা বাহুল্য, এটি শুধু নিছক পড়ার জন্যই নয়, সংগ্রহে রাখার মতােই একটি গ্রন্থ। যাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, রেফারেন্স হিসেবেও তাঁদের প্রয়ােজনে লাগবে নিঃসন্দেহে। আর এখানেই লেখিকা শ্রীমতি তপতী দেবীর এই বইয়ের গুরুত্ব। বইয়ের প্রকাশক হিসেবে অমিত সার কৃতিত্বকেও বাহবা জানাতে হয়।

মেরি ও পিয়ের কুরির প্রথম সন্তান আইরিন কুরি। জন্ম ১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে। মা’ই ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। শৈশব থেকেই আইরিনের অঙ্কের প্রতি ঝোঁক ছিল। স্কুলের পাঠ শেষ করেই তিনি ১৯১৪ সালে স্নাতক স্তরে গণিত ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে সারাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মা ও বাবা দু’জনেই তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী। মা-বাবার ভাবাদর্শকে সামনে রেখে আইরিন নিজেকে তৈরি করেছিলেন। গবেষণা কাজের জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিয়েশন ইনস্টিটিউটে যােগ দেন।

১৯২৫ সালে তিনি ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। গবেষণার বিষয় ছিল পােলেনিয়াম ধাতু থেকে নির্গত আলফা কণার বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা। উল্লেখ্য, পােলেনিয়াম ধাতু আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর মা মেরি কুরি। স্বদেশভূমি পােল্যান্ডের নামানুসারে তিনি এই নব আবিষ্কৃত ধাতুর নাম রাখেন ‘পোলেনিয়াম’। পরবর্তীকালে তাঁকে যথাযথ সঙ্গ দেন তাঁর স্বামী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ফ্রেডারিক জোলিও। স্ত্রীর সঙ্গে ল্যাবরেটরির কাজ শিখতে শুরু করেন এবং ক্রমশ গবেষণার কাজেও মনােনিবেশ করেন ফ্রেডারিক জোলিও।

১৯২৮ সালে যৌথভাবে তাঁদের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল তেজষ্ক্রিয়তা। এই গবেষণার সাফল্য শুধু তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টিরই পথ দেখানাে নয়, পরমাণু ভাঙনের সম্ভাবনাকেও সামনে নিয়ে আসে। তাঁদের গবেষণার ফলে বিস্ফোরণের পথও প্রশস্ত করেছিল। ১৯৩৫ সালে রসায়নে নােবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন এই বিজ্ঞানী দম্পতি। গবেষণার পাশাপাশি নারী শিক্ষা প্রসারেও সারাজীবন আন্দোলন করে গেছেন। ১৯৫৫ সালের মার্চে মায়ের মতাে লিউকোমিয়া রােগেই মৃত্যু হয় তাঁর।

আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসের প্রায় শেষলগ্নে থিওনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন হাইপেসিয়া। সম্ভবত ৩৭০ সালে গণিত দর্শনে পারদর্শিনী হাইপেসিয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লেখা তাঁর এক উল্লেখযােগ্য বই ‘অ্যাট্রনমিক্যাল ক্যানন’। তিনি তরলের ঘনত্ব মাপার যন্ত্র হাইড্রোমিটার এবং আকাশে জ্যোতিষ্কদের চিহ্নিত করার যন্ত্র অ্যাস্ট্রলার উদ্ভাবন করেছিলেন। এই গ্রিক নারী বিজ্ঞানীকে খ্রিস্টানরা সহ্য করতে পারেননি। ৪১৫ সালে তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়।

মারিয়া কুরি বা মেরি কুরি নামে খ্যাত হলেও তাঁর আসল নাম মারিয়া ক্লেদোৎসকা। জন্ম ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর। পােল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে। দু’বার নােবেল পুরস্কার পান। প্রথমবার পদার্থবিদ্যায় স্বামী পিয়ের কুরি এবং হেনরি বেকবেলের সঙ্গে এবং পরের বার রসায়নবিদ্যায় এককভাবে। বেকরেল আবিষ্কৃত নতুন রশ্মি পদার্থের যে ধর্মের জন্য ইউরেনিয়াম যৌগ থেকে নির্গত হচ্ছে, তার স্বরূপ নির্ণয় করাই ছিল মারিয়া কুরির গবেষণার বিষয়বস্তু। তিনি পদার্থের এই নতুন ধর্মের নাম রেখেছিলেন ‘তেজস্ক্রিয়তা’।

মার্কিন-কন্যা হেনরিয়েটা সােয়ান লেভিট-এর জন্ম ১৮৬৮ সালের ৪ জুলাই, ম্যাসাচুসেটস-এর ল্যাঙ্কাটারে। হেনরিয়েটা গবেষণা শুরু করেছিলেন মহাকাশের ধ্রুবতারাকে ভিত্তি করে। পরে তিনি ক্ষুদ্র ম্যাজেলানিক ক্লাউডের মধ্যেকার সেফিড তারাদের নিয়ে গবেষণা করেন। লেভিটের ভাবনা কাজে লাগিয়ে হার্ভসভ্রুঙ  তারাদের দুরত্ব নিয়ে একটি রেখাচিত্র তৈরি করেন। ছায়াপথ, অ্যান্ডামজ প্রভৃতি গ্যালাক্সির দূরত্ব এবং আকারও মেপে ফেললেন। আর এডউইন হাবল তো মহাবিশ্বের বয়সও হিসেব করে ফেললেন।

লিজা মাইটনার ১৮৭৮ সালের ৭ নভেম্বর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল গণিত ও পদার্থবিদ্যা। তিনি ও রসায়নবিদ অটো হান যৌথভাবে ১৯১৮ সালে ৯১তম মৌল পদার্থ পােট্যাকটিনিয়াম আবিষ্কার করেন। পারমাণবিক বিভাজন বিক্রিয়া আবিষ্কারে যৌথ অবদান ছিল অটো হানের সঙ্গে লিজা মাইটনারেরও। কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাদেমি অফ সায়েন্সেস অটো হানকে এককভাবে রসায়নশাস্ত্রে নােবেল পুরস্কারে সম্মানিত করেন। ১৯৬৬-র ২৭ অক্টোবর শেষনিঃশ্বাস ফেলেন লিজা মাইটনার।

রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপিকা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে ভারতীয় ভেষজ-গাছপালা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ভারতের আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বর্ণিত বিভিন্ন গাছগাছড়ার ওষধি গুণাগুণ তিনি নানাপর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন। প্রথমে গাছগাছড়ার আলকালয়েড সম্পর্কে গবেষণা করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ভেষজ গুণসম্পন্ন পদার্থের রাসায়নিক গঠন নিয়ে। ২০০৬ সালে প্রয়াত এই বিজ্ঞানী প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন।

প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ফসিল, হাড়গােড়, পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি এসবের চর্চার মধ্যে দিয়ে প্যালিও অ্যানথ্রোপলজিস্ট মেরি লিকি জানার চেষ্টা করেছিলেন মানুষ ঠিক কোন সময়ে এই পৃথিবীতে এসেছিল। আর কেমন ছিল তাদের আচারবিধি। গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন আফ্রিকার গহীন অরণ্যে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জসলিন বেল বার্ণাল খুঁজে এনেছেন মহাজগতের এক অজানা রহস্য- ‘পালসার’। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পরামর্শদাতা অ্যান্টনি হিউশ। অথচ নােবেল প্রাপকের তালিকায় অ্যান্টনি হিউশ, বাদ গেলেন জসলিন বেল বার্ণাল।

রােজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন প্রথমে গ্যাস ফেজ ক্রামাটোগ্রাফি নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করলেও তিনি প্রােটিন দ্রবণের এক্স-রে ডিফ্রাকশন নিয়ে গবেষণা করে সম্মান, স্বীকৃতি ও খ্যাতি পান। আনতােনিয়া মারির গবেষণার বিষয় ছিল আকাশের তারা। বর্ণালী বিশ্লেষণ সহ যুগ্ম তারার কক্ষপথও নির্ধারণ করেন তিনি। ক্যারােলিন হার্শেল আবিষ্কার থাকাকালীন আবিষ্কার করেন নেবুলা, নোভাসহ মােট ৭৯টি তারা।

আমেলি এম্মি নােথার-এর গবেষণার বিষয় এনার্জি কনজারভেশন ল’কে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান। অ্যাডাই ইয়ােনাথ-এর কাজ রাইবােজোম-এর গঠনশৈলি ও পারমাণবিক স্তরে এদের কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে। বিয়েট্রিস টিনসলের বিষয় মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি ও তাদের ভিতরের তারাদের উদ্ভব। বিস্ময় বিজ্ঞানী সিলভিয়া আর্লের বিষয় সমুদ্রের জলের নীচের উদ্ভিদ। আর পরিবেশবিদ রাচেল কারসন যদি সেদিন ‘দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং’ গ্রন্থটি বিশ্ববাসীকে উপহার না দিতেন তাহলে জানতে পারতাম না বিষময় পরিবেশের কথা।

মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে অনবদ্য উদ্যোগ। তবে বইটির মুদ্রণ, কাগজ, বাঁধাই সাধারণ মানের। মুদ্রণ-প্রমাদও এড়ানাে যায়নি। যা তন্নিষ্ঠ পাঠককে পীড়া দেয়। সুপ্রতিম মণ্ডলের প্রচ্ছদ-চিত্রেও শৈল্পিক ভাবনার তেমন কোনও পরিচয় মেলে না। উল্লেখ্য, মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে এমন কাজ সম্ভবত এই প্রথম। বিশেষ করে যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি থেকে বার বার অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেদিক থেকে প্রকাশকের এই উদ্যোগের প্রশংসা করতেই হয়। একই সঙ্গে বিশিষ্ট লেখিকা তপতী দেবীকেও।