• facebook
  • twitter
Friday, 6 December, 2024

যখন বৃষ্টি এলো

শুধু ভিজে যাওয়া বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটের ফাঁক দিয়ে কালো মেঘের আনাগোনা দেখতে পেলো। মেঘেরা যেন হঠাৎ করে হুল্লোড় জুড়ে দিয়েছে আকাশের বুকে। সেখান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো জানলার বাইরের বকুল গাছটা ভিজে যাচ্ছে মহা আনন্দে।

অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ খুব সক্কালে ঘুম ভাঙতে বুবুন দেখলো ওদের ফ্ল্যাটের সামনের বকুল গাছের ডালটায় একটা পাখি চুপ করে বসে আছে। তোমাদের মনে হতেই পারে এ আর নতুন কথা কী! রোজ কতো পাখিই তো ডালে এসে বসে থাকে! না, না, ঠিক তা নয়। পাখিটাকে কেমন একটু অসহায় বলে মনে হলো বুবুনের। পাখিটা একটু ডানা ঝাপটিয়ে ওড়বার চেষ্টা করলো। কিন্তু উড়বে আর কোথায়! আকাশ তো প্রায় নেই বললেই চলে। চারপাশে বড়ো বড়ো ফ্ল্যাট বাড়ির মাথা গোটা আকাশটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। শুধু জেগে রয়েছে একচিলতে আকাশ। এই বকুলের ডাল থেকে উড়ে গিয়ে যে দূরে কোনো গাছের ডালে একটু প্রাণ খুলে বসবে সে উপায় নেই। গাছগুলো কেটে সাফ করে দিয়েছে কবেই। তাই পাখি ওড়বার কথা ভেবেও আর উড়লো না।

বুবুন রোজকার মতোই বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে নিল। সামান্য টিফিন খেয়ে নিয়ে তার পড়ার ঘরে চলে এলো। গরমের ছুটির পর স্কুল খুলে গেছে। ফ্ল্যাটের দোতলায় ওর পড়ার ঘর। জানলা দিয়ে সকালেই

হু-হু করে গরম হাওয়া এসে ঢুকছে ঘরে। ফ্যান একটা চলছে ঠিকই, কিন্তু প্রচণ্ড গরমে ঘরের ভিতরেও বসে থাকা দায়। পড়ায় মন বসতে চাইছে না কিছুতেই। এই ঘরটার বাইরেই ওর বাবার নিজের হাতে বসানো বকুলের চারাটা বেশ বড়ো হয়ে দোতলার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একা একা। কয়েকটি ফুলের গাছ অবশ্য বসিয়েছে বুবুনের মা। রোজ সকালে তার থেকে ফুল তুলে বাড়ির ঠাকুরের পুজোতে দেয়। আশেপাশে আর তেমন গাছপালা না থাকায় অনেক রকম পাখি এই বকুলের গাছটাতে এসে বসে। কোনো পাখি আবার তাদের থাকার জন্য আশ্রয় তৈরি করেছে গাছটায়। তাই সকাল হলেই অনেক পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায় বকুলের গাছটি থেকে। বুবুনের এসব খুব ভালো লাগে।

প্রকৃতি পাঠ পড়তে পড়তে যা কিছু শেখে বুবুন তার কিছুই আজ মেলে না। তার বাড়ির চারপাশটাই তো কেমন যেন অচেনা জগৎ। চারদিকে কতো গাছপালা থাকবে, জলভরা পুকুর থাকবে। ওদের থাকার ফ্ল্যাটের চারপাশে তার কিছুই নেই। শুধু বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট, আর জানলা দরজায় ঘেরা মস্ত বড়ো বড়ো দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ওই একচিলতে আকাশে মেঘেদের উড়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে না। গাছপালার সঙ্গে মেঘেদের খুব ভাব। গাছেদের হাতের ইশারায় মেঘগুলো উড়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর কথা বলতে বলতে ঝরে পড়ে অঝোর ধারায়। কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটের চারপাশে খুব বেশি গাছ নেই যে। তাই গরমের সময় একটু বেশি গরম লাগে ওদের সকলেরই। কারুর কিচ্ছু ভালো লাগে না। বুবুনের মায়ের ঘরের কাজ করতে কষ্ট হয়। ল্যাপটপের সামনে বসে ওর বাবার অফিসের কাজ করতে খুব অসুবিধা হয়। আর বুবুনের পড়ায় তো মনই বসে না। ছবি আঁকতেও ভালো লাগে না। বুবুনের বাবার অবশ্য এই কংক্রিটের শহরে থাকার এতোটুকুও ইচ্ছে নেই। তাই দূরে একটা ফাঁকা জায়গা কিনে বাড়ি বানাতে শুরু করেও দিয়েছেন। আর এটাও ঠিক করে নিয়েছেন থাকার জন্য খুব বড়ো বাড়ি নয়। যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই। বাড়ির চারপাশে বেশ কয়েকটি গাছ ইতিমধ্যেই লাগিয়েও ফেলেছেন। আম, লিচু, সুপারি, আর অবশ্যই একান্ত ভালোলাগার একখানা বকুলের গাছ। এখানকার মতোই অনেক রকম পাখি এসে সেই বকুলের ডালে বিশ্রাম নেবে, গান শোনাবে। আবার কেউ কেউ থেকেও যাবে সেই গাছটায়। অসহ্য গরমের মধ্যে ফ্ল্যাটের এই ঘরে বসে এইসব ভাবছিলো বুবুন। আজ সকালেই টিভির খবরে শুনেছে আজ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। বর্ষা আসছে, তাই মেঘেদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আজ উত্তাপও। কী অসহ্য গরম!

দেখতে দেখতেই কোথা থেকে একঝাঁক উড়ো মেঘ একদল বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়ে গেল। সেই দামাল বাতাস কিচ্ছুটি না বলে জানলার পাল্লাগুলোকে ধাক্কা দিয়ে বুবুনের দোতলার ঘরে এসে ঢুকলো। এসেই সগর্বে যেন বুবুনকে বলে ফেলল— ‘এই যে, গরমের জন্য তুমি তো খুব কষ্ট পাচ্ছো , তাই আমরা এসে গেলাম। আর একটু পরেই আমাদের সঙ্গী এসে পৌঁছে যাবে।’ বুবুন হন্তদন্ত হয়ে যেই না জিজ্ঞেস করতে গেল সেই ঝোড়ো হাওয়াকে, অমনি জানলার বাইরের একচিলতে আকাশখানা মুখ ভার করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। দুদ্দাড় করে ফ্ল্যাটের জানলাগুলো বন্ধ হতে লাগলো। বুবুন শুধু হাট করে খুলে রাখলো তাদের ফ্ল্যাটের জানলাটা।

সেই জানলা দিয়ে হাতটা তার বাড়িয়ে দিল বাইরে বৃষ্টি ফোঁটাগুলো ছোঁয়ার জন্যে। সে যে কী আনন্দ! বৃষ্টির ফোঁটারাও যেন ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। যে ফড়িংটা ছাদের কার্নিশে বসেছিল এতোক্ষণ, ও বৃষ্টির থেকে বাঁচতে একটু আড়ালে গিয়ে বসলো। বুবুনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো পুকুরের জলে টুপটাপ বৃষ্টি দেখার। বৃষ্টির ফোঁটারা জলের ওপর যেন আলপনা এঁকে দেয়, বুবুনের মা বলেছে ওকে। সেটাই দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর। এখানে তো সে উপায় নেই! শুধু ভিজে যাওয়া বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটের ফাঁক দিয়ে কালো মেঘের আনাগোনা দেখতে পেলো। মেঘেরা যেন হঠাৎ করে হুল্লোড় জুড়ে দিয়েছে আকাশের বুকে। সেখান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো জানলার বাইরের বকুল গাছটা ভিজে যাচ্ছে মহা আনন্দে। আর সেই পাখিটা তার ডানা দুটো ঝাপটে বৃষ্টির জলে চান করছে খুব মজা করে।