শামসুল হক
কাঠবেড়ালির ছানাটা দু’দুটো দিন কাটিয়ে দিল একেবারে একা একাই। তার বয়স এখন মাত্র দশ দিন। অনেক দিনের পুরাতন এই বটগাছের ছোট্ট একটা খোপের মধ্যে জন্ম তার। সেই প্রথম দিন থেকেই সে দেখছে একজনের কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছে সে।
Advertisement
এখন কিন্তু একদমই তার দেখা পাচ্ছে না সে। তাই দিনগুলো তাকে কাটাতে হচ্ছে বেশ চিন্তার মধ্যেই। ভয়ও লাগছে ভীষণ। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই ক’দিন তাকে খাবারটাও জোগাচ্ছিল সে-ই। তাই এখন তো তার প্রায় না খেতে পেয়ে মরার মতো অবস্থাই এসে দাঁড়িয়েছে।
Advertisement
তাকে কাছাকাছি দেখতে না পেয়ে সে তাকায় এদিক সেদিক। কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে মনে মনে ভীষণ হতাশই হয়ে যায় সে।
আজ সে তাকিয়েছিল ওই আকাশের দিকে। অবশেষে দেখল একটা ছোট্ট পাখি এসে বসেছে তার কাছে।
পাখিটাকে দেখে প্রথমটায় একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল কাঠবিড়ালিটা। তারপর তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে একটু আশ্বস্ত হল সে। মনের মধ্যে যেন একটু সাহসও এল।
খোপের ভিতর থেকেই মুখ বাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে থাকল পাখিটার দিকে। তারপর বলল— তোমার নাম কী ভাই, কোথায় থাকো তুমি?
পাখিটার চোখ এতক্ষণ ছিল অন্যদিকে। এবার তাকাল তার দিকে। বলল— আমি টুনটুনির ছানা গো। তোমার কাছাকাছিই তো থাকি আমি।
পাশেরই একটা আমগাছের দিকে ইশারা করল সে।
—ও, বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল কাঠবিড়ালির ছানাটা।
বাচ্চা টুনটুনি বলল, —তা তুমি কি একা একাই থাকো?
কাঠবিড়ালি চুপ। তাকে দেখে টুনটুনি যেন একটু কষ্ট পেল। আমতা আমতা করে বলল, —তুমি তো খুবই ছোট। কিন্তু তোমার কাছে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
কাঠবিড়ালির ছানাটা এবার করুণ কণ্ঠে বলল, —হ্যাঁ গো, আমি দু’দিন ধরে একা একাই আছি। একজন এতদিন আমার কাছে কাছেই থাকত সবসময়। কিন্তু এখন তাকে দেখছি না।
—ওটাই তো তোমার মা। সবারই তো একটা করে মা থাকে। আমারও আছে। ওই তো ওইখানে। ওই গাছের ডালে, আমাদের বাসায়।
টুনটুনি আবার ইশারা করল সেই গাছটার দিকেই।
—তাহলে আমার মা কোথায় গেল? কেঁদে উঠলো কাঠবিড়ালির ছানাটা।
টুনটুনির ছানা বলল, —আহা, অমন করে কাঁদতে নেই। হয়তো আছে কোথাও। দেখো ঠিক সময়মতো ফিরে আসবে তোমার কাছে।
কান্নাভেজা কণ্ঠেই কাঠবিড়ালি বলল, —তাহলে আসছে না কেন? আমি যে দু’দিন না খেয়েই আছি। এবার হয়তো মরেই যাব।
আঁতকে উঠল টুনটুনি। —কী বললে, দু’দুটো দিন কিচ্ছু খাওনি?
—না গো, কে খেতে দেবে আমায়? আমি যে এখান থেকে নড়তেই পারছি না।
—দাঁড়াও, আগে তোমার খাবার ব্যবস্থা করি। তারপর হবে অন্য কথা।
চলে গেল টুনটুনির ছানা। ফিরে এল মিনিট পাঁচেক পরেই। ঠৌঁটে তার পাকা একটা পেয়ারা। সে জানে কাঠবিড়ালিরা পাকা পেয়ারা খেতে খুব ভালোবাসে। তাই কাছের একটা গাছ থেকেই সে ছিঁড়ে এনেছে এই ফলটা।
পাকা পেয়ারাটা দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল কাঠবিড়ালির। বলল, —ওঃ, তুমি কী করে জানলে গো, আমি এই ফলটা খেতে এত ভালোবাসি। আমার মা বুঝি তোমাকে বলে দিয়েছিল?
—না-না, তোমার মা নয়। বলেছে আমার মা।
—ও।
এবার টুনটুনির দিকে অবাক চোখেই তাকাল কাঠবিড়ালি। তারপর পেয়ারায় একবার ঠোঁটটা ঠেকিয়ে বলল,
—জানো তো এই ক’টা দিন আমার মাও আমাকে এমন পেয়ারাই এনে খাওয়াত। তাই এইসব কথা বলছিলাম আর কী!
এবার চুপচাপ হয়ে গেল কাঠবিড়ালির ছানা। পেয়ারাটাও খেতে থাকল বটে, কিন্তু খাওয়ার মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখা গেল না।
টুনটুনি ভাবল, ওর নিশ্চয়ই মনে পড়েছে ওর মায়ের কথা। তাই ও এখন অমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কিন্তু ওর মায়ের হয়েছেটাই বা কী, যার জন্য দু’টো দিন সে বাসায় ফেরেনি। খোঁজ নেয়নি তার সন্তানেরও?
সে তখন ভাবতে বসল অনেক কিছুই। কিন্তু অতশত বোঝবার মতো বয়সও তো তখন তার হয়নি। তাই সে আবার ছুটল তার মায়ের কাছে। যাবার সময় বলল, —তুমি একটু বসো ভাই। আমি একটু পরে আবার আসব তোমার কাছে। তুমি ততক্ষণে খেয়ে নাও পেয়ারাটা। দু’দিন কিছু খাওয়া হয়নি তোমার। না খেলে খুবই কষ্ট হবে।
কাঠবিড়ালি বলল, তুমি আবার আসবে তো ভাই? আমি বড়ই একা হয়ে গেছি। এইসময় আমাকে ভুলে যেও না যেন।
টুনটুনি বলল, না-না, ভুলে যাব কেন? তুমি যে আমার বন্ধু।
সে আবার উড়ে গেল তার মায়ের কাছে। ফিরে এল মিনিট দশেক পর। সঙ্গে তার মা টুনটুনি। ওরা এসে দেখল তখনও খাওয়া শেষ হয়নি কাঠবিড়ালির। পেয়ারাটা একপাশে সরিয়ে রেখে সে তখন তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে।
টুনটুনি এবং তার মা তখন এগিয়ে গেল তার দিকে। বলল, কী ব্যাপার, এখনও খাওয়া শেষ হয়নি?
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকল কাঠবিড়ালির ছানা। তারপর ম্লান কণ্ঠে বলল, খেতে একদমই ইচ্ছে করছে না গো।
মা টুনটুনি বলল, অমন কথা বলতে নেই বাছা। খেতে তো হবেই। নইলে শক্তি পাবে কোথা থেকে। তোমাকে তো বড় হতে হবে।
এবার মায়ের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল কাঠবিড়ালি। সত্যিই বড় মায়াময় মুখ। এতদিন নিজের মাকে কাছে পেয়েও তেমনভাবে দেখার চেষ্টা করেনি সে। আজ কিন্তু অন্য মাকে দেখে ভাবতে শুরু করে দিল তার মাও ঠিক এমনটাই।
সে বলল, আমার মা কোথায় তা কি তোমরা জানো?
—আছে, আছে। অত উতলা হচ্ছ কেন। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে আটকে আছে তোমার মা। ঠিক সময়মতোই সে ফিরে আসবে তোমার কাছে। আপাতত আমি তো রইলাম তোমার মা হয়ে তোমারই পাশে। আমাকে কি তুমি মা ভাবতে পারছ না?
এবার একটু লজ্জা পেল কাঠবিড়ালির ছানা। বলল, —না-না, তা কেন। মায়েরা কখনও আলাদা হয় না কি?
মা টুনটুনি বলল, তাহলে এবার আমার কথা শুনতে হবে তোমাকে। এখন আমাদের সঙ্গে তোমাকেও চলে যেতে হবে আমাদের বাসায়।
—আর আমার মা? এখানে আমাকে না দেখতে পেলে খুঁজবে তো?
—তখন তুমি তোমার মায়ের হাত ধরে আবার ফিরে আসবে নিজেরই বাসায়।
—ঠিক আছে। তাহলে তাই হোক।
টুনটুনিদের সঙ্গে এবার কাঠবিড়ালি চলল তার নতুন ঠিকানায়।
মা-টুনটুনিরও চোখের সামনে ভেসে উঠল মাত্র দু’দিন আগেই ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটা। কাঠবিড়ালির মা আর বেঁচে নেই। আস্ত একটা সাপ জ্যান্ত গিলে খেয়েছে তাকে। সে একই গাছে ওদের খোপের সামান্য একটু দূরেই অন্য একটা খোপের মধ্যে থাকে সেই সাপটা। নিজের চোখেই সে দেখেছে সব ঘটনা। কিন্তু তার আর ক্ষমতা কতটুকু। তাই ইচ্ছে থাকলেও কোনো কিছু করাই সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।
সব জানে মা টুনটুনি। কিন্তু এখনই এইটুকু একটা বাচ্চাকে বলা যাবে না সেইসব কথা। আর এই মুহূর্তেই তাকে যদি অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে ফেলা না যায়, তাহলে তার পরিণতিও যে হবে তার মায়েরই মত, সেটা বুঝেই তাকে চটপট নিয়ে চলল তার নিজের নিরাপদ আস্তানাতে।
Advertisement



