• facebook
  • twitter
Friday, 6 December, 2024

আলোর মেয়ে মেরি কুরি

দু’বার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরি। মাদাম কুরি নামেও তিনি পরিচিত। তাঁর ডাকনাম ছিল মানিয়া। শৈশব থেকে মানিয়ার বড় হয়ে ওঠার গল্প ধারাবাহিকভাবে লিখলেন সিদ্ধার্থ মজুমদার।

এর আগের পর্বে আমরা দেখেছি, পিয়ের-কে সঙ্গী করে মেরি নতুন মৌল (পোলোনিয়াম) আবিষ্কার করেছেন। তারপর ইউরেনিয়ামের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় নতুন অজানা মৌলের (রেডিয়াম) উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছেন। তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে গবেষণার ফলাফলগুলি নিয়ে মেরি পি এইচ ডি থিসিস জমা দিয়েছেন এবং ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি পেয়েছেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে মেরি কুরির থিসিসটি সেরা থিসিস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার- ১৯০৩
যে বছর পি এইচডি ডিগ্রি পেলেন মেরি, ওই বছরই (১৯০৩) ডিসেম্বরে ‘রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি’ আবিষ্কারের জন্যে পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল এবং মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পান। পৃথিবীর প্রথম মহিলা হিসেবে মেরি কুরি নোবেল পুরস্কার পান। মেরি কুরি আর পিয়ের কুরির রেডিয়ো আক্টিভিটি আবিষ্কার আর নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় সারা পৃথিবীর মানুষ প্রশংসা আর অভিনন্দন বার্তা আসতে লাগল। নোবেল প্রাইজের সব টাকা বিজ্ঞান গবেষণার কাজে খরচ করে দিয়েছিলেন মেরি কুরি।

মেরি ও পিয়ের অনুমান করছিলেন তেজস্ক্রিয় রশ্মি মানুষের শরীরের জন্যে খুব সাংঘাতিক ক্ষতি করে। নানান কঠিন অসুখ ডেকে আনে। যদিও তখন কেউই জানতেন না যে, ‘রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটি’ শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করে, এমনকি দীর্ঘকাল তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে ডেকে নিয়ে আসতে পারে মৃত্যুও। পিয়ের এবং মেরি দু’জনেই সেসময়য় বুঝতে পারছিলেন, তাঁদের শরীর প্রায় সময়ই ক্লান্ত হয়ে থাকে। সব সময় গায়ে হাত পায়ে ব্যাথা। সেইসঙ্গে, হাতের চামড়াও কেমন ঝলসে যাওয়ার মতন হয়ে গেছে! দু’জনেরই হাতে ক্ষত হয়েছে, অনেকদিন ধরে যে ক্ষত সারছে না।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দু-বছর পরে মেরির কোলে এসেছে ছোটো মেয়ে। আইরিনের বোনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইভ’। ইভ কুরি।

অন্য এক উনিশে এপ্রিল
তারপর এল সেই অন্ধকারের মতন কালো ভয়ংকর দুঃখের দিন। ১৯০৬-এর ১৯ এপ্রিল। মেঘলা আকাশ। সারা দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তা ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। ছাতা নিয়ে হাঁটছিলেন পিয়ের। কিছুটা অন্যমনস্কও ছিলেন। কিছুটা তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হচ্ছিলেন পিয়ের। সেসময় একটি ঘোড়ায় টানা একটি মালবাহী গাড়ির চাকার নীচে পড়লেন পিয়ের। গাড়িটি ছিল মিলিটারি ইউনিফর্মে বোঝাই প্রায় ছ’টন ওজনের মতন। দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল পিয়ের কুরির। পিয়ের বয়স তখন ছিল ছেচল্লিশ বছর। বিজ্ঞানী পিয়ের কুরির অসময়ে এই মৃত্যু সারা পৃথিবীর ক্ষতি। অসহায় হয়ে পড়লেন মেরি। কী করে থাকবেন তিনি পিয়েরকে ছেড়ে? দু-জন ছোটো ছোটো মেয়েকে কী করে বড়ো করবেন তিনি? মেরির জীবনে নেমে এল নিকষ অন্ধকার। মেরির বয়স তখন সাঁইত্রিশ বছর। আইরিনের বয়স তখন ছিল আট আর ইভের বয়স মাত্র এক বছর কয়েক মাস। মাত্র এগারো বছরের বিবাহিত জীবন, শেষ হয়ে গেল এক মূহূর্তেই।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই মেরি গবেষণার কাজে যোগ দিলেন। মেরি কুরি ও দুই মেয়ের সাহায্যের জন্যে ইতোমধ্যে ফরাসি গভর্নমেন্টের পেনশনের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন মেরি। এর মাসখানেক পরে পিয়েরের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া পদে যোগদানের আমন্ত্রণ পেলেন মেরি। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের অধ্যাপক হিসেবে সানন্দে কাজে যোগ দিলেন মেরি। অসম্ভব কাজ বেড়ে গেল মেরির। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, অসম্পূর্ণ গবেষণার কাজ, ক্লাস নেওয়া আর সেই সঙ্গে ছিল ঘরসংসারের কাজ। সেসময় প্রতি মূহুর্তে সঙ্গী পিয়েরের চলে যাওয়ার শূন্যতার অভাব টের পাচ্ছিলেন মেরি।

দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার, কেমিস্ট্রিতে-১৯১১
আবার সুখের দিন এল। ১৯১১ সালে কেমিস্ট্রিতে একক ভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন মেরি কুরি। দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার। বিজ্ঞানের ইতিহাসে একই মহিলা
দু-বার দুটি আলাদা বিভাগে নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী একমাত্র মেরি কুরি। তিনি প্রথম বিজ্ঞানী এবং একমাত্র মহিলা বিজ্ঞানী যিনি দু-বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম মৌল নিষ্কাষণ পদ্ধতি, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বিপদ সংকুল পদ্ধতি। এই কাজ শুরু হয়েছিল তখন পিয়ের জীবিত ছিলেন। বিশুদ্ধ রেডিয়াম প্রস্তুত করতে সক্ষম হওয়ার পরে রেডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব নির্ণয় করেছেন মেরি। অসাধারণ এই সাফল্যের জন্যে দ্বিতীয়বার কেমেস্ট্রি বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেলেন মেরি কুরি।

পিয়েরের মৃত্যুর পর থেকে মেরির একটাই স্বপ্ন ছিল— স্বামী পিয়ের কুরির স্মৃতিতে একটি গবেষণাগার গড়ে তোলার। পিয়ের কুরির স্মৃতির উদ্দেশে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের ভবন তৈরি করলেন মেরি। এই ‘রেডিয়াম ইন্সটিটিউট’ মানবজাতির কল্যাণের জন্যে নিবেদিত। মেরি কুরির স্বপ্ন সার্থক হল। মনে রাখতে হবে, ফ্রান্সে মেরি কুরির পক্ষে এগিয়ে যাওয়া অত সহজ ছিল না। একজন বিদেশিনী, তারপর আবার মেয়ে, সব মিলিয়ে তাঁকে প্রচুর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সেখানকার অনেক মানুষ তাঁকে অবজ্ঞা করেছে। এমনকি, অনেক নামজাদা বিজ্ঞানীরাও মেরির পেছনে লেগেছিলেন। বহুবার অসহযোগিতা আর নানান বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে মেরিকে। এমনকি তাঁর নামে বদনাম ছড়ানো হয়েছে।
এত সব সহ্য করেও তিনি মাথা উঁচু করে নিজের কাজে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে মেরি কুরি
এমন সময় পৃথিবীতে যুদ্ধ লাগল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ল্যাবরেটরির কাজ বন্ধ হয়ে গেল যুদ্ধের সময়। মেরি কী করছিলেন তখন? তিনি তখন ফরাসি দেশের মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন। নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে। সেসময়য় এক্স-রে যন্ত্রপাতি মোটেই সুলভ ছিল না। নিজের টাকা দিয়ে ‘মোবাইল এক্স-রে ইউনিট’ তৈরি করে ফ্রান্সে প্রথম ‘মিলিটারি- রেডিয়োলোজি’ ইউনিট চালু করলেন। একশো পঞ্চাশ জন মেয়েকে এক্স-রে করার ট্রেনিং দিলেন মেরি নিজে। আহত সেনাদের এক্স-রে ছবি তুলে ডাক্তার ও সার্জেনদের চিকিৎসায় সাহায্য করার কাজে এগিয়ে এলেন মেরি। এই কাজে তিনি মেয়ে আইরিনকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। প্রায় চার বছর (সেপ্টেম্বর ১৯১৪ থেকে ১৯১৯) ধরে এই কাজ করেছেন মেরি। শুধু ফ্রান্সেই নয় বেলজিয়ামের হাসপাতালেও গিয়েছেন মেরি। নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে ‘এক্স-রে মোবাইল-ভ্যান’ চালিয়ে নিয়ে গেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় দুশো হাসপাতালে এক্স রে যন্ত্রপাতি বসানোর ব্যবস্থা করেছেন। মেরি তাঁর দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারের সমস্ত টাকা যুদ্ধে আহত সেনাদের চিকিৎসা ও কল্যাণের জন্যে নির্দ্বিধায় খরচ করেছেন। একজন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানীর যুদ্ধক্ষেত্রে এইভাবে কাজ করা দ্বিতীয় আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই ঘটনা ব্যতিক্রমী ও বিরল এক দৃষ্টান্ত।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে মেরি আবার বিজ্ঞানের কাজে পুরো দমে কাজ শুরু করলেন। নানান দেশ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা আসছেন তাঁর কাছে গবেষণা করার জন্যে। তাঁর কাছে কাজ করতে পাওয়া তো এক পরম সৌভাগ্যের! বিজ্ঞানের নানান আলোচনা সভাতেও যেতে হয় মেরিকে। নানান দেশের অনুষ্ঠান, সভা সম্মেলনে আমন্ত্রিত হতে হয় তাঁকে। সেই সঙ্গে নিজের কত পড়া আর লেখার কাজ থাকে। তারপর তো আছে ল্যাবরেটরিতে ফিরে নিজে কাজ করা এবং অন্য গবেষকদের কাজ দেখা। পরামর্শ দেওয়া। এখন পাশে পিয়ের নেই। কোনও কোনও দিন রাত দুটোও বেজে যায় কাজ করতে করতে।

পোল্যান্ডের মানুষ অনেকদিন ধরেই চাইছিলেন মেরি যাতে ওয়ারশ’তে একটি রেডিয়াম ইন্সটিটিউট গড়ে তোলেন। প্যারিসে বসে সে কাজও শেষ করলেন মেরি।

মাদাম কুরির চির বিদায়
ধীরে ধীরে একসময় দিন রাত কাজ করা অক্লান্ত মেরির আঙুলগুলোয় কেমন সাড় চলে যেতে লাগল । চোখের দৃষ্টি খুব কমে গেল। শরীরের চামড়াও কেমন খসখসে হয়ে যেতে লাগল। অসম্ভব ক্লান্ত শরীর আর চলছে না। কিন্তু এখনও যে অনেক কাজ বাকি তাঁর। তেজস্ক্রিয়তা আর রেডিয়ামের ইতিহাস নিয়ে বই লিখতে হবে। কিন্তু হাত আর চলছে না। ঠিক করে কলম ধরতে পারছেন না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বললেন, ‘যে রেডিয়ামকে তিনি পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্যে আবিষ্কার করেছেন, সেই রেডিয়ামই তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলেছে।’

মেরির রোগটি ছিল রক্তের একধরনের ক্যানসার। শরীরের রক্ত কোশগুলি তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। শরীরে অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা ঢোকার জন্যেই এই রোগ হয়েছিল তাঁর। কোনো উপযুক্ত সাবধানতা ছাড়াই দিনের পর দিন ‘রেডিয়োঅ্যাক্টিভ পদার্থ’ নিয়ে কাজ করে গেছেন। তারই ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছিল মেরির শরীরে। তেজস্ক্রিয়তা থেকে প্রাণঘাতী অসুখ যে হতে পারে, তা বুঝতে পেরেছিলেন, তবু শরীরের কথা ভাবেননি। রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি গবেষণায় মেরি নিমগ্ন থেকেছেন দিনের পর দিন।

১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই। ঘড়িতে তখন সকাল ছ’টা। তাঁর চোখ বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেল হার্টের স্পন্দন। চিরঘুমে শুয়ে আছেন মেরি। তাঁর মুখের ওপর যেন অদ্ভুত নীল আলো ছড়ানো। ৬৬ বছর বয়সে মেরি কুরি পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন।

মেরি চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে যেন কোনও মিডিয়ার লোকজন কিংবা নামজাদা কোনও নেতা সেখানে না-থাকেন। খুব সাধারণ ভাবে যেন তাঁর শেষ বিদায় হয়। মায়ের শেষ ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে আইরিন ও ইভ কেবলমাত্র খুব কাছের কয়েকজন মানুষকে খবর দিয়েছিলেন মৃতদেহ সমাধিস্ত করার সময়। মেরি চেয়েছিলেন, পিয়েরের সমাধির পাশে যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। পিয়েরের সমাধির পাশে রেডিয়াম-সম্রাজ্ঞীকে শুইয়ে দেওয়া হল।

মেরির মতন মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয় না। তাই আজও সারা পৃথিবীর মানুষের মনে বেঁচে রয়েছেন তিনি। কত দুঃখ যন্ত্রণা অপমান, লাঞ্ছনা, উপেক্ষা সহ্য করেছেন। মেয়ে বলে তাঁকে পদে পদে চূড়ান্ত অপমান, অবজ্ঞা আর অবহেলা সহ্য করতে হয়েছিল। সমস্ত বাধা অতিক্রম করেছেন। অবিচল থেকেছেন নিজের লক্ষ্যে। প্রয়োজনে প্রতিবাদ করেছেন। কখনো হতাশ হয়ে দমে যাননি।

মেরি কুরির জীবনের কথা, আত্মত্যাগের কথা, মানুষের কল্যাণের জন্যে কাজ করা এবং আকাশ-উঁচু অবদানের কথা পড়ে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী অনুপ্রাণিত হয়েছে। বড়ো হয়ে নিজের নিজের ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। তেজস্বিনী মেরি কুরির জীবনের কথা আলোকবর্তিকার মতন পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে তুলবে। বিজ্ঞান ইতিহাসে তাঁর গবেষণা, জীবন সংগ্রাম ও অবদানের কথা চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।

(সমাপ্ত)