• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

স্বরচিত সূর্যের গহ্বরে

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায় ঈশ্বরচেতনার রূপ রূপান্তর

জয় গোস্বামী হালফিলের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো উৎসব বলে আখ্যাত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলার এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের (২০১৬) মধ্যমণি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে অভিহিত করেছিলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে মরমী কবি’ বলে।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (৬ অক্টোবর, ১৯৩৩– ১৭ নভেম্বর, ২০২০) শুধু উত্তররৈবিক বাংলা কবিতা নয়, আবহমান বাংলা কবিতার নিরিখেই আমাদের এক প্রধান কবি। ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) থেকে ‘বাস্তুহারার পাহাড়তলি’ (২০২০) অবধি ছেচল্লিশটি মৌলিক কবিতার বই নিয়ে দীর্ঘ সাত দশক ব্যাপী তাঁর কবিতাযাত্রায় আছে বারেবারেই মোড় ফেরা। এমনকি ঐশ্বরিকতার অভিঘাত যে-বইয়ে সবচেয়ে সরব বলে কথিত, বাংলা কবিতার সেই মাইলফলক ‘যৌবনবাউল’ বইয়েও মিশেছে অন্তত দু-তিন পর্বের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ-মর্জির কবিতা।

Advertisement

আবির্ভাবের ঋতুতে, পঞ্চাশের সেই দিনগুলোতে বাংলা কবিতার যেন যুবরাজ ছিলেন অলোকরঞ্জন। প্রথম বই ‘যৌবনবাউল’ ছেপে বেরোবার আগেই নিজস্ব ভাষা আর ভাবনার জগৎ নিয়ে লেখা অলোকরঞ্জনের কবিতার ছটা সবার নজর কেড়েছে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের ঐতিহাসিক সেই কবিসম্মেলনে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবধি বাহাত্তর জন কবি কবিতা পড়েন। মাত্র কুড়ি বছরের তরুণ অলোকরঞ্জন একটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন আপ্লুত করে দিয়েছিল। সহযাত্রী কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষের বয়ানে, ‘একটি নতুন আবিষ্কার সেই সন্ধ্যার যাবতীয় জাদুস্পর্শ ছাপিয়ে গিয়েছিল’। স্মরণীয় সেই দীর্ঘ কবিতার নাম ‘আমার ঠাকুমা’, প্রথম প্রকাশ যার ‘শতভিষা’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় (১৯৫২)। হ্যাঁ, ওটিই ‘শতভিষা’য় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতা। তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগে কবিতা চেয়ে অলোকরঞ্জনকে চিঠি দেন পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক দীপংকর দাশগুপ্ত, যার পরিণাম এই কবিতা। এরপর থেকে ‘শতভিষা’ কবিতাপত্রে তাঁর উপস্থিতি অবিরল, সম্পাদনাও করেছেন পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা। ‘যৌবনবাউল’ বইয়ের এগারো সংখ্যক কবিতা হিসেবে এ কবিতা সংকলিত হবে। কবিদের কাছেও বহু প্রতীক্ষিত সেই ‘যৌবনবাউল’ অবশেষে প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৫৯ সালে, আর বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে, সে-বছরের ঘোষিত সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারের জন্য সেটাই হতে পারত যোগ্যতম বই। এ বই প্রকাশেরও আগে উৎপলকুমার বসু ‘কৃত্তিবাস’-এর পাতায় লিখছেন মেধাবী তরুণ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার কথা; জানাচ্ছেন, কবির আসন্নপ্রকাশ বইয়ের সম্ভাব্য নাম ‘যৌবনবাউল’ অথবা ‘পরাণ আমার স্রোতের দীয়া’। বলা বাহুল্য, প্রথম নামেই বইটির প্রকাশ। তবে যেটা লক্ষণীয়, দুই বিকল্প নামের ভেতর প্রথম নামটির মতো দ্বিতীয় নামটিতেও মিশে আছে বাউল-সুফি-দরবেশ-মরমিয়াদের সহজিয়া লোকায়ত জীবনদর্শন। ব্রাত্য, মন্ত্রহীন লোকায়তকে চিরায়তের প্রাপ্য মর্যাদা দেবার এষণা বুঝি অলোকরঞ্জনের শিরদাঁড়ায়। গত শতকের সাতের দশকে এরই প্রণোদনায় তাঁর কর্মক্ষেত্র হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়মান নব্য ভারততত্ত্ব (নিউ ইন্ডোলজি) বিভাগের সূচনা করেন অলোকরঞ্জন। এর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয় আধুনিক ভারতীয় ভাষার সাহিত্যের পাশাপাশি কবীর-বীজক থেকে বাউলগান অব।
এসব অবশ্য অনেক পরের কথা। পাঁচের দশকেই কবি প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী অধ্যয়ন ও ‘ভারতীয় কবিতায় লিরিকের উৎসার’ বিষয়ে গবেষণার শেষে বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনারত।

Advertisement

ভাবালু প্রগল্্ভতা নয়, মস্তিষ্কই তাঁর কবিতার প্রধান চালিকাশক্তি। মেধা ও অনুভূতির এমন মণিকাঞ্চন যোগ বিশ্বকবিতাতেই বিরল। সাহস, উদ্ভাবনীশক্তি আর কৌতুকপ্রিয়তার ত্রিবেণীসংগমে তিনি কখনও বা শেক্সপিয়রের Ariel-এর মতো। শান্তিনিকেতনে তাঁর স্কুলজীবন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদেবতা। অধিকন্তু বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো বটেই, ইতালীয় ভাষার কবি দান্তে থেকে উনগারেত্তি, জার্মান কবি গ্যোয়েটে, রিলকে, হ্যোল্ডারলিন থেকে ব্রেশটের কবিতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। ঈশ্বরের প্রতি কোনো অমেরুদণ্ডী আনুগত্য তাঁর কবিতায় সম্ভব ছিল না। অথচ অশীতিপর বয়সেও কবিকে এই মর্মে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হত যে, ‘যৌবনবাউল’-এর কবি তাঁর আস্তিক্যবোধে তখনও জর্জরিত ছিলেন কি না কিংবা কবি তাঁর মৌলিক কাব্যাদর্শ থেকে সরে এসেছিলেন কি না। কবির নিজের কথায়, ‘আজ যখন চূড়ান্ত নিরীশ্বর সমালোচকেরাও আমার সাম্প্রত কবিতায় ঈশ্বরের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে হাহাকার করে ওঠেন, তাঁদের আমি ওই বইটি আর এক বার পড়ে নিতে অনুরোধ করতেই পারি।’ (‘আমার প্রথম বই’, ৩১ মার্চ, ২০১৩)।

অলোকরঞ্জনের ঠাকুর্দা দিনাজপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধান শিক্ষক দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত অবসর গ্রহণের পরে সহধর্মিণী নির্মলাসুন্দরী দেবীকে নিয়ে দেওঘরের অদূরে সাঁওতাল পরগনার নির্জন গ্রাম রিখিয়ায় নতুন করে ভিটেপত্তন করে যৌথ পরিবারের বসবাসযোগ্য একটি অনুপম পরিসর গড়ে তোলেন । প্রসঙ্গত, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার রিখিয়া গ্রামখানি বিষ্ণু দে-রও স্মৃতিচিহ্নিত। প্রখর ব্যক্তিত্ববান দক্ষিণারঞ্জন দেবীপক্ষে জ্যেষ্ঠ পৌত্র অলোকের জন্মের পরে নিজের এই নতুন ভিটেয় দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। নাতি অলোকের কৈশোরেই দক্ষিণারঞ্জন পরম্পরা অনুসারে একসময় তাঁর এই জ্যেষ্ঠ পৌত্রের হাতেই এই পারিবারিক দুর্গাপুজোর ভার দিয়ে যান। হ্যাঁ, এই ঠাকুমা-ঠাকুর্দার কথাই ‘আমার ঠাকুমা’ কবিতায়। শহরবিদ্বেষী, অপার্থিব সুখের সন্ধানী বলেই প্রবীণ এই যুগল এ কবিতায় বর্ণিত।

ঠাকুমা-ঠাকুর্দার সূত্রে অলোকের রিখিয়ায় যাতায়াত ছিল অবিরল। কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব-কৈশোরের বেশ কিছুটা সময় কবি উদযাপন করেছেন রিখিয়ার ছবির মতো বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে, ছোটোনাগপুরের পরানিসর্গ ও প্রান্তিক জনের পরম্পরাবাহী লোকায়ত জীবনের পরিচর্যায়। বিশেষত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইভ্যাকুয়েশনের সময়ে একটানা বহুদিন প্রবাসী বাঙালির স্বর্গ পশ্চিমের রিখিয়ায় কেটেছিল কিশোর কবির। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে ছোটোনাগপুরের ‘নিরালা নিখিল’ আর গ্রামীণ সারল্য তাঁর কবিসত্তার অন্যতম ভিত।

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দক্ষিণারঞ্জন প্রিয় বড়ো নাতি অলোককে ইংরেজি পড়াতেন। তাঁর কাছেই আমাদের কবি শেখেন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের সেই ভ্রূভর্ৎসনা : ‘এক নদীতে তুমি দু’বার স্নান করতে পারো না।’ ঠাকুর্দার কাছে পাওয়া এই বীক্ষা কবিকে আজীবন শিখর থেকে শিখরে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁর চলিষ্ণুতার চালচিত্রে এসে মিশেছে বহু বাঁকবদল। তাঁর ইথারের জামা মেখেছে ব্রহ্মাণ্ডের ধুলো।

রিখিয়া থেকেই কবি এগারো বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে আসেন। তাঁর বাবা বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্ত আর মা নীহারিকা দেবীর ইচ্ছেতে। আর অলোক নিজে তো আশৈশব রবীন্দ্রভক্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর বাড়ির বারান্দা থেকে কবির অন্তিম যাত্রা দেখে মাত্র সাত বছরের বালকের কলম থেকে বেরিয়েছিল সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো একের পর এক কবিতা। শান্তিনিকেতনের ব্যাপারে ঠাকুর্দার খানিক অনীহা, কারণ ‘সেখানে তো সবাই ব্রাহ্ম’।

কবির শান্তিনিকেতনে রওনা হবার দিন অবশ্য স্টেশনে হাজির দক্ষিণারঞ্জন। ঠাকুরদার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া, কবির কাছে সেও এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

এই ঠাকুর্দার প্রভাবেই কবির নিজের কথায় কৈশোরে তিনি ‘ভগবতী ভবানীর প্রায়-পৌত্তলিক’ উপাসক হয়ে ওঠেন। ষষ্ঠীর ভোররাতে দেবীর পাদপদ্মে অষ্টোত্তর শত পদ্ম অর্পণ না করা পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না তাঁর। ‘যৌবনবাউল’ বইয়ের কবিতাসংখ্যা কেন যে মাঙ্গলিক ১০৮, তার কারণ তো এখানেই লুকিয়ে।

কিন্তু সেসব তো নিতান্ত অস্ফুট কৈশোরের কাহিনি । পরিণতমনস্ক অলোকরঞ্জনের ঈশ্বরচেতনা মানুষের জন্মার্জিত নশ্বরতাকে এক হাত দেখে নেওয়ার এক বদ্ধপরিকর অঙ্গীকার।

প্রজ্ঞান আর অবুঝ হৃদয়ের মধ্যিখানেই তো সেই বিরল অধিত্যকা, যার নাম কবিতা। মহৎ কবিমাত্রই দার্শনিক। অনশ্বর কবিতায় দর্শন থাকবেই। বাউলদর্শনের উদাস আলোকিত দৃষ্টি ‘যৌবনবাউলে’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘একটি হাঁসের রাজ্যে’ নামের কবিতার (পৃ. ১৮) শেষ লাইন, ‘একটি হাঁসের রাজ্যে হব আমি প্রসন্ন উদাসী।’ এই প্রসন্ন উদাসী জীবনবীক্ষণ তাঁর কাব্যপ্রবাহে অনুস্যূত।
সহজিয়া এক ব্যক্তিগত ভক্তিবাদ আর ঐশী অসন্তোষ এখানে মিশে আছে। উদার দৃষ্টি, অফুরান বিস্ময়, অপার করুণা ‘যৌবনবাউল’-এর পাতায় পাতায়।

‘মাতা যথা নিয়ং পুত্তং আয়ুসা একপুত্তমনুরখে এবম্পি সর্ব্বভূতেষু মানসম্ভাবয়ে অপরিণামং।’
অর্থাৎ মা যেমন নিজ আয়ু ক্ষয় করেই নিজের একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করে তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমাণ দয়াভাব জন্মাবে। করুণাঘন বুদ্ধের এই সদুক্তি এক চরাচরব্যাপি ভালোবাসায় পরিব্যাপ্তি ‘যৌবনবাউলে’র কবির কবিতায়। পূর্বোদ্ধৃত বুদ্ধের সদুক্তির পাশাপাশি পাঠক স্মরণ করুন, ‘যদি এ-শয্যার দুই তীরে/আমার অনিদ্রা থেকে ঝরে কোন নিদ্রার সুফল/আমার ভাইয়ের চোখে’ (‘যাত্রা’)। করুণাঘন বুদ্ধপ্রসঙ্গ বারবার এসেছে যৌবনবাউলে। পরবর্তী কাব্যপ্রবাহেও। বিশ্বশান্তির সপক্ষে নিউক্লীয় বোমার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আয়ুধ হয়ে।

যন্ত্রণা-হতাশা-বিতৃষ্ণা-উন্নাসিকতায় আকীর্ণ আধুনিক কবিতার আত্মরতিময় ক্লিন্নতায় এই বিনম্র শুশ্রূষা অভিনব। এই জন্যই বোধহয় তরুণ মিত্র ‘যৌবনবাউল’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘‘এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বীতচিন্ত যুগগতিতে সূচিত প্রত্যাসন্ন প্রলয়ের পটভূমিকায় ব্যক্তির যান্ত্রিক ভূমিকা ও প্রমূল্যের অবক্ষয়জনিত হতাশার নৈরাজ্যে ক্লিষ্ট কুটিল স্বৈরবৃত্ততাই সাধারণত যখন কাব্যের বিষয় তখন ‘যৌবনবাউল’ যে সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় ‘অভূতপূর্ব’ অনন্য সংযোজন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। …যন্ত্রণাবিদ্ধ, প্রমত্ত আত্মবিকলন পরিত্যাগ করে প্রসন্ন উদার ঐতিহ্যে আস্তিক্য ঘোষণা অলোকরঞ্জনের সেই সচেতন ভূমিকাই সূচিত করে।” (শতভিষা, অষ্টবিংশতি সংকলন, ফাল্গুন ১৩৬৮) কালগতিকে অস্বীকার নয়, তাকে নতুন ধারায় প্রবর্তনা দেওয়াই শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর কর্ম বলে মনে করেছিলেন এই কাব্য-সমালোচক।

বেড়া-ডিঙানো দৌড়বীরের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত গতিচ্ছন্দকে পুনর্বিন্যস্ত করতে করতেই ‘যৌবনবাউল’ থেকে কাব্যে কাব্যান্তরে তাঁর ঈশ্বরভাবনা আর মানবপ্রেমের এই অভিসার, যার ইঙ্গিত আমরা অতিসংক্ষেপে পরে দেখবো।
প্রথমে আসি ‘যৌবনবাউলে’র কথায়। বইয়ের সবচেয়ে সুপরিচিত ঈশ্বর বিষয়ক কবিতা সম্ভবত ‘বন্ধুরা বিদ্রূপ করে’:

‘বন্ধুরা বিদ্রূপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে;
তোমার চেয়েও তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে
আমি কি তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো?
…যদি অবিশ্বাসে দুই পায়ে দলে
চলে যাও, তাহলে ঈশ্বর
বন্ধুরা তোমায় যেন ব্যঙ্গ করে নিরীশ্বর বলে।’

স্পষ্টত অনতি-ঐশী ভাবনার এই কবিতাটি অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বৃহত্তর দোলাচল বুকে নিয়েই কালজয়ী।
এরপর আমরা দেখবো ‘গোধূলিতে চিন্ময়ের এক প্রতারণা’ (পৃ. ৯৫) কবিতাটি—
‘একটি আকাশ থেকে আরো এক অগ্রণী আকাশে
যাবে বলে দশটি চন্দনা
পা বাড়াল। ঈশ্বরের দিকে যেতে চায়,
দেখে এক মেঘ ভাঙে, হাসে। দশটি চন্দনা, তবু ডানার লহর তুলে চলে
দেখে সেই ভাঙা মেঘ বলে: ‘‘আর নয়, তোমাদের আর অনন্ত না—
অনন্ত ছিলেন এই এতক্ষণ তোমাদের পাশে,
ভেসে যান তোমাদের দিক পরিবর্তনের ফলে।’’
এই হল ‘যৌবনবাউলে’র ক্ষণিক অনন্ত। পথে চলে যেতে যেতে যার মৌহুর্তিক আভাসন।

‘মেঘের মাথুর’ কবিতাতেও দেখবো—
‘দুটি মেঘ ছিল দম্পতিচুম্বনে আর এই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল: জন্ম নিলেন ঈশ্বর নশ্বর!
এক মেঘ থেকে আরেক মেঘের সাঁকো গাঁথতে গেলেন, কিন্তু নিথর শূন্যে মিলিয়ে গেলেন নশ্বর ঈশ্বর।।’
প্রাতিস্বিক নশ্বরতার সঙ্গে বৈশ্বিক ঈশ্বরের দ্বন্দ্বময় লীলা ‘যৌবনবাউলে’র অন্যতম উপজীব্য। উপনিষদের চেতনা তো অনুস্যূত রয়েছেই কঠোপনিষদে যমের কাছে নচিকেতার প্রথম প্রার্থনা ‘শান্ত সংকল্প: সুমনা যথা স্যাদ্‌ বীতমন্যুর্গৌতমো মাভি মৃত্যো’ (‘পিতৃপুরুষ’), যা বিধুশেখর শাস্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত— তার চেয়ে ব্যাপকতর ভূমার অমৃতরূপে ও বৈরাগ্যের ‘মুঞ্জতৃণে’ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। তার চেয়েও বেশি করে আছে এক সহজিয়া ব্যক্তিগত ভক্তিবাদ (personal theism), যা বাউল-সূফি দর্শনের অঙ্গাঙ্গী:
‘এ যেন গুল্মোর ডাল, আর আমি একটি বাউল…
আল্লা বুড়ো আল্লা এই গুল্মোরের গাছ,
তাঁর খুব উঁচু ডাল, মহম্মদ পয়গম্বর’…
(‘একজন মৌলভী আমাকে’)
কিংবা
‘ফুল বলে যা চেনাই যায় না অথবা গাছ বলে; তার ভিতরে অসামান্য শক্তিশালী রাখাল তোমার বাঁশি: তোমার বুকের আড়াল-রাধা, তোমার যশোদা আর সুদাম নিয়ে কেমন করে আছে?’ (‘তুলসীতলা’)।

পথে চলে যেতে যেতে রবীন্দ্রসংগীতে সমর্পিতপ্রাণ গুণী অলোকরঞ্জন ‘চামর-দোলানো মেঘে অতসীজড়িত যুথী’ দেখে ক্ষমাপ্রার্থীর বিনম্রতায় গুনগুনিয়ে ওঠেন:
‘কী মেঘ দেখালে নিজে মেঘের আড়ালে বসে,
যদি কথা বলে উঠি যদি গান গেয়ে উঠি, ক্ষমা কোরো, স্থির ভগবান।।’ (‘প্রবর্তক’)।
প্রতিতুলনায় মনে আসে রিলকের কথা। জার্মান ভাষার এই আধুনিক কবি পঁচিশ বছর বয়সেই (প্রায় অলোকরঞ্জনের ‘যৌবনবাউল’-বয়স) দেখতে পাচ্ছেন সেই ঈশ্বরকে, মানুষের অভাবে যিনি অসম্পূর্ণ। অনেকটা ’আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে’-র ধরনে লিখছেন তাঁর ‘প্রহর পুঁথি’তে (Das Stundenlench): ‘আমি যদি যাই, তোমারও অর্থ/হারাবে।’
অলোকরঞ্জনের ঈশ্বরচেতনার বিবর্তন এক কবিতার বই থেকে অন্য কবিতার বইয়ে। প্রত্যেক মুহূর্তে নিজেকে বদলে নেওয়ার ক্ষমতা লিরিকের সহজাত বৈশিষ্ট্য। অলোকরঞ্জনের ঈশ্বরচেতনার রূপান্তর ঘটেছে পরবর্তী কাব্য পর্যায়ে। স্থানাভাবে এখানে শুধু আমরা তাঁর দু-একটি ইঙ্গিত দেখবো।

দ্বিতীয় কবিতার বই ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’তেই কাব্যসমালোচক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার এই ভেবে আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে, এই বইয়ের কোনো কোনো ‘কবিতায় ঈশ্বরকে আঘাত হানার ইচ্ছে প্রণিপাত করছে মনুষ্যত্বের দরজার সামনে’। প্রথম কবিতা (‘ঈশ্বরের প্রতি’) থেকেই তার আভাসন : ‘বিশ্বাসের জল, তুমি পান করো, আমি জল না খেয়ে মরব।।’ ‘যৌবনবাউল’-এর অন্ধকার ও অমীমাংসা কবির মা নীহারিকা দেবীকে উৎসর্গ করা ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’তে আরো উচ্চারিত।
আবার এই বইতেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি,
‘মাঝে-মাঝে স্পষ্ট করে বলা দরকার
ঈশ্বর আছেন,
মগডালে বসে-থাকা পাপিয়াকে আর
পর্যবসিত বস্তুপৃথিবীকে স্নান করাচ্ছেন।’
—‘পান্থ’, নিষিদ্ধ কোজাগরী (১৯৬৭)।
এই আত্মপ্রতিবাদের ঐক্য ,যা তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকেই পেয়েছিলেন, তাঁর কবিতার শিরায় শিরায়।

‘রক্তাক্ত ঝরোখা’ (১৯৬৯) উৎসর্গ করা অভিন্নহৃদয় কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষকে, যাঁর সঙ্গে— কবির নিজের ভাষ্যে— তাঁর বন্ধুত্বের কোনো গাছপাথর নেই :
“আমার বিষয়বস্তু: ‘ঈশ্বর’। এভাবে যদি বলি
অঙ্কুরিত হতে পারে অনুযোগ তোমাদের মনে,
অথবা আমারি রক্তে, যে কথাই বলি মনস্থলী
বিরুদ্ধ আবেগে কিংবা অনুষঙ্গের অনুরণনে
কেঁপে ওঠে।’’
(রক্তাক্ত ঝরোখা : ১)।
বাস্তব আর অতীন্দ্রিয়ের মধ্যে এই যে বিরোধাভাস, যাকে তিনি অভিহিত করবেন, ‘স্পন্দিত আঙ্গিকে ওঠানামা’ বলে, লক্ষণীয় তাঁর কাব্যপ্রবাহে।

কিছুটা দূরান্বয় হলেও কবিবন্ধু আলোক সরকারের মতো কেউ কেউ ভেবেছেন, ডব্লিউ বি ইয়েটস যেমন তাঁর প্রথম পর্বের কবিতার স্বপ্নময় ছায়ামায়ালোক পেরিয়ে নিজেকে প্রসারিত করেছেন জীবনের রক্তিমতার দিকে, অলোকরঞ্জনও প্রকৃতিলগ্ন প্রান্তিক কিশোর বুধুয়ার পথের কলসভরা কানায় কানায় আলো ভুলে যেখানে এসে দাঁড়ালেন, তা নিত্যব্যবহার্য সংসার, তার তৃষ্ণা, তার অবক্ষয়, তার দোলায়মানতা।

এমারজেন্সি আর নকশাল আন্দোলনের ঝাপটে কেঁপে ওঠা ‘গিলোটিনে আলপনা’ (১৯৭৭) বই থেকেই সামাজিক অঙ্গীকারের কবিতার ধারাটি স্পষ্টীকৃত। মঙ্গলময় ঈশ্বরের ধারণা কঠোর বাস্তবের কুঠারাঘাতে ম্লায়মান। অনাহত প্রতীতির জায়গাটা বিদীর্ণ হতে হতে ঈশ্বর এখন প্রকরণ।

মানব অস্তিত্বের যে-দেবায়ন ‘যৌবনবাউল’-এর অন্তরে সক্রিয়, দ্বিতীয় গাল্ফ যুদ্ধের পরে তা ভেঙেচুরে যেতে থাকে। কবির মনে হতে থাকে, ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন, এতটা সর্বনেশে আয়োজন তিনি সহ্য করছেন কী করে। ‘যৌবনবাউল’-এর ভরকেন্দ্রটাই আরো বোমাবিধ্বস্ত হয় এই যুদ্ধের পটভূমিতে। ‘শুনে এলাম সত্যপীরের হাটে’ (২০০১) বইতে তাই দেখছি, ‘যুদ্ধ এসে গুঁড়িয়ে দিল পীরের হাটবাজার।’

ঈশ্বর-নিরীশ্বরের এই দোলাচল আরো পরিস্ফুট পরবর্তী কাব্যপ্রবাহে:
‘একটু-একটু অনীশ্বর হয়েছি, তথাপি যেহেতু কবে যৌবনবাউল লিখেছিলাম ঈশ্বরের কথা বলি, ভাবমূর্তিটুকু রেখে নিতে…’
(‘ভাবমূর্তি’, সমস্ত হৃদয় শুধু ভূকম্পপ্রবন হয়ে আছে, ২০০৬)।
কিংবা
‘ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হল…
আজ তিনি অকৃতার্থতার প্রতিমূর্তি, তবু তাঁর ইমেজ
আমারই বজায় রাখবার
দায়িত্ব, যেহেতু একদিন
তাঁকে নিয়ে লিখে গেছি খুব।’ (‘ইমেজ’, ওষ্ঠে ভাসে প্রহত চুম্বন, ২০০৬)।
‘দুধে-আলতায় কুয়াশায় আঁকা ছবি’ (২০০৮) বইয়ের ‘মুহূর্ত ঈশ্বর’ কবিতায় দেখি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে ঈশ্বর বিষয়ক তাঁর সাম্প্রতিক ধ্যানধারণা :
শুভেন্দু, আমার কাছে সরাসরি জানতে চেয়েছে
ঈশ্বর বিষয়ে আমার সাম্প্রতিক ধ্যান ও ধারণা;

‘ডাকো বা না ডাকো এসে উপস্থিত হবেন ঈশ্বর’
‘সে কি খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা?’ (২০১২) বইয়ের প্রচ্ছদ তথা শিরোনামেই প্রশ্নচিহ্ন। এ বইয়ের একটি কবিতায় দেখব,
‘আমি যে ধরেছিলাম ঈশ্বরের সপক্ষে কলম
সেকথা ভোলেনি কেউ, কোনোখানে এক তিল ব্যত্যয়
ঘটলেই আমাকে ওরা সেই মর্মে মনে করিয়ে দেয়…
তাদের আবদারে আমি তৎক্ষণাৎ আমার একতারা
মহাশূন্যে মেলে ধরে দেহতত্ত্ব থেকে শুরু করে
মুর্শিদ্যায় গান বেঁধে পরমুহূর্তে গভীর উদ্বেগে
মাটিতে তাকিয়ে দেখি যুদ্ধচালনার ভ্রষ্টাচার
নিপুণ হয়েছে আরও, শান্তির নিউক্লিয়ার অস্ত্রাগার
সমস্ত শিবির জুড়ে সমবিতরিত কীরকম।’ (‘দায়বদ্ধ’)।
এ পর্বেরই একটি ‘মজা’র কবিতা :
‘মেঘের মধ্যে যখন আমার শিকড় ছিল অন্য সবাই ঘাপটি মেরে কী করছিল?
সত্যি বলতে তা নিয়ে কোনো ধারণা নেই
আমার মনে, তবুও কিনা একটি পাখি
একটু আগেই আমায় কিছু আভাস দিল
শুভার্থীরা অনায়াসেই আমায় নাকি আদৌ ক্ষমা করেনি ওরা ভেবেছে আমি
অচিরে যেন অতীন্দ্রিয় এ ভণ্ডামি খারিজ করে মাটিতে নামি। আমি এখন
মাটিতে নেমে জড়িয়ে আছি মানুষজন
শুভার্থীরা আমার গতি আর প্রকৃতি
সমঝে নিতে গড়েছে এক সাব-কমিটি!’ (‘শুভার্থীরা’, সে কি খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা?, ২০১২, পৃ. ৩০)।

‘আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে’র টানেই বুঝি অলৌকিক কাব্যপ্রবাহে ‘সে কি খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা?’র পিঠোপিঠি আসে যে বই তার নাম হয় ‘নিরীশ্ব্রর পাখিদের উপাসনালয়ে’(২০১৩)। এর একটি কবিতায় আমরা দেখতে পাব মৌলবাদের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদী ‘যত মত তত পথ’-এর প্রবক্তা রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা:
‘চড়ুইভাতির ছলে আজও দক্ষিণেশ্বরের দিকে

অনীশ্বর বন্ধুদের জড়ো করে সুযোগ পেলেই ছুটে যাই এবং কবুল করি আয়ুর প্রান্তিকে : কথামৃত ছাড়া আর আমার অপর শাস্ত্র নেই।
ভাবতেই অবাক লাগে কত অনায়াসে বলে দিলে
যত মত তত পথ;…
তৎক্ষণাৎ আকাশের নীলে
চোখ মেলতেই দেখি বিজন হিরণহংস হয়ে
ভেসে যাচ্ছ তুমি এক অকূল মুক্তির স্বাভিমানে।
আমার অসাধ্য অত আনন্দের বিস্তার অগাধ –
সুতরাং ফিরি সেই নিভৃত আলয়ে, যেইখানে সারদা মাতার হাতে ভগিনী নিবেদিতার হাত…’
(সত্তার ঠিকানা)।

অন্ত্যপর্বের ‘শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি’ (২০১৮) বইয়ের ’সিস্টিনে চ্যাপেলে শেষবার’ কবিতায় আবার দেখব :
‘‘এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য এক বধ্যভূমি ছুঁয়ে/ যেতে যেতে ভেবে মরি মানুষ কি এতই পিশাচ/ বনে গেছে? এক মৌলবাদ থেকে জিঘাংসু আর-এক/ স্বৈরতন্ত্রিতার দিকে যেতে যেতে ভেবেছি তাহলে/ এবার মানবজন্ম ব্যর্থ হল?/
এক সন্ধিক্ষণে/ পুনরুদ্ধারের জন্য মিকেলেঞ্জেলোর কাছে যাই,/ তিনি, বয়েসের চাপে কিছু ন্যুব্জ, নিঃশব্দে আমাকে/ সিস্টিনে চ্যাপেলে নিয়ে বললেন: ‘উপরে চেয়ে দ্যাখো,/ এসব আমার কাজ’ স্তব্ধ হয়ে আমি চেয়ে দেখি/ ফ্রেস্কোর গা ঘেঁষে ফ্রেস্কো, তারই মধ্যে একটি কিনারে/ ঈশ্বর- তিনিও ভারী বয়োভারানত- কীরকম/ অনায়াসে আদি মানবের দিকে সস্নেহে চ্যালেঞ্জে/ বাড়িয়ে দিলেন হাত, আর তখুনি শৌর্যের লাবণ্যে/ আদমও মেলে দিলেন তাঁর সুদক্ষিণ করাঙ্গুলি!/
আমি ভাবি কোন মন্ত্রে এরকম অপাপ সুন্দর/ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাঁকে, উপরন্তু প্রতিশ্রুতিময়,/ তাহলে তো এই জায়গাটা থেকে নতুন বিশ্বের/ অভিষেক হতে পারে, সেটা হলে কীরকম হয় …/
সন্তর্পণে আরও-একটা কথা ভাবি, ঈশ্বর আরেকটু/ এগিয়ে গিয়েই যদি আদমের হাত ছুঁয়ে দিতেন/ তবে তাঁর জাত যেত? মানুষ উচ্ছন্নে গেছে বলে/ তাঁর সেই শৈথিল্যকে আমি আজ দায়বিদ্ধ করি।’’
মানুষের উচ্ছন্নে যাওয়ার দায়ভার যেন কবি ঈশ্বরের ওপর আরোপ করতে চান।
উপান্ত্য বই ‘ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে’র (২০১৯) একটি কবিতা ‘সতীর্থের শোকসভায়’ থেকে কয়েক পঙ্‌ক্তি :
‘একদিন স্বরচিত সূর্যের গহ্বরে/ সানন্দে যাপন করে ছ-হাজার লিখেছি কবিতা,/ এক-একবার ঈশ্বরের শীর্ণ সিংহাসনে/ তাঁর স্নিগ্ধ সন্নিধানে জায়গা করে নিয়েছি, অন্তত/ এরকম ঠাউরে নিয়ে;/
একদিন অরবিন্দ গুহ/
আমায় বললেন যেন পুনরাবৃত্তির ঘোর থেকে/ সরে এসে অনীশ্বর হয়ে উঠি প্রকাশ্য চত্বরে।’
শেষ বইতেও ঈশ্বর-অনীশ্বরের এই ‘ধ্রুব সংশয়’ কবিকথিত আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে ওতপ্রোত:
‘একটি কবিতা লিখি ঈশ্বরবৃত্তে, স্বরবৃত্তে আরও একটি,
একটি শ্রোতার মনে জাগে ধ্রুব সংশয়
প্রণেতা আসলে দুই ব্যক্তি!’
(‘কবিসম্মেলনে’, বাস্তুহারার পাহাড়তলি, ২০২০)।
কোনো এক দেবীপক্ষে অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন, ‘দেবীপক্ষের শুক্ল পাখিটি আমাকে বলেছে, নিজের ছায়াকে পার হয়ে যাও।’ (‘আলোয় আলোয়’, তুষার জুড়ে ত্রিশূলচিহ্ন, ১৯৯৬)। আজ আর এক দেবীপক্ষে আমরা তাঁর বিরানব্বইতম জন্মদিনে উপনীত। আজ এ প্রশ্ন করাই চলে, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে চলা তাঁর কবিতার অভিযানকে কি আমরা যথার্থ ধারণ করতে পেরেছি? আজও?
বাংলা কবিতার একজন সামান্য পাঠক হিসেবে আমাদের এ জিজ্ঞাসা হেলাফেলার নয়।

Advertisement