তাপস চট্টোপাধ্যায়
ওটি-তে মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে ছিল। নীলাভ আলোটা বারবার জ্বলে নিভে যাচ্ছিল। পরপর দুটো বাইপাস সার্জারি সেরে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অভিমন্যু যখন ওটি-র বাইরে আসে, তখন রাত প্রায় দুটো। তখনই নজরে আসে বিল্বদার পরপর কয়েকটা মিসড্ কল। তবে কি জ্যাঠামনির! অবচেতন মনে একটা আশঙ্কার মেঘ ছেয়ে আসে। অন্যদিন দেরি হলে মণিদীপা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে, আজ জেগেই ছিল।
Advertisement
‘সন্ধে থেকে বিল্বদা তোমার মোবাইলে অনেকবার চেষ্টা করেছিল। না পেয়ে ল্যান্ড লাইনে খবরটা আমাকে জানায়।’
‘দীপা, তুমি তো জানো ওটি-তে আমার ফোন সাইলেন্ট মোডে থাকে। অ্যাট লিস্ট হসপিটালের রিসেপশনে খবরটা দিতে পারতে’, অভিমন্যুর স্বরে বিরক্তির ঝাঁঝ।
Advertisement
‘জানাইনি কারণ, দ্য গেম ওয়াজ অলরেডি ওভার। শুধু শুধু তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি’। মণিদীপা নির্লিপ্ত সুরে বলে, ‘তাছাড়া তুমি তো জানতেই এটা লস্ট কেস।’
অভিমন্যু চেষ্টা করেও মণিদীপার কথাগুলোর প্রতিবাদ করতে পারে না। একটা চাপা অপরাধবোধ বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পায়।
প্রায় ছ-আট মাস আগে শেষবার বিল্বদা অভিমন্যুর কাছে এসেছিল। জ্যাঠামনি তখন গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি।
‘বাবা তোমাকে খুব দেখতে চাইছে। আমরা সকলে অবশ্য বুঝিয়ে বলেছি যে, তুমি খুব ব্যস্ত থাকো, মাঝে মধ্যে বাইরেও যেতে হয়।’ সেবার বিল্বদাকে বেশ বিষণ্ণ লাগছিল। আগের মতো সঙ্গে করে ব্যাগ ভর্তি টাটকা শাক সবজি, পুকুরের পেল্লায় একটা মৃগেল মাছ, দেশি হাঁসের ডিম, নলেন গুড় পাটালি আর চিরাচরিত লালচে খসখসে দাদখানি চাল, কোনোটাই ছিল না।
মাঝে-মধ্যেই ভোরের ট্রেনে বিল্বদা হাজির হতো। ব্যাগ ভর্তি জিনিসগুলো ড্রইং-এর এক কোণে রেখে বলত, ‘বাবা পাঠিয়েছেন।’
ছোটবেলায় অভিমন্যু পেটরোগা ছিল বলে জ্যাঠামনির হুকুমে পাটকাঠির জ্বালে গরম গরম দাদখানি চালের ভাত খেয়ে স্কুলে যেত। শুধু এই কাজের জন্যেই উঠোনের মাঝ বরাবর একটা আস্ত উনুন পাতা হয়েছিল। এ ছাড়াও ঘরের পোষা গরুর দুধের সিংহভাগটাই হয় ঘি, নয়তো ছানা করে অভিমন্যুর জন্য বরাদ্দ ছিল। পুকুরে মাছ ধরলে সবচেয়ে বড়ো মাছের মাথাটা পড়ত অভির পাতে। হাঁসের খোল থেকে ডিম, গাছের ডাব, সবেতেই অগ্রাধিকার পেতো অভিমন্যু।
‘যে গাছের বাড়বৃদ্ধি আছে তাতেই সারখোল দিতে হয়।’ জ্যাঠামনির তির্যক মন্তব্যগুলো যে নিজের দুই ছেলে বিল্ব আর অমু-কে উদ্দেশ করে বলা, সেটা বাড়ির লোকেদের বুঝতে অসুবিধা হত না।
‘বছর বছর পরীক্ষায় প্রথম হতে মগজে ঘিলুর দরকার। ভালোটা মন্দটা না খেলে ঘিলুটা বাড়বে কীকরে?’ এটাও কার উদ্দেশে সেটাও স্পষ্ট ছিল।
বিল্বদা আর অমু প্রাথমিকেই হোঁচট খেয়ে জ্যাঠামনির সঙ্গে চাষের কাজে লেগে পড়েছিল।
হৃদয়পুর জুড়ে অভিমন্যুর মতো মেধাবী কেউ ছিল না। বরাবর সরকারি বৃত্তি পেত।
হৃদয়পুর গ্রামটা আর পাঁচটা গ্রামের মতোই ছিল। সাদামাটা অগোছালো জীবনশৈলির এক অখ্যাত জনপদ। কিন্তু হঠাৎই যেদিন কালো মিশমিশে মসৃণ অজগর সাপের মতো প্রকান্ড এক্সপ্রেস ওয়ে-টা হৃদয়পুর গ্রামটাকে ফালাফালা করে দিগন্তে হারিয়ে গেল, সেদিনই হৃদয়পুরের হৃদয় জুড়ে শুরু হল উথালপাথাল। জ্যাঠামনি বলল, ‘বৌঠান, এই রাস্তা সরাসরি মিশবে কলকাতায়, পাশের জমিগুলো ক্রমশই দুর্মূল্য হচ্ছে। আমাদের অভি ওই জমিতেই হাসপাতাল করবে। গাঁয়ের লোককে আর হন্যে হয়ে শহর ছুটতে হবে না।’
দাদু বেঁচে থাকতেই যাবতীয় সম্পত্তি, জমিজমা দুই ছেলেকে চুলচেরা ভাগ করে দিয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত অভিমন্যুদের ভাগের জমিগুলো পড়েছিল এক্সপ্রেসওয়ের গা ঘেঁষে।
বাবা বরাবর শয্যাশায়ী থাকতেন বলে ছোট্ট অভির আদর আব্দার ছিল তার জ্যাঠামনির কাছে। সংসারের খুঁটিনাটি, চাষবাসের দেখাশোনা, ছোট ভাইয়ের চিকিত্সা, ওষুধপত্রের জোগান; সবকিছুর মাঝেও ভাইপোর দেখাশোনাতে কোনও খামতি ছিল না।
ছোট্ট অভি স্কুল ছুটির পর সেই দীর্ঘদেহী মানুষটার অপেক্ষায় থাকত। মাঠের কাজ শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে জ্যাঠামনি তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। একটা নিষ্পাপ শৈশব স্বেচ্ছায় ধরা দিত সবল বাৎসল্যের নিবিড় বন্ধনে। ওই দীর্ঘদেহী মানুষটার মাংসল দুটো কাঁধে পা ঝুলিয়ে শিশু অভিমন্যু দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন দেখতো। রানিদীঘির গা ঘেঁষে দৈত্যাকৃতি শিরিষ গাছটা অশংখ্য শাখা প্রশাখা নিয়ে সারা বছর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ওই দীর্ঘদেহী মানুষটার সঙ্গে ওর মিল ছিল অনেকটাই। চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা লম্বা জিভেগজার মতো ফলগুলো নিচে বিছিয়ে থাকতো। ছোট্ট ছোট্ট হাতের চেটোয় দুটো একটার বেশি আঁটতো না। অসহায় চোখে ইতিউতি দেখত। তাতে কী? ওই দীর্ঘদেহী মানুষটা অনায়াসেই তার সব স্বপ্নগুলো জড়ো করে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারত।
ডা. অভিমন্যু হাজরা, ফেমাস কার্ডিয়াক সার্জন, হিউম্যান অ্যানাটমির মুখ্য সঞ্চালক তার কার্ডিও ভ্যাসকুলার সিস্টেমটা যার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। গাঢ় লাল রক্তের ধারা ধমনী দিয়ে অবিরত বয়ে চলে, কোন সম্পর্কের তোয়াক্কা না করেই। প্রথমে রাইট আর্টিয়াম, পরে রাইট ভেনট্রিকল হয়ে হৃদযন্ত্র। এরপর পালমোনারি আর্টারি হয়ে ফুসফুসে। সেখানেই প্রশ্বাসের প্রাণবায়ু নিয়ে নির্গত হয় যাবতীয় গ্লানি।
বিল্বদার কাছে জ্যাঠামনির অসুস্থ হওয়ার খবরটা অভিমন্যুকে দোটানায় ফেলে দেয়।
ডা. অভিমন্যু হাজরা, স্বনামধন্য শল্য চিকিত্সক, বছরের বেশিরভাগ সময়টা যার কাটে প্রাইভেট নার্সিংহোমে আর সুপারস্পেশালিটি হসপিটালের ওটি-তে। ব্যস্ত সিডিউলের চোরাবালিতে আটকে পড়ে হৃদয়পুরের সরল সাদাসিধে অভিকে এমন বাস্তবটা কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারে না।
‘মনে হল বিল্বদা হয়তো চাইছে জ্যাঠামনির চিকিত্সাটা আমরা এখান থেকে করি।’
একদিন একান্তে অভিমন্যু স্ত্রী মণিদীপার কাছে কথাটা তোলে।
‘কেন, জ্যাঠামনির ভাগের জমিজমা তো কম নয়। বিল্বদা সেগুলো বিক্রি করেই তো জ্যাঠামনির ট্রিটমেন্ট করাতে পারে। তোমার ডাক্তারি পড়ার খরচা আর বাবার চিকিত্সা করাতে তো আমাদের ভাগের দামী দামী জমিগুলো জলের দরে তখন বেচে দিয়েছিলেন। হিসেব-নিকেশ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি।’ একদমে মণিদীপা মনের সব ক্ষোভ উগরে চুপ করে যায়, তারপর বলে, ‘এসব অবশ্য তোমার মায়ের মুখেই শোনা।’
অভিমন্যু যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। শান্ত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে হঠাৎই একটা জলোচ্ছ্বাস। গ্রামের সরকারি হাসপাতাল থেকে কলকাতার নামী বেসরকারি হাসপাতাল। জলের মতো টাকা খরচা হতে হতে কলসির জল তলানিতে ঠেকে। অবশেষে জমাটাকা, সোনাদানা আর এক্সপ্রেসওয়ের লাগোয়া জমির দলিলগুলো মা জ্যাঠামনির হাতে তুলে দেয়। কয়েকমাস ধরে যমে মানুষে টানাটানি করেও শেষপর্যন্ত বাঁচানো যায় না। মৃতদেহ সৎকার থেকে শ্রাদ্ধশান্তি সবটাই হয় জ্যাঠামনির তদারকিতে হয়। সদ্যবিধবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন কিশোর অভিমন্যুর বুকটা কেঁপে উঠেছিল, যেদিন ত্রিবেণী ঘাটে নিজের ছোটভাইয়ের অস্তি ভাসিয়ে ওই দীর্ঘদেহী মানুষটাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছিল।
এরপর সবকিছুই আবার আগের মতোই হয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জয়েন্টে অভিমন্যু হাজরা প্রথম দশের মধ্যে একজন হয়। হৃদয়পুরের মতো অজ পাড়াগাঁ থেকে সেই প্রথম কেউ কলকাতায় ডাক্তারি পড়বে, এটা ভেবে গাঁ-সুদ্ধ মানুষ উচ্ছ্বসিত হওয়ার আগেই যেটা হয়, সেটায় গোটা হৃদয়পুর থমকে যায়।
এমবিবিএস পাশ করে ডা. অভিমন্যু হাজরা হঠাৎই একদিন মা’কে নিয়ে চলে গেল কলকাতায়। ওই দীর্ঘদেহী মানুষটার মুখে কোন কথাই সরলো না। অজগরের মতো ওই কালো মিশমিশে মসৃণ এক্সপ্রেস ওয়েটা যেন গিলে খেয়ে ফেলল সহজ সরল গ্রাম্য ছেলেটাকে। দৈত্যাকৃতি ওই শিরিষ গাছটা ঘাড় উঁচিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ওকে খুঁজে পেলো ন।
এরপর টানা চার বছর ইউ এস এ’র ম্যানহাটনের কিং জর্জ মেডিকেল কলেজ থেকে এফ আর সি এস করে অভিমন্যুর কলকাতায় ফিরে আসা যতটা নাটকীয় ছিল ততটাই জৌলুসে ভরা। এরই মধ্যে পৃথিবী ছেড়ে মায়ের চলে যাওয়া আর তার সঙ্গে অভিমন্যুর জীবনের অর্ধেক আকাশ ভাগ করে নেয় মণিদীপা।
‘দেখ, ইসিজি, ব্লাড প্রেসার, সিভিএস, এক্স-রে রিপোর্ট, সব দেখে তো ঠিকই লাগছে। তবে হসপিটাল ম্যানেজমেন্টকে তুই তো জানিস। এই বয়সের পেশেন্ট পাকা কাঁঠালের মতো। ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাবে। কমসে কম পনেরো দিন আইসিইউ আর পনেরো দিন ভেন্টিলেশন তো খাওয়াবেই। তারপর টেস্ট আর মেডিসিন তো বাড়বে ভ্যারেন্ডা গাছের মতো। লাখ দশেক ধরেই রাখ।’
শেষপর্যন্ত অভিমন্যু হাল ছাড়তে চায়নি। বিল্বদাকে ফোন করে জ্যাঠামনির সমস্ত মেডিকেল রিপোর্ট নিজের চেম্বারে আনিয়েছিল। ডা. ভার্গব বিদেশে ওর ব্যাচমেট ছিল, একই সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করে এখন একই হসপিটালে কর্মরত। একজন মেডিসিন স্পেশালিস্ট হিসেবে ডা. ভার্গবের এই ওপিনিয়নে অভিমন্যু একমত না হয়ে পারে না, ‘আমার মনে হয়, এটা এমনিতেই লস্ট কেস। ঝামেলায় না পড়ে কিছু টাকা দিয়ে সেটেল করে নে।’
ডাঃ ভার্গবের শেষের কথাটা মণিদীপার মতোই অভিমন্যুকে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।
অভিমন্যুর মার্সিডিজ গাড়িটা অন্ধকার ফালাফালা করে ছুটে যাচ্ছিল। ড্যাশবোর্ডে ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে তিনটে। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে অভিমন্যু হারিয়ে গিয়েছিল অতীতের অন্তঃপুরে, বারবার মনে পড়ছিল ম্যাক্স লুকাডো-র সেই বিখ্যাত উক্তিটা— ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি একজন হার্ট সার্জন। তোমার বুক চিরে বিষাক্ত হৃদয়টা বার করে দেখতাম সেটায় গর্ব আর যন্ত্রণা কতটা।
এক্সপ্রেসওয়ের ধার ঘেঁষে গাড়িটা রেখে অভিমন্যু পায়ে পায়ে চলে আসে রাণীদিঘির পাড়ে। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, দাহকাজ সেরে সবাই ফিরে গিয়েছিল। আধপোড়া ভেজা কাঠগুলো থেকে ধিকিধিকি আগুন আর সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছিল। দু-পা হাঁটলেই টিনের চালের মাটির বাড়িটা অভিমন্যুর খুব চেনা। তবু যাওয়ার সাহস পায় না, গাড়িটা ঘুরিয়ে ফিরে আসে।
ঠিক দু-দিন পরেই বিল্বদা আসে, সঙ্গে ছোটভাই অমু। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ, উসকো-খুসকো চুল, খালি পা, গলায় কাছা। বারবার বললেও বসতে চায় না, একটা কাগজ ভর্তি ফাইল অভিমন্যুর হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমাদের এক্সপ্রেসওয়ের লাগোয়া জমির দলিল, বাবা মারা যাওয়ার আগে তোমাকে দিতে বলেছিলেন।’
‘ভাইপো ডাক্তারি পাশ করে হৃদয়পুরে হাসপাতাল করবে’— প্রয়োজনে নিজের সমস্ত জমিজমা বিক্রি করেও ওই দীর্ঘদেহী মানুষটা নিজের স্বপ্নকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন।
এটা বুঝেই বোধহয় সেদিন ভোররাতে রাণীদিঘির পাড়ে নিভে আসা চিতার ভেজা কাঠগুলো সরিয়ে এক বিখ্যাত কার্ডিও সার্জন ডা. অভিমন্যু হাজরার সন্ধানী চোখ খুঁজতে গিয়েছিল একটা হৃদয়, গর্ব আর যন্ত্রণায় ভরা এক দীর্ঘদেহী মানুষের বিশাল হৃদয়।
Advertisement



