• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

আইসক্রিম ও বুম্বার অভিযান

নন্দিনী বলল, দেখি আমাদের অফিসের কেউ আছে কি না! বলে সে ফোনে বসে গেল। পেল না কাউকে। হঠাৎ গোয়েল লাফিয়ে উঠল। বলল, আরে, আমাদের লখনউ অফিসে শর্মা স্যার আছে।

কাল্পনিক চিত্র

সুতপন চট্টোপাধ্যায়

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

Advertisement

নন্দিনী বলল, তুমি বাড়িতে থাক। আমি থানায় গিয়ে দেখে আসছি। পবন তো সঙ্গে আছে। যদি কোনও থ্রেট কল আসে তো, তুমি ট্যাক্‌ল করতে পারবে। আমি ঘাবড়ে যেতে পারি। বলে সে এক গ্লাস জল খেয়ে চলে গেল বসন্তকুঞ্জ থানায়। গিয়ে দেখল তখনও নিজামুদ্দিন থেকে থানায় কেউ আসেনি। থানার বাইরে দু’জন কনস্টেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের এক জন বলল, ম্যাডাম, ওদের আসতে দেরি আছে। কোথাও ঘুরে আসুন। হঠাৎ মনে পড়ল, আধ ঘণ্টা পরে আসতে বলেছে, নন্দিনী খেয়ালই করেনি। কিছুক্ষণ পরে, বছর দশ কি বারোর একটি বালক পুলিশের সঙ্গে এসে হাজির। চুল ছোট ছোট করে কাটা। বাড়ি রোহিনী। আগ্রাগামী ট্রেন ছেড়ে যাবার পর এক জায়গায় বসে সে কাঁদছিল। রেলপুলিশ স্টেশন মাস্টারের হাতে তুলে দিয়েছিল। স্টেশন থেকে খবর পেয়ে আনতে গিয়েছিল পুলিস। ছেলেটি বাঙালি।

Advertisement

থানার অফিসার বলল, আমাদের ও কিছু বলছে না। দেখুন তো ও বোবা কি না? নাকি ভয়ে কথা বলছে না?
কী নাম তোমার?
তন্ময়।

নন্দিনী প্রশ্ন করল, তোমার সঙ্গে কেউ ছিল? এবার সে বলল, দাদার সঙ্গে আগ্রা যাবে বলে এসেছিল। ট্রেনে উঠতে গিয়ে হাত ফস্কে গেছে। দাদা তাকে ফেলে চলে গেছে।
নন্দিনী থানা থেকে বেরোনোর আগে বলল, না, এ আমাদের ছেলে নয়। আপনারা খোঁজ জারি রাখুন।

তখন রাত পৌনে ন’টা। বাড়িটা আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় থম। হঠাৎ একটা ফোন এলো। অচেনা নম্বর। পিন পতনের শব্দ নেই চারপাশে। যে আশঙ্কায় এতক্ষণ প্রতিটি মিনিট কাটছিল, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা হয়ত এবার! নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে অতনু। কত টাকা চেয়ে বসবে? কোথায় যেতে বলবে? আদৌ বুম্বা বেঁচে আছে কি না? নাকি কোন দুর্ঘটনার খবর? খুব সন্তর্পণে অতনু বলল, হ্যালো?
অন্য প্রান্ত থেকে একজন পুরুষ কন্ঠ। আপনি কি অতনু মিত্রা কথা বলছেন?

নানা বিজ্ঞাপনের ফোন আসে। অচেনা গলার কে আবার এই সময়? সতর্ক গলায় অতনু বলল, কে?
আমি বীর শর্মা। আবার প্রশ্ন করল, আপনার নাম কি অতনু মিত্রা? আপনার ছেলের নাম কি বুম্বা?
এবার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। ডেফিনিট কিডন্যাপ কেস। অতনুর বুক কে যেন দু’হাত ধরে চেপে ধরেছে। গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না।

অন্যদিক থেকে আবার প্রশ্ন, কী হলো, উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?
অতনু ভয়ে, মিনমিনে গলায় বলল, হ্যাঁ, আপনার পরিচয়? আপনি কী করে জানলেন?
লোকটি বলল, আমি রাষ্ট্রপতি ভবনের কুক। আমার বাড়ি এটাওয়া। আপনার ছেলে কি বাড়িতে আছে?
–কেন জানতে চাইছেন বলুন তো?
–ভয় পাবেন না। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করি। সত্যি বলুন।
কী যেন মনে হল। লোকটা কিডন্যাপার নাও হতে পারে। অতনু কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, না। তাকে বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বাড়িতে সবাই খুব উদ্বিগ্ন। নানান জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছি।
আপনার বাড়ির ঠিকানা বলুন।
আবার কেঁপে উঠল অতনু। বাড়ির ঠিকানা বলার আগে দু’বার ভাবল। কোন ট্র্যাপ নয় তো?
আপনি কি আরাত্রিকা আবাসনে থাকেন? আবার প্রশ্ন এলো ওধার থেকে।
অসহায় গলায় অতনু বলল, হ্যাঁ।
–ফ্ল্যাট নাম্বার বলুন।
ফ্ল্যাটের নাম্বারটাও বলল অতনু।
–আর খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। ঠিক আছে। ও আমাকে এই ঠিকানাই বলেছে।
ও কে? বুম্বা? বুম্বা কি আপনার সঙ্গে? বুকের অতল থেকে আচমকা প্রবল উৎন্ঠায় ছিটকে বেরিয়ে এলো কথাগুলো।
উত্তর এল, হ্যাঁ।
এবার?

লোকটা বলল, শুনুন। আপনার ছেলে পূর্বা এক্সপ্রেস ধরে মাসির বাড়ি যাবে বলে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে কলকাতা যাচ্ছে। আমিও ওই ট্রেনে বাড়ি ফিরছি। ট্রেন ছাড়ার পর আমি লক্ষ্য করি, দু’তিনজন বাজে ধরনের লোক তাকে নানাভাবে লক্ষ্য করছে, ট্র্যাক করছে। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে। আমার দেখে মনে হয়েছিল, ও ভাল ঘরের ছেলে। আমি ওর কাছে বসে আপনাদের খবর সব নিয়ে আপনাকে ফোন করছি।
বুম্বা কেমন আছে? বলে চিৎকার করে ওঠে নন্দিনী।

ভালো আছে ম্যাডাম। চিন্তার কোনও কারণ নেই। শুনুন, আমি একটু পরে নেমে যাব। ভালোভাবে মন দিয়ে শুনুন। আপনার বেটাকে আমি রেল পুলিশের হাতে হ্যান্ডওভার করেছি। কেননা, সে কলকাতার মাসির বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেনি। রেল পুলিশ তাকে পাঁউরুটি আর কলা খাইয়েছে। তাদের কোচের উপরের বাঙ্কে শুইয়ে দিয়েছে। খুব ক্লান্ত ছিল। সে ঘুমিয়ে গেছে। পুলিশ তাকে হাওড়ায় তাদের হেফাজতে রাখবে। আপনারা বা ওর মাসি প্রকৃত প্রমাণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেবেন। আমার নামবার সময় প্রায় এলো বলে। আপনাকে একটা নাম্বার দিলাম। কানপুরের রেল পুলিশের ইন্সপেক্টরের নাম্বার। তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন।

অতনু নাম্বারটা টুকে নিল। তার মোবাইলে রইল বীর শর্মার নম্বর। এটাওয়ার পর কানপুর। প্রবল বেগে ট্রেন ছুটছে। ফোনের লাইন কেটে যাচ্ছে লাগাতার।

তাহলে একটা হদিশ পাওয়া গেল। এটাওয়া ছাড়ার পর কানপুর স্টেশনের আরপিএফকে কানেক্ট করা গেল।
যিনি ফোন ধরলেন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কী করতে চান?
অতনু বলল, আমরা ছেলেকে কানপুরে নামিয়ে নিতে চাই।
–কে টেকওভার নেবে?
–আপনাদের কাছে রাখবেন। আমি কাল আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে আসব।
–না। সেটা সম্ভব নয়। আমরা রাখতে পারব না। যদি ওকে হাওড়া অব্দি বুক করা থাকে তাহলে কানপুরে আমরা নামাতে পারব না। আপনাদের লোক চাই। আমাদের অনেক ফরম্যালিটিজ আছে। আগে লোক ঠিক করুন।
–আপনারা হাওড়ার বদলে কানপুরে রাখুন। প্লীজ।
–নট পসিবল।
— আচ্ছা জানাচ্ছি, বলে নিরুপায় ফোন কেটে দিল অতনু। মাথায় বাজ পড়ল। এই সময়ের মধ্যে গাড়িতেও কানপুর সম্ভব নয়। কেউ কানপুরে নেই। কাকে পাঠাবে?


দেখতে দেখতে এটাওয়া পেরিয়ে গেছে। হয়ত লোকটি নেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে। ঠিক এক ঘণ্টা পরে ট্রেন কানপুর স্টেশনে পৌঁছবে। দাঁড়াবে মাত্র পাঁচ মিনিট। গোয়েল বাড়ি যায়নি। সে সঙ্গে আছে অফিস ফেরত। কারোর মুখে কিছু পড়েনি। গোয়েল কিছুক্ষণ বসে রইল মাথা নিচু করে। তারপর বলল, দেখো কানপুরে তো কেউ নেই। তারপর ইলাহাবাদ, ট্রেনটা থামলে ওখানেই নামাতে হবে। রাতের ট্রেনে কী হতে পারে আমরা জানি না। আমাদের রিস্ক নেওয়াও ঠিক হবে না। ইলাহাবাদ পেরোলেই বিহার।

নন্দিনী বলল, দেখি আমাদের অফিসের কেউ আছে কি না! বলে সে ফোনে বসে গেল। পেল না কাউকে। হঠাৎ গোয়েল লাফিয়ে উঠল। বলল, আরে, আমাদের লখনউ অফিসে শর্মা স্যার আছে। প্রেসিডেন্ট। ওঁকে ধরি, ওঁর অনেক কানেকশন আছে বলে জানি। গোয়েল ফোন করল। ফোন যাচ্ছে না। কোনও উত্তরও নেই। অনেকবার ফোন করে কোনও উত্তর না পেয়ে শর্মা স্যারের পিএ বিমলের ফোন নম্বর জোগাড় করল সে। তারপর সে বিমলকে বলল পুরো ঘটনা। বিমলের শরীর খারাপ। গতকাল থেকে তার প্রবল জ্বর। তবু গোয়েল বলল, এখুনি শর্মা স্যারকে বলো, কানপুর স্টেশন কানেক্ট করতে। লখনউ থেকে কানপুর খুব দূর নয়। কেউ যেন স্টেশনে গিয়ে আরপিএফ-এর সঙ্গে দেখা করে। বুম্বাকে রিসিভ করে। (ক্রমশ)

Advertisement