কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়
উঠোনের দিকে তাকিয়েছিলেন কান্তিময়। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। শরীরটা জুতের নেই। বেলা হলেও রোজকার মতো উঠোনে গম, মুড়ি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। উঠোনময় পাখির দল সেসব ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। মাটির একটা বড় পাত্রে পথচলতি গরু, কুকুর, ছাগলের জন্য ও পাখিদের জন্য অন্য একটি ছোটপাত্রে জল রাখা থাকে। যে যার সময়মতো এসে খেয়ে যায়।
Advertisement
বারান্দায় বসলে অনেক কথা মনে আসে কান্তিময়ের। ছোটবেলায় উঠোনে বন্ধুদের সঙ্গে তিনি গুলি খেলতেন। যেদিন জিততেন, কৌটো ভর্তি রঙিন কাচ্চিলগুলি ঝলমল করে হাসত। হেরে গেলে সেদিন কৌটোর ভিতরে কয়েকটামাত্র গুলি ম্রিয়মান হয়ে তাকিয়ে থাকত। এই উঠোনে ছেলে সুমনও গুলি খেলেছে। কান্তিময়ের বাবা খেলেছেন কি না জানা হয়নি। তিনি ছোটবেলা থেকেই কান্তিময়ের কাছে বাবা। ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাঁকে গুলি খেলতেন কি না জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। মনে করে দেখলেন তিনি যে এই উঠোনে গুলি খেলতেন তা সুমনকে কোনোদিন তিনিও বলেননি। নন্দিনীকে বলেছিলেন। নন্দিনী কি কোনোদিন সুমনকে গল্প করে বলেছেন সেইসব কথা। তা আর জানা যাবে না। তিন বছর হল নন্দিনী নেই। হার্ট অ্যাটাকে চলে গেছে। সেই কোন সুদূরে।
Advertisement
সকালে পশু পাখিদের খাবার ও জল দেওয়া শুরু করেছিল নন্দিনী। বলেছিল, ‘আমার মনে হয় ওরা যেন অপেক্ষায় থাকে, কখন আমি ওদের খাবার দেব। জল দেব।’
সুমন গ্রামের কাছাকাছি স্কুলে পার্টটাইম শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিল। সামান্য মাইনে হলেও বাবার কাছে থাকা যাবে, এটা ভেবেই সে চাকরিটা মেনে নিয়েছিল। অনেকে বলেছে, তোমার বাবা ছিলেন একজন প্রধান শিক্ষক সেখানে তুমি পার্টটাইমের শিক্ষক হয়ে ঢুকলে! কোনো উত্তর দিত না সুমন। সে যে বাবাকে একা ফেলে চলে যেতে চায় না, এটা তার মনের কথা, তা সাতকাহন করে কাউকে বলার দরকার নেই।
একসময় সুমন দেখল স্কুলের নানান বিষয়ে তার উপর ছড়ি ঘোরাতে আসছে কিছু অশিক্ষিত বেয়াদব ছেলেরা, তখন সে গোপনে অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে সে স্কুলে থাকতে পারবে না। সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেল সে। বেতন অনেক টাকা।
কান্তিবাবু না করেননি। সুমন যখন তার স্কুলের নানা সমস্যার কথা বলত, শুনে ভাবতেন তিনি এক অসহায় পিতা। ছেলের স্কুলে স্থানীয় কিছু লোকজনদের দ্বারা একটা দমনপীড়ন পরিস্থিতি চলছে, এর বিরুদ্ধে তাঁর কিছু করার নেই। তাঁর কিছু পুরনো ছাত্র প্রশাসনের অনেক উঁচু পদে আছে। অন্যসময় হলে তারা কিছু ব্যবস্থা নিতে পারত। এখন দিনকাল অন্যরকম। ইচ্ছে থাকলেও ওদের কিছু করবার উপায় নেই।
সুমনের স্কুলের কথা যখন তিনি শুনতেন, কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা তাঁকে অস্থির করত। ফলে সল্টলেকে যখন চাকরি পেল, তখন একটু মনখারাপ হলেও এটা ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন যে, সুমনকে আর প্রতিদিনের হীনযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। খবরটা শুনে তাঁর বুকের উপর থেকে যেন একটা বিশাল ওজনের পাথর নেমে গিয়েছিল।
সুমনের অফিসে প্রচুর কাজ, তবু সে প্রতিদিন তার বাবাকে ফোন করে। মাঝে মাঝে বলে, ‘বাবা আমি মাকে খুব মিস করি। আমি মাকে ভালোবাসতাম। তোমাকেও ভালোবাসি বাবা। তোমাকে কাছে না দেখে আমার কষ্ট হয়।’
চাকরি পাওয়ার পরে কয়েক মাস বাড়ি থেকেই যাতায়াত করেছিল সুমন। কান্তিবাবু নজর করেছিলেন সেই সকালে বেরিয়ে প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ত সুমন। তিনি তখন অফিসের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি দেখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
বেলেঘাটায় একটা মেসে বছর দুই থেকে, নিউটাউনে একটা বড় ফ্ল্যাট বুক করেছে সুমন। সেখানে উঠেও গেছে। প্রতিমাসে টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটের টাকা শোধ করছে। যা মাইনে তাতে অসুবিধা নেই।
পরশুও সুমন ফোন করে বলেছে, বাবা এবার তোমাকে নিয়ে আসবই। কথাটা ভেবে বড় করে শ্বাস ফেললেন কান্তিময়। শুধু উঠোন নয়, বাড়ি এবং চারিদিকে যত গাছপালা, সবই তার আর নন্দিনীর যৌথ উদ্যোগে অনেক ভালোবাসা ও পরিশ্রমে তৈরি করা। সংসারের কাজ সামলে যখনই সময় পেত কান্তিবাবুর পাশে এসে দাঁড়াত নন্দিনী। বাড়ির সামনের দিকে ফুলগাছ আর বাড়ির পেছনে সবজিবাগান। একটা ছোট পুকুরের মতো কাটা হয়েছিল। সেখানে মাছ হত। এছাড়া আম, জাম, কলা, লিচু, কুল, নারকোল ও বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ এই বাড়িটিতে। সবক’টিতেই নন্দিনীর ভালোবাসার ছোঁয়া। বাড়িটি আছে। গাছেরা আছে। বাড়িটির চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নন্দিনীর স্মৃতি। কেবল নন্দিনী নেই। কেমন একটা হালকা বিষাদের বাতাস বুকের মধ্যে বয়ে যায়। মনটাকে দ্রব করে তোলে। মনে মনে নন্দিনীকে তিনি পাশে বসান। দু’জনের কথা একাই বলতে থাকেন। একসময় নিজের এই বিচিত্র সংলাপের খেলায় নিজেই দুঃখের হাসি হেসে ফেলেন। অবরে-সবরে নন্দিনীর প্রাণের অধিক প্রিয় হারমোনিয়াম নিয়ে, তার পছন্দের গান গেয়ে ওঠেন তিনি।
দেখলেন গেট ঠেলে নিকুঞ্জ আসছে। কান্তিময়ের কাছে এসে একটি চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘শুনেছেন দাদা, প্রবালবাবু তো জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তার বাড়িতে ঘনঘন মিটিং। মনে হচ্ছে সব ফাইনাল হয়ে গেল।’
কান্তিময় উদাস হয়ে বললেন, ‘প্রবালও এই ফাঁদে পা দিল?’
‘না দিয়ে উপায় কী? যেভাবে ওর ছেলেরা আর তাদের বউয়েরা সারাক্ষণ পিছে লেগে আছে, তাতে তো ওর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। টাকা পয়সা নিয়ে ছেলেরা শহরে চলে যাবে। একা প্রবালবাবুর কী অবস্থা হবে কে জানে! এদিকে ঝন্টু তো সারাদিন মোটর সাইকেল নিয়ে এলাকায় চক্কর মারছে, আর জনে জনে জমি বিক্রি করে দেবার জন্য বোঝাচ্ছে।’
কান্তিময় বললেন, ‘যেদিন থেকে মোটর সাইকেল আর রাজনীতি গ্রামে ঢুকল, তখন থেকেই শান্তি রইল না।’
‘আপনি কী ভাবলেন?’
‘এখনও অবধি তো মন স্থির করে রেখেছি, আমার ভিটে আমি ছাড়ব না।’
‘আপনার আর আমার জমিটা যদি পাশাপাশি হত, তবে বেশ হত। আমার যেটুকু জমি তাতে আমার ইচ্ছেটা ঠিক মিটবে না।’
‘তোর কী ইচ্ছে?’ নিকুঞ্জর কথা শেষ হওয়ার আগেই মোটর সাইকেল দাপিয়ে ঝন্টু এল। স্কুলে থাকাকালীন ঝন্টুকে খুব স্নেহ করতেন কান্তিময়। লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। ও যখন ক্লাস এইটে তখন ওর মা মারা যায়। তারপর থেকে ও কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন কান্তিময়। মা-মরা ছেলেটাকে রেখে তিনি সকালে চলে যান চাকরিতে, ফেরেন রাতে। একাই বাড়িতে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। ঝন্টুর সঙ্গে ওর জেঠিমা, কাকিমা কেউই ভালো ব্যবহার করে না। সবই বোঝেন তিনি। রাতে অসহায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারেন না, কী করবেন।
ঝন্টু এখন এলাকায় তার দাপট দেখিয়ে বেড়ালেও, কান্তিময়ের কাছে এসে সে খুব বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে।
কান্তিময় বললেন, ‘কেমন আছিস?’
‘ভালো স্যার।’ প্রণাম করল। নিকুঞ্জকেও। বলল, ‘গত মাসে সুমনের সঙ্গে দেখা হল, বললাম স্যারকে এখানে একা ফেলে রেখেছিস কেন? ও বলল আপনাকে কত যেতে বলে ওর কাছে। আপনিই যেতে চান না। এখানে স্যার আপনার কী আছে?’
কান্তিময় হাসেন। বলেন, ‘কেন? তুই আছিস। শেষ বয়সে দেখবি না?’
‘কে কার বলুন স্যার? আমার মা, বাবা দু’জনেই আমাকে ছেড়ে উপরে চলে গেল। আমার কথা কি ভেবেছিল? জ্যেঠা, কাকা আমাকে দূর করে দিতে চাইছিল।’
নিকুঞ্জ বলল, ‘সেটা তো পারেনি। উলটে তুই দু’জনকে এই গ্রামছাড়া করেছিস।’
‘বেশ করেছি কাকা। আপনারা দেখেননি সেই অত্যাচার? ছোটবেলায় আমার থাকা খাওয়ার ঠিক ছিল না।’
‘সব দেখেছি। আসলে দু’চার বার যে তোর জ্যেঠা, কাকার সঙ্গে যে কথা বলিনি তা নয়। ওরা শুনবার মতো মানুষই ছিল না।’
ঝন্টু মোটর সাইকেলে শব্দ তুলে চলে গেল।
অবসরের পরে কান্তিময় মাঝে মাঝে স্কুলে যেতেন। যেদিন স্কুলে গিয়ে শুনলেন শহর থেকে অল্পবয়সের একজন শিক্ষিকা স্কুলে এসেছে, সেদিন অবাক হয়েছিলেন। পরে শুনেছিলেন প্রতিমা খুবই প্রতিবাদী মেয়ে। এইজন্যই তাকে গ্রামে পাঠানো হয়েছে শাস্তি হিসেবে।
প্রতিমা বলল, ‘স্যার আমার মনে হল, এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বইয়ের গন্ধ ভালোবাসে। শহরের ছাত্ররা বইকে প্রায় ভুলেই গেছে।’ কথাটা শুনে ভালো লাগল কান্তিময়ের।
প্রতিমা যে বাড়ি পেয়েছিল সেখানে থাকার অসুবিধা হচ্ছিল। হেডমাস্টারের কথায় কান্তিময় তাঁর বাড়ির দোতলায় প্রতিমাকে থাকতে বললেন।
‘আমি কিন্তু ভাড়া দিয়ে থাকব।’
‘বেশ তো!’ বললেন কান্তিময়।
এক ছুটির দিন প্রতিমা তার বাবা, মাকে নিয়ে এসে উঠল। সুমনও এল সেদিন।
প্রতিমা বলল, ‘স্যার, আমি এগ্রিমেন্ট করে আপনার বাড়িতে থাকব। মানুষের মন তো! যদি এমন হয় যে, আমি আর বাড়ি ছেড়ে উঠতে না চাই।’
কান্তিময় হেসে বললেন, ‘উঠতে না চাইলে আমি খুশি হব।’
বাবা কোনোদিন মায়ের হারমোনিয়াম কাউকে ধরতে দেয়নি। সন্ধ্যার পরে যখন কান্তিময়, প্রতিমার বাবা, মা আর সুমনের সামনে প্রতিমার দিকে হারমোনিয়াম এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘একটা গান শোনাও দেখি মা।’ খুব অবাক হয়েছিল সুমন।
সুন্দর কন্ঠস্বর প্রতিমার। সুমনের মনে হচ্ছিল বহুদিন বাদে বাড়িটা যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাবার মুখে হাসি।
ঝন্টু এল। চারিদিকে তাকিয়ে চুপ করে বসল। প্রতিমার গান শেষ হলে ঝন্টু বলল, ‘স্যার, এই পথে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হল যেন মাসিমা গান গাইছেন। জানি, তা হতে পারে না। তবু এলাম।’
‘বেশ করেছিস। বোস। রাতে এখানে খেয়ে যাবি।’
‘না স্যার, তার দরকার নেই।’
‘লজ্জা পাচ্ছিস? কতদিন তোর মাসিমা তোকে আর সুমনকে এক থালায় ভাত মেখে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে। আমার বাড়িতে তোর কীসের লজ্জা?’ কান্তিবাবু সবার সঙ্গে ঝন্টুর আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ওর ডাক নাম ঝন্টু, কিন্তু সুন্দর একটি নামও আছে। মাল্যবান। ও আমার আরেকটি ছেলে।’
কেমন ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল ঝন্টু। মনে পড়ল সুমন ও তাকে একথালায় ভাত মেখে মাসিমার খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্য। সে সব দিনগুলিতে তার জ্যেঠিমা, কাকিমা কেউই তার জন্য খাবার রান্না করে দিত না।
সুমন এবার ঠিক করেই এসেছিল সে বাবাকে তার কাছে নিয়ে যাবে।
কান্তিময় সব গুছিয়ে নিলেন। প্রতিমাকে বললেন, ‘দেখো আমার বাড়িতে যেন পশু-পাখিরা খেতে পায়। হারমোনিয়ামটা আমি তোমার কাছেই রেখে গেলাম। তুমি রোজ এটা বাজিয়ে গান কোরো। অনাথ আশ্রমের ছেলেরা আমার উঠোনে এলে ওদের খেলতে দিও। এতকিছু দায়িত্বের বোঝা তুমি নিতে পারবে তো মা?’ একটু থেমে একজোড়া বালা বের করে প্রতিমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাও তোমার কাছে থাক। এটা নিয়ে আর ছোটাছুটি করব না। সব সামলে রাখতে পারবে না?’
‘আপনার আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয়ই পারবো।’
যাবার দিন ঝন্টু এল। বলল, ‘স্যার আমাকে একটা খবর দিলেন না! সবাই যতটা খারাপ মনে করে, আমি অত খারাপ নই।’ চোখ জলে ভরে আসছে তার।
নিকুঞ্জ আর তাঁর মেয়ে ঝুমুর এল। ঝুমুর প্রণাম করল কান্তিময়কে।
কান্তিময় বললেন, ‘আর কতদিন তোরা নিজেদের এইভাবে লুকিয়ে রেখে, নিজেদের কষ্ট দিবি মা?’
নিকুঞ্জ বলল, ‘কীসের কষ্ট? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘ঝন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? দাপুটে ঝন্টুকে এত লজ্জা পেতে দেখেছিস কখনো?’ কান্তিময় বললেন, ‘ঝুমুরকেও দেখ। লজ্জায় কেমন করে প্রতিমার আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে!’
নিকুঞ্জ কেমন হতবাক হয়ে গেল। কান্তিময় বললেন, ‘আমার চোখে কিছুই এড়ায় না। যা হবে, খারাপ হবে না। এমন দিকশূন্য হয়ে ছুটে বেড়ানো ঝন্টুকে মাল্যবান করে তুলতে হলে ঝুমুরকেই দরকার।’
নিকুঞ্জ বলল, ‘আপনি যে কলকাতায় যাবার আগে আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন আমি ভাবতে পারিনি!’ বলেই হেসে ফেলল। ঝুমুর প্রতিমার হাত মুঠো করে ধরল।
সুমন ঝন্টুর কাঁধে হাত রাখল। কান্তিময় বললেন, ‘আমি বোধহয় শহরে বেশিদিন থাকতে পারবো না। আমার প্রতিদিন মনে পড়বে এখানকার মাটি, জল, গাছপালার কথা। বুঝলি নিকুঞ্জ, তোর বৌদি এই বাড়িতে রোজ আসে। আমার সঙ্গে কথা বলে। সে তো শহরে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে না। আমাকে সে এখানেই টেনে আনবে। প্রতিমার ওপর অনেক দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, আশাকরি, সে সব দেখেশুনে রাখবে। ঝন্টু, ঝুমুর তোমরা প্রতিমার সঙ্গে থেকো।’
মালপত্র যা কিছু গোছানো হয়েছে ঝন্টু আর সুমন দু’জনে মিলে গাড়িতে তুলল। বাবাকে নিয়ে যাবার জন্য সুমন উতলা হয়ে ছিল। বাবার মুখে যা শুনল, তাতে তার মনে হল বাবাকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে সে বোধহয় অন্যায় করছে!
ছোটবেলায় দেখত তার মা এক একটি গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াত। তাকিয়ে থাকত। মা নেই, তবু কি বাবা দেখতে পায় মাকে? যদি তাই হয়, তবে বাবা তো তার সঙ্গে গিয়ে কষ্ট পাবে। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নিকুঞ্জকাকার কাছে যেভাবে বাবা মায়ের কথা বলল, তেমন কথা তো বাবা কোনোদিন তাকে বলেনি!
প্রতিমা সুমনকে বলল, ‘কবে স্যারকে নিয়ে আসবেন?’
সুমন মনে মনে ভাবল আসতে তাকে হবেই। মাত্র কয়েকটা দিন প্রতিমাকে কাছ থেকে দেখে, আর মায়ের হারমোনিয়াম নিয়ে গান করায় তার মনের ভিতরে যে সুর ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে, তা কাউকে বলতে পারেনি। একা একা একটা ভালো লাগার পাহাড় মনের মধ্যে বহন করে, কেমন এতোল-বেতোল হয়ে গেছে সে।
প্রতিমার কথার জবাব দিতে পারল না সুমন। বাবার দিকে তাকাল। ভাবল, বাবা তো সবই বুঝতে পারে। তাহলে? সুমনের মনের ভিতরটা কি পড়তে পারছে না!
Advertisement



