শিখা সেনগুপ্ত
মিতুন-তুতুন দুই বোন। মিতুনের এই নয় বছর বয়স হল, তুতুন ঠিক পিঠোপিঠি না, একটু ছোট, তার বয়স পাঁচ বছর। তাদের খুব আনন্দ, বাবা-মার সঙ্গে আজ রাতে পুরীর দুরন্ত ট্রেনে তারা ওড়িশার তিন জায়গায় বেড়াতে যাবে। তাদের বাবা হাইস্কুলের মাস্টারমশাই, গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাবেন বলে অনেক আগে থেকেই টিকিট কেটে, ঘর বুক করে রেখেছেন। ছোট্ট তুতুন অতসব বোঝে না। মিতুন ক্লাস থ্রিতে পড়ে আর নানারকম ছবিওয়ালা গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসে। সেদিন রাতে শিয়ালদা থেকে কু-ঝিক-ঝিক করে যখন ট্রেন ছাড়ল, তুতুন আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। পরদিন ভোরে পুরী নেমে ওরা স্বর্গদ্বারে সমুদ্রের কাছেই একটা সুন্দর হোটেলে এল। দোতলায় ওদের ঘরের জানলা থেকে, বারান্দা থেকে বিশাল সমুদ্র দেখা যায়। পরদিন তারা গাড়ি করে অনেক দূরে, অনেক সময় নিয়ে পৌঁছল রম্ভা পান্থনিবাসে। এখানে সমুদ্র নেই, তবে নদীর মত একটা লেক বয়ে গেছে, নাম চিল্কা হ্রদ। সকালে তৈরি হয়ে তারা চিল্কার ধারে এল। নৌকোয় উঠে ছোট দুটোর কী আনন্দ! প্রথমে একটু ভয়-ভয় করছিল, নৌকো টলমল, কিন্তু পরে ঠিক হয়ে গেল। মা মাঝিকে বললেন, ‘‘তুমি সোজা ‘ডলফিন নোজ’-এ নিয়ে চল, বাচ্চারা ডলফিন দেখে আনন্দ পাবে।’’ তারপর অনেকক্ষণ চলে তারা একটা ধারে এল যেখানে ঢেউ কম। মাঝি নৌকোর মেশিন বন্ধ করে শুধু দাঁড় ধরে নৌকোকে এক জায়গায় স্থির রাখল। ওমা, একটু পরে ডলফিনরা জলের উপর দিয়ে লাফাতে লাগল। একটা তো প্রায় নৌকোর উপর পড়ে আর কী! মিতুন ছবির বইতে এদের দেখেছে। সে আনন্দে চীৎকার করে বলতে লাগল, ‘ডলফিন, ডলফিন!’ ছোট্ট তুতুন অবাক হয়ে বলল, ‘ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে।’ সে এই ছড়াটা মুখে মুখে নতুন শিখেছে। মিতুন বলে, ‘কোলা ব্যাঙ না রে বোকা, এর নাম ডলফিন। পরদিন সকালে তারা গাড়ি করে দারিংবাড়ি যেতে অরণ্যঘেরা পাহাড়ি পথে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কটেজের সামনে এসে থামল। কটেজ হলেও ভেতরের ব্যবস্থা বেশ ভাল। বড় বড় ঘর, ওয়াশরুম, আয়না সবই আছে। পাশেই ক্যান্টিন হল। চা, জলখাবার, দুপুরের খাবার সবই ওখানে পাওয়া যায়। তারা ফ্রেশ হয়ে, স্নান করে, রেডি হয়ে বনের পথ ধরে চলল ক্যান্টিন হলের দিকে, একেবারে দুপুরের খাবার খেতে। মিতুন গাছের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘বাবা দেখো, কত্ত বড় কাঠবিড়ালি!’ বাবা বলেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা এই জঙ্গলেই পাওয়া যায়, ‘জায়ান্ট স্কুইরেল’ বলে।’’ পরদিন বেড়াতে গিয়ে তারা হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়ী নদীর পাশে গিয়ে বসল। বিকেলে পাইন বনের মধ্যে দিয়ে তারা গোলমরিচ আর কফি বাগান দেখতে গেল। একটা ফাঁকামতন জায়গায় চা কফির দোকান দেখে বড়রা বেঞ্চে বসে চা, কফি খাচ্ছে, বাচ্চারা নিজেদের মত খেলছে। মিতুন দেখে গাছে একটা লেজঝোলা পাখি, ট্টি-টি-ই-ই করে ডেকে ডেকে দূরে দূরে উড়ে যাচ্ছে। মিতুনও ছুটে ছুটে তার পিছু ধাওয়া করেছে। অনেকটা ছুটে আর পাখিটাকে দেখতে পেল না। হুঁশ ফিরতে দেখে সে জঙ্গলের ভিতরে চলে এসেছে, মা-বাবা কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ফিরতে গিয়ে পথ ভুলে উল্টোদিকে বনের আরও গভীরে চলে গেল। চা-টা খাওয়া হয়ে গেলে মা খেয়াল করলেন যে, মিতুনকে তো দেখা যাচ্ছে না। তুতুনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদিকে দেখেছিস?’ তুতুন হাত দিয়ে বনের দিকে দেখায়— ‘ওই দিকে পাখি দেখছিল।’ মা বাবাকে ডেকে বলেন, ‘মিতুনকে দেখতে পাচ্ছি না।’ সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি চলে। না, মিতুন কোথাও নেই। মা কেঁদে ফেলেছেন। বাবা কয়েকজন ট্যুরিস্টকে নিয়ে বনের মধ্যে ঢোকেন। ‘মিতুন, মিতুন’— বাবা জোরে জোরে ডাকেন। কোনও সাড়া নেই। এদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। অন্যরা বলেন, ‘চলুন থানায় খবর দিই, ওদের কাছে জোরালো টর্চ থাকে, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আবার খুঁজতে আসি, এ অঞ্চলে বুনো কুকুর এমনকি কখনও নেকড়েও আসে বলে শুনেছি।’ মিতুনের মা কেঁদেই চলেছেন। বললেন, ‘কী হবে!’ বাবাকেও উদ্ভ্রান্ত দেখায়। এদিকে মিতুন বুঝেছে যে, এই ঘন বনে সে পথ হারিয়েছে, অন্ধকার নেমে আসছে। সে মা, বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দূরে কোনও হিংস্র জন্তুর ডাক শোনা গেল। তাকে আত্মরক্ষা করতে হবে। কিন্তু সে গাছে উঠতে পারে না। কিছুটা এগিয়ে আবছা আলোয় দেখল একটা বড় গাছ অন্য একটা বড় গাছের উপর এমনভাবে হেলে আছে যে গোড়ার দিকে ছোটমত একটা ঘরের মত হয়ে আছে। সে পাশ থেকে একটা বড় কাঠি নিয়ে তার ভিতরে কয়েকবার খোঁচাখুঁচি করল, না সাপ-টাপ নেই তাহলে ফোঁসফোঁস করত বা বেরিয়ে আসত। মিতুন গুটিসুটি মেরে, হামাগুড়ি দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। বাবা পাঁচ ব্যাটারি টর্চসহ থানার পুলিশ, আরো কিছু লোক জোগাড় করে সারারাত বন তোলপাড় করে ফেললেন। জোরালো টর্চের আলো ফেলে, ‘মিতুন মিতুন’ বলে চিৎকার করে ডেকেও তাকে পাওয়া গেল না। মিতুনের আশ্রয় নেওয়া গাছদুটোর পাশ দিয়েও গেছেন ডাকতে ডাকতে, কিন্তু মিতুন ঘুমিয়ে ছিল বলে শুনতে পায়নি। এদিকে ভোর হয়ে এসেছে। ‘ওর মাকে আমি কী বলব’—মিতুনের বাবা একেবারে মাটিতে বসে পড়লেন। দূরে গাছের মধ্যে মিতুনের ঘুম ভাঙল, দেখে আলো ফুটেছে। খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে লাগল। একটা যেন জলের কলকল মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে! মিতুন শব্দের দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে দেখে এক ছোট পাহাড়ী নদী বয়ে যাচ্ছে। সে দু’হাত জড়ো করে জল খেতে লাগল। থানার অফিসার মিতুনের বাবাকে বলেন, ‘মিস্টার বোস, উঠুন, ওদিকে নদীর দিকটায় খোঁজা হয়নি।’ সঙ্গের লোকেরা বলল, ‘ওখানে তো রাতে জীবজন্তুরা জল খেতে আসে।’ মিতুনের বাবা আঁতকে ওঠেন, পা আর সরে না। অফিসার বলেন, ‘চলুন, আমাদের শেষ চেষ্টা করতে হবে।’ হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা নদীর ধারে যান। একটা লাল জামা গায়ে ছোট মেয়ে যেন জল খাচ্ছে! মিতুনের বাবা ছুটে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেন। এবার তিনি কেঁদে ফেলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি মা, সারারাত তোকে খুঁজেছি।’ সবাই মিলে হৈ-হৈ করে মিতুনকে কটেজে নিয়ে এলেন। ওর মা একেবারে মেঝেতে উপুড় হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। ‘দেখো, কাকে নিয়ে এসেছি।’ ওর বাবার কোলে মিতুনকে দেখে মা উঠে মিতুনকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমো দিতে লাগলেন। তুতুন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘দি, ও দি।’ মিতুন বোনকে আদর করে, ‘কাঁদছিস কেন বোকা, এই তো আমি এসে গেছি।’
Advertisement
Advertisement
Advertisement



