একসময় বাঙালির জ্ঞানচর্চার সোনালি পর্বে সৃষ্টি হয়েছিল নানা বিশ্বকোষ, নানাধরনের জ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থ। ভারতকোষ, বিশ্বকোষের মতোই ছিল বহু অল্প-পরিচিত কিন্তু সম্ভ্রম জাগানো জ্ঞান-প্রকল্প। সেই সব সঞ্চয়ের মধ্যেই এক অমূল্য সম্পদ ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’। বহু গবেষকের কাছে এটি কেবল একটি অভিধান নয়, বরং বাংলা এবং বৈষ্ণব ঐতিহ্যের এক বিস্ময়কর এনসাইক্লোপিডিয়া।
এই বিপুল কর্মযজ্ঞের একক নায়ক হরিদাস দাস বাবাজী। প্রথম জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র—দুটি বিষয়ে এমএ, তাতেও প্রথম স্থান এবং গোল্ড মেডেল। এরপর তিনি দীক্ষিত হন বৈষ্ণব জীবনে। কিন্তু দীক্ষার পরেও তাঁর সাধনা থেমে থাকেনি—বইয়ের সেবা, বৈষ্ণব সাহিত্যের পুনরুদ্ধার, সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং অনুবাদকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ব্রতের মতো। নবদ্বীপের হরিবোল কুটির থেকে তাঁর সম্পাদিত প্রায় পঁয়ষট্টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে সুকুমার সেন—দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্বজ্জনেরা।
Advertisement
‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’-এ স্থান পেয়েছে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, ভাষা, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, সঙ্গীত এবং তৎকালীন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের তথ্য। বৈষ্ণব পাঠক ছাড়াও বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতির গবেষকদের কাছে এই গ্রন্থ এক অপরিহার্য তথ্যসূত্র।
Advertisement
ডিজিটাল যুগে প্রবেশের পর বহু মূল্যবান গ্রন্থ অনাদরে হারিয়ে যাচ্ছিল। সেই সঙ্কট কাটিয়ে এবার এই অভিধানকে সহজলভ্য করে তুলল ইন্টারনেট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান ড. অভিষেক বসুর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে চলা উদ্যোগের ফলাফল—এখন থেকে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’ অনলাইনে পড়া যাবে। ইতিমধ্যেই ‘চরিতাবলী’ খণ্ডটি প্রকাশিত ছিল। এবার প্রকাশিত হল ‘তীর্থাবলী’ খণ্ডও। পুরো ওয়েবসাইট-ই সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজড, ফলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে গবেষকেরা সহজেই খুঁজে পাবেন প্রয়োজনীয় তথ্য।
এই উপলক্ষে সম্প্রতি মহাবোধি সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত হল ‘জ্ঞানচর্চার নিভৃত ব্যাপ্তির উত্তরাধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্র। সেখানে অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী বলেন, বাংলা ভাষার প্রথাগত অভিধানগুলির তুলনায় হরিদাস দাসের কাজ সম্পূর্ণ নতুন ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। গদ্যকার স্বপন পাণ্ডার ভাষায়—‘বিগত পাঁচ শতাব্দীর সারস্বত উত্তরাধিকার এবার বিশ্ব পাঠকের সামনে উন্মুক্ত’—এই প্রকল্প যেন ঠিক সেই কাজটিই করছে।
অধ্যাপক মানস কুণ্ডুর মতে, এই অভিধান ভারতীয় জ্ঞান ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য গবেষণার মেলবন্ধনের এক যুগান্তকারী দলিল। আর প্রকল্প সম্পাদক অভিষেক বসু মন্তব্য করেন, ‘চৈতন্যদেব যে গুরুদায়িত্ব গোস্বামীদের দিয়েছিলেন—গ্রন্থরচনা এবং লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের—হরিদাস দাসের কাজ তারই উত্তরকালের প্রতিধ্বনি। আত্মপ্রচারের যুগে এমন নিভৃত, তবু বিদগ্ধ মানুষের স্মরণ আমাদের কর্তব্য।’
প্রকল্প বাস্তবায়নে ভক্তিবেদান্ত রিসার্চ সেন্টারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের পক্ষ থেকে সুমন্ত রুদ্র জানান, ‘ঐতিহাসিক কাজের অংশ হতে পেরে আমরা ধন্য। আমরা আশা করি অবশিষ্ট খণ্ডগুলিও দ্রুত প্রকাশিত হবে, যাতে সমগ্র পূণ্যভূমির এই বর্ণাঢ্য ইতিহাস বিশ্ববাসীর সামনে সম্পূর্ণ রূপে হাজির হতে পারে।’
এই ডিজিটাল পুনর্জাগরণ শুধু এক অভিধানের সহজলভ্যতাই নয়—বাঙালির জ্ঞান ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে রইল।
Advertisement



